বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারে চীন-ভারতের ভ্যাকসিন কূটনীতি

বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন সরবরাহ নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক লড়াই।
গত মাসে বাংলাদেশ সরকার চীনের বেসরকারি কোম্পানি সিনোভ্যাক বায়োটেককে করোনাভ্যাক ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালনোর অনুমতি দেয়। ঢাকাভিত্তিক ক্লিনিক্যাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট আইসিডিডিআর,বি এই পরীক্ষা চালাবে এবং তারা বুধবার জানায় যে স্থানীয়ভাবে ভ্যাকসিনটি তৈরির জন্য একটি শর্তভিত্তিক চুক্তিও করা হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানটি এই পত্রিকাকে জানায়, করোনাভ্যাক ভ্যাকসিন সফল হলে বাংলাদেশের একটি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করে তাকে এটি উৎপাদনের লাইসেন্স দেয়া হবে।
তবে এ ক্ষেত্রে সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখতে চাচ্ছে না বাংলাদেশ সরকার। ২৮ আগস্ট দেশটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন লাভের জন্য ভারতের সিরাম ইন্সটিউটের সঙ্গে বেক্সিমো ফার্মার চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের ডিশটিনগুইশড প্রফেসর আলী রিয়াজ এই পত্রিকাকে বলেন, [বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী] শেখ হাসিনা ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেছেন মনে হচ্ছে। [ভারত ও চীন] উভয়েই আরো প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।
দুই আঞ্চলিক শক্তির এই লড়াই দেখিয়ে দিচ্ছে কৌশলগত অবস্থানে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার ১৬০ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশটি গতানুগতিক যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রস্তাব দিচ্ছে তার বাইরে গিয়ে মাহামারি-সংশ্লিষ্ট ভূরাজনৈতিক সুযোগ খোঁজা হচ্ছে।
ভারত ও চীন উভয়েই তার বড় অংর্থনৈতিক অংশীদার হলেও প্রত্যেকের সঙ্গে বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা রয়েছে ক্ষুদ্র দেশটির।
গত এক দশকে ঢাকার সঙ্গে নয়া দিল্লীর সম্পর্ক গভীর হয়েছে, যাকে বেশি শক্তিশালী করে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে বাংলাদেশকে ভারতের সমর্থন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেই বন্ধনে কিছুটা টানাপোড়ন তৈরি হয়েছে। কারণ ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক কিছু ইস্যুতে বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ, অন্যদিকে বেইজিংয়ের সঙ্গে ঢাকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে।
সবচেয়ে বড় ইস্যুটি হলো গত বছর ভারতের পাস করা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। এতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে পারি জমানো অমুসলিমদের দ্রুত নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্য আসামে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) করার পরপরই নতুন নগরিকত্ব আইন পাস করা হয়। ফলে ভারত থেকে বাংলাদেশে মুসলমানদের গণবহিষ্কার ঘটত পারে ঢাকা আশংকা করছে।
পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে চীন। তার বড় বড় কোম্পানিগুলো ভারতীয় প্রতিপক্ষদের পেছনে ফেলে বাংলাদেশে বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ করছে। সম্প্রতি ভারত সীমান্তের কাছে বাংলাদেশের একটি বিমানবন্দর উন্নয়নের কাজ পায় চীনা কোম্পানি, যা নয়া দিল্লীর নীতিনির্ধারকদের উদ্বিগ্ন করে তোলে।
গত ১৮ আগস্ট ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালান। তখনই বেক্সিমকো ও সেরুম ইন্সটিটিউটের মধ্যে চুক্তির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৪,৩০০ জনের বেশি মারা গেছে। নিশ্চিত আক্রান্ত সংখ্যা ৩২০,০০০ জনের বেশি।
বিশ্লেষকরা বলছেন বাংলাদেশের বিকল্প থাকবে, তবে ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখতে হবে।
নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এ মোশতাক চৌধুরী বলেন, আমরা চীন ও ভারতের চেয়ে ছোট। এরপরও আমাদেরকে খেলা খেলতে হবে, কূটনীতি কাজে লাগাতে হবে।
এ জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে আরো সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সিনেভেক বায়োটেকের সঙ্গে অংশীদারিত্ব শুরু হবে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন সরবরাহ ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞান স্থানান্তরের মাধ্যমে।
তবে একটি করোনাভ্যাক ভ্যাকসিনের দাম কত হতে পারে সে ব্যাপারে সিনোভ্যাক এখনো কিছু জানায়নি বলে আইসিডিডিআর,বি সূত্র জানায়।
রাশিয়াও বাংলাদেশে স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিন উৎপাদনে আগ্রহ দেখিয়েছে।
তবে কোন দেশই যেন ভ্যাকসিনকে ভবিষ্যতে প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন রিয়াজ।