আমরা লাইভে English সোমবার, মার্চ ২৭, ২০২৩

বাংলাদেশের চীনমুখি হওয়ার খবর স্রেফ চায়ের কাপে ঝড়!

bvyngfwcyk-1598465076
২০১৯ সালের জুলাইয়ে বেইজিংয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান চীনের প্রেসিডেন্ট শি

ভারতীয় মিডিয়ায় যখনই বাংলাদেশের দ্রুত উন্নয়ন নিয়ে কোনো লেখালেখি শুরু হয়, আমি প্রথম তাগিদ অনুভব করি কোনো নতুন চুক্তি হয়েছে কিনা তা দেখার জন্য অর্থনৈতিক সংবাদপত্রগুলো খতিয়ে দেখা। আর তা কখনো ব্যর্থ হয় না: গুঞ্জনের সত্যিকারের ভিত্তির সাক্ষাত পাওয়া বিরল ঘটনা।
উদাহরণ হিসেবে কয়েক মাস আগের একটি ঘটনার কথা বলা যেতে পারে। ভারতীয় পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের কথা বলতে শুরু করল। পরে দেখা গেলে, এটি আসলে বাংলাদেশে নতুন তেল শোধনাগার নির্মাণ নিয়ে ফরাসি একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের দরকষাকষির কারণে স্রেফ একটি অতিরঞ্জন।

ফলে জুলাই মাসের শেষ দিকে ভারতীয় মিডিয়া যখন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের পতন নিয়ে কথা বলতে শুরু করল, আমার আগ্রহ জাগল, কেন চায়ের কাপে ঝড় ওঠল তা জানার। সবশেষে দেখা গেল এর পেছনে রয়েছে সিলেট বিমানবন্দর সংস্কার নিয়ে বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপের কাছে দরপত্রে ভারতীয় নির্মাণ কোম্পানি লার্সেন অ্যান্ড টার্বোর হেরে যাওয়ার ঘটনা।

অনেক নিরাপত্তা পরামর্শক আপনাকে বলবে যে বাংলাদেশ সরকার অযোধ্যার বাবরি মসজিদের বিধ্বস্ত স্থানে রামমন্দির নির্মাণ বা জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন নিয়ে ভারতীয় পরিকল্পনার ব্যাপারে ক্রুদ্ধ। আসল সত্য হলো, শেখ হাসিনার সরকার এসব ইস্যুতে খুব বেশি উদ্বিগ্ন নয়। বরং এই সরকারের মূল লক্ষ্য ক্ষমতায় থাকা, অত্যন্ত অজনপ্রিয় এই সরকারকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় ভারতীয় সমর্থন নিশ্চিত রাখা।

গল্পের পেছনের গল্প

ভারতীয় পত্রিকাগুলো কেন প্রকাশ করল যে বারবার অনুরোধ করার পরও চার মাস ধরে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার রিভা গাঙ্গুলির সাথে শেখ হাসিনা সাক্ষাত করেননি?

ভারতীয় পত্রিকাগুলো আগ বাড়িয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার দৃশ্যমান অবনতিশীল সম্পর্কের কথা প্রকাশ করেছে। কাজটি করা হয়েছে সরকারপন্থী একটি বাংলাদেশী পত্রিকার সম্পাদক শ্যামল দত্তের উদ্ধৃতি দিয়ে। বস্তুত, ভারতীয় পত্রিকাগুলোর শ্যামল দত্তের মূল প্রতিবেদনটির উদ্ধৃতিই এই খবরের প্রধান উৎস।

আরও পড়ুনঃ চীনের দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ, কিন্তু কেন?

মাইক্রোসফট এক্সেল পরিভাষায় একে বলা হয় সার্কুলার রেফারেন্স। ভারতের একটি পত্রিকা উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, এক বাংলাদেশী সম্পাদক বলেছেন যে হাসিনা চার মাস ধরে ভারতীয় দূতকে সাক্ষাত দিচ্ছেন না। কিন্তু পরে দেখা গেল যে বাংলাদেশের ওই সম্পাদক আসলে একটি ভারতীয় পত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। মাইক্রোসফট এক্সেল যখন কোনো সার্কুলার রেফারেন্স শনাক্ত করে, তখন একটি এরর মেসেজ প্রদর্শিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষকের প্রয়োজন হয় এ ধরনের সার্কুলার রেফারেন্সকেই বড় কিছু হিসেবে দেখিয়ে যাওয়ার।

এটি সব পক্ষ প্রশ্নে উগ্র দেশপ্রেমিক মিডিয়া ও জাতীয়তাবাদী কল্পকাহিনী থেকে সৃষ্ট মারাত্মক অতিরঞ্জন। ঠিক ওই সময়ে হাসিনা ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মধ্যকার একটি ফোন সংলাপও সহায়ক হয়নি। পরে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কোভিড-১৯ বিস্তারের কারণে কয়েক মাস ধরে কোনো বিদেশীর সাথেই সাক্ষাত করেননি।

কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক সত্যিই কি শীতল হয়ে গেছে?

ভারতের সাথে আওয়ামী লীগের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এটি একটি প্রতীকী সম্পর্ক যা উভয় পক্ষের আগ্রহ ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। সমস্যা নিহিত রয়েছে প্রত্যাশা ব্যবস্থাপনা করার মধ্যে।

128594-resppzrstd-1598460728
শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

২০১৮ সালে বাংলাদেশের শেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে, ভারতে শেখ হাসিনার সফরের পর, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খোলাখুলিভাবে বলেছিলেন: আমরা ভারতকে যা দিয়েছি, তা তারা তাদের সারা জীবন মনে রাখবে।

সমস্যা হলো, ভারতীয় কূটনীতিকরা মনে হয় একইভাবে ভাবেন না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আগ্রাসী, একতরফা চুক্তিগুলো প্রমাণ করে যে ভারত বিশ্বাস করে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তারাই শেখ হাসিনার অগণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতায় এনেছে। এর বিনিময়ে প্রত্যাশা করা হয় যে শেখ হাসিনা প্রথমেই বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ দেখবেন। বাংলাদেশকে প্রতিদান দেয়ার কিছুই নেই ভারতের। বরং শেখ হাসিনা যত দিন ক্ষমতায় থাকবেন, তাকে অবশ্যই সবসময় প্রতিদান দিয়ে যেতে হবে।

বাংলাদেশ সরকারের প্রয়োজন অনেক মেগা প্রকল্প

শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত এসব আকাঙ্ক্ষার সাথে সমন্বয় সাধন করতে পেরেছেন। তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা একটি সমস্যা। সরকার তার রাজস্বের দ্বিগুণও ব্যয় করছে। ২০১৯-২০ সময়কালে ব্যাংক থেকে যে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে, তা গত ৪৯ বছরের মোট ঋণকে ছাড়িয়ে গেছে।

এই বেপরোয়া ব্যয় করে নেতৃত্বকে সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও আমলাতন্ত্রকে সন্তুষ্ট করতে হয়েছে। গত দশকে পরিষেবার মান ব্যাপকভাবে হ্রাস পেলেও সরকারি কর্মীদের বেতন ৩০০ ভাগ বেড়েছে। ইকোনমিক ইন্টিলিজেন্সে ইউনিটের ২০১৯ সালের সূচক অনুযায়ী যুদ্ধবিধ্বস্ত দামেস্ক ও নাইজেরিয়ার লাগোসের পর ঢাকা হলো বিশ্বের সবচেয়ে অবসবাসযোগ্য নগরী। বাংলাদেশের সরকারি কর্মীরা এখন রাশিয়ার কর্মীদের চেয়ে বেশি বেতন পান। পুরোপুরি জালিয়াতিপূর্ণ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা একটি সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে তারা এই আনুকূল্যের প্রতিদান দিচ্ছে।

অবশ্য, বারবার জনগণের ওপর পরোক্ষভাবে মাত্রাতিরিক্ত কর বাড়ানো সত্ত্বেও সরকার রাজস্ব বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সরকারের রাজস্ব অব্যাহতভাবে হ্রাস পাচ্ছে।

সরকারের টাকা দরকার, টাকা অনেক। আর সরকারি রাজস্বের একটি বড় উৎস হলো ভ্যাট, ট্যাক্স ও বড় বড় প্রকল্পের সরঞ্জাম আমদানির কর। ব্যাংক, বীমা কোম্পানি, বিদুৎ, জ্বালানি, সিমেন্ট, স্টিলসহ অন্যান্য শিল্প এসব প্রকল্প ঘিরে সরকারের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজস্ব সৃষ্টি করে। ফলে সরকার বুঝতে পেরেছে যে ঘাটতি মেটাতে নতুন নতুন আরো প্রকল্প প্রয়োজন এবং আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রকল্প চাঙ্গা করা।

আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশে চীনের প্রভাব নিয়ে ভারতের কি উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত?

চীনা ঋণ ফাঁদের কল্পকাহিনী?

অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক আপনাকে বিশ্বাস করতে বলবেন যে বিশাল বিশাল চীনা বিনিয়োগ প্রকল্প আসছে বাংলাদেশে এবং ঢাকা চীনা ঋণ ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এর ঠিক বিপরীত।

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ২০১৬ সালের ঢাকা সফরের সময় ২৪.৪৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের ২৭টি প্রকল্পের সমঝোতা স্মারকে সই হয়। আন্তর্জাতিক প্রকাশনাগুলো দাবি করতে থাকে যে ভারতীয় প্রভাব সংযত করার জন্য চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগ করছে চীন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ২০২০ সালের জুন নাগাদ ৫.৪ বিলিয়ন ডলারের মাত্র সাতটি প্রকল্প সই হয়েছে এবং চার বছরে মাত্র ১.৫৪ বিলিয়ন ডলার ছাড় দেয়া হয়েছে। এর সাথে তুলনা করা যায় এই পরিসংখ্যানটি যে বাংলাদেশ সরকার তার কর্মীদের বছরে প্রদান করে ৮ বিলিয়ন ডলার।

ভারতীয় মিডিয়া যদিও প্রায়ই দাবি করে থাকে যে দেশের উন্নয়ন বাজেটের ২৮ ভাগ, ১০ বিলিয়ন ডলার, যায় বাংলাদেশে, বাস্তবতা হলো শেখ হাসিনা সরকারের গত দশকে নয়া দিল্লীর সাথে তিনটি বাণিজ্যিক ঋণচুক্তি সই করেছে, যার মূল্য ৭.৩৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৮৬২ মিলিয়ন ডলারের প্রথম ঋণচুক্তি থেকে ৬০৪ মিলিয়ন ডলার, ২ বিলিয়ন দ্বিতীয় চুক্তি থেকে ৮.৪২ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে। ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের তৃতীয় ঋণচুক্তি থেকে এক পয়সাও পায়নি বাংলাদেশ। প্রতিরক্ষা খাতে ০.৫ বিলিয়ন ডলারের চতুর্থ ঋণচুক্তির অবস্থা এখনো অস্পষ্ট।

ভারত ও চীন উভয় দেশ থেকে কিঞ্চিত তহবিল প্রবাহ ও সেইসাথে ব্যাপক ঘাটতি ও রাজস্ব হ্রাসের কারণে বাজেটের ভারসাম্য বজায় রাখতে সরকারের প্রয়োজন বিপুলসংখ্যক বড় প্রকল্প।

২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সঙ্কটের সময় মার্কিন বন্ডের দরপতন ঘটে, বৈশ্বিক পুঁজি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেতে থাকে। ফলে বাংলাদেশ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বেশ বড় পরিমাণের পুঁজি লাভ করে। তাছাড়া গত তিন দশকে বাংলাদেশী জনসাধারণের আত্মত্যাগের ফলে বাংলাদেশর বৈদেশিক ঋণ নূনতম পর্যায়ে রয়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বে অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং বেশ ভালো।

তবে করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক পুঁজি পশ্চিম গোলার্ধের নিরাপদ অবস্থানে থাকতে চাচ্ছে। সবাই জানে যে বাংলাদেশের সরকারি আর্থিক উপাত্ত মারাত্মক রকমের বিকৃত করা হয়, এবং তা অনির্ভরযোগ্য। আবার কোভিড-১৯-এর কারণে বেশির ভাগ দেশই আর্থিক সঙ্কটের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।

মাত্র একটি দেশই রয়েছে যে বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী এবং বড় মাত্রার প্রকল্পে তহবিলও দিতে পারে। ফলে লকডাউনের মাসগুলোতে বাংলাদেশ সরকারের চীনের কাছে ১৬ বিলিয়ন ডলারের ২৬টি প্রকল্প (এসব প্রকল্পের মধ্যে ৯টি নতুন) অনুমোদনের চিঠি দেয়ায় অবাক করা কিছু হয়নি।

ooeququepx-1598466043

বিরূপ প্রতিক্রিয়া

বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা বিপুল পরিমাণ অর্থ। কৌশলগত কারণ না থাকলে বিশ্বের কোনো দেশই বাংলাদেশের মতো কোনো দেশে ১৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে না। ফলে বাংলাদেশ সরকার সম্ভবত বেইজিংয়ের কাছে ইঙ্গিত দিয়েছে যে সে চীনা সুরে নাচতে তৈরী।

আরও পড়ুনঃ শেখ হাসিনার সামনে অগ্নি পরীক্ষা

এখানে চমকপ্রদ বিষয় হলো এই যে চীনের কাছে পাঠানো তালিকায় ৮৫৩.০৫ মিলিয়ন ডলারের তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনর্বাসন প্রকল্পও রয়েছে। চীনের কাছে পাঠানো তালিকায় এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্তি সম্ভবত শেখ হাসিনার ব্যাপারে ভারতীয় নিরাপত্তা মহলের আত্মবিশ্বাসকে ঝাঁকুনি দিয়েছে। অবশ্য প্রকল্পটি নতুন নয়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১৬ সালে চীনের সাথে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছিল তিস্তার টেকটিক্যাল স্টাডিজের জন্য। সেচ প্রকল্প ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয় নয়।

কিন্তু বাংলাদেশের কৃষকদের রক্ষার জন্য নদীর ভাটির একটি প্রকল্পের প্রতি ভারতীয় নিরাপত্তা এস্টাবলিশমেন্টের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এটাই প্রমাণ করে যে জাতি হিসেবে বাংলাদেশের মর্যাদা কতটা হারিয়েছে ভারতের কাছে।

অনেকেই অনুমান করছে, গত সপ্তাহে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ষন শ্রিংলার ঢাকা সফর হয়েছিল এসব বিরোধ মেটানোর জন্যই। কিন্তু বিভিন্ন লোক তার সফরকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে। বাংলাদেশের কয়েকজন খুবই শ্রদ্ধাভাজন সাংবাদিক দাবি করেন, ভারতীয় মিডিয়া যেভাবে দাবি করেছে সেভাবে শ্রিংলার সফরে বরফ গলেনি, বরং তার সাথে শীতল আচরণ করা হয়েছে।

এ ধরনের জল্পনা এই সন্দেহের বীজ বপণ করতে সহায়তা করে যে বাংলাদেশ মৌলিকভাবে ভারত থেকে সরে দিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকছে।

তবে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের মধ্যে সম্পর্কে যে স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে তা পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম।  

সম্ভাব্য সেরা দৃশ্যপট

সত্য বটে যে আওয়ামী লীগ সরকার মিডিয়ার এই গুঞ্জন নিয়ে খুব অসন্তুষ্ট নয়। হাসিনা সরকার মিডিয়ার এই বাড়াবাড়ি থেকে তিনটি ফায়দা হাসিল করতে পারেন।

১. মিডিয়ার গুঞ্জনের ফলে চীন যদি আরো অর্থ প্রদান করে, তবে তা ভালো বিষয়ই হবে।

২. ভারতীয় প্রভাবের বিরুদ্ধে হঠাৎ করে এই মেরুদণ্ড শক্ত করার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের কাছে সরকার প্রমাণ করতে পারবে যে বাংলাদেশের রয়েছে অনেক বেশি সাম্যপূর্ণ সম্পর্ক।

৩. এসব পদক্ষেপ ভারতকে প্রকল্পগুলো ত্বরান্বিত করতে উৎসাহিত করবে। আর ভারতের পররাষ্ট্রসচিব শ্রিংলার সর্বশেষ ঢাকা সফরে ঠিক তা করতেই প্রতিশ্রুতি ছিল।

কিন্তু কী ঘটতে পারে?

এখানে তিনটি সম্ভাবনা আছে।

১. বেইজিং ভালোমতোই জানে যে টিকে থাকার জন্য হাসিনা সরকারের অর্থের প্রয়োজন। তারা তাদের কোষাগার কিছুটা খুলে দেবে, তবে তারা ভালোভাবেই জানবে যে প্রয়োজনের সময় এই সরকার সবসময়ই ভারতীয় স্বার্থের দিকে নজর রাখবে। এই আনুগত্য কৌশলগত অবস্থানের চেয়েও বড়।

এটাও অনুমান করা ঠিক নয় যে ২০১৩ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশ সরকারের বিচ্যুত হওয়ার বিষয়টি চীন ভুলে যাবে। ভারত ছাড়া প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তির প্রত্যাখ্যান করা ওই ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের পর বেইজিংকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর প্রস্তাব করার বিনিময়ে আন্তর্জাতিক বৈধতা প্রদানের জন্য চীনকে প্রলুব্ধ করেছিল। বাংলাদেশে অনির্বাচিত সরকারের বাস্তবতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ধীরে ধীরে গ্রহণ করার পর, প্রাথমিক সব কাজ সমাপ্তির পর, চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকার চুক্তি থেকে সরে আসে উচ্চতর সুদের কথা বলে। এটা যে চাপের কারণে হয়েছে, তা বুঝতে কারো কূটনৈতিক মেধার প্রয়োজন হয় না।

২. দেশে ক্ষমতাসীন মিডিয়া প্রপাগান্ডা ব্যবস্থা অতিসক্রিয়ভাবে প্রমাণ করবে যে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য ভারতকে দরজা দেখাতে কতটা আগ্রহী হাসিনা। কিন্তু দলীয় অনুগতদের বাদ দিলে এমনকি চার বছরের শিশুও তা বুঝবে বলে মনে হয় না।

৩. ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ভারতীয় মিডিয়া ও লোকজন তাদের প্রমোদ উদ্যান হিসেবে বিবেচিত একটি দেশে চীনা হস্তক্ষেপ নিয়ে চিৎকার করবে। কিন্তু এর মধ্যেই আওয়ামী লীগ ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের অভিজ্ঞ কূটনীতিবিদদের বোঝাতে সক্ষম হবে যে এই সরকারের টিকে থাকার জন্য বড় বড় প্রকল্পের কতটুকু প্রয়োজন। তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হবে যে চীনের সাথে তাদের সম্পর্কটি স্রেফ আর্থিক কারণে। আর বাংলাদেশের বার্ষিক বাজেটের ঘাটতি পূরণ করতে ভারতের সীমাবদ্ধতার কারণে এটি দরকার।

এমন অবস্থায় মধ্যবর্তী সময়ের জন্য তারা খুশিমনে হাসিনাকে তার ইচ্ছামতো চীনের দিকে গতিপথ পরিবর্তনকে অনুমোদন করবে। কারণ এই অবস্থান গ্রহণের ফলে তিনি অতি প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ আনতে পারবেন। অবশ্য, ভারতের জন্য স্পর্শকাতর বিবেচিত হলে, শেখ হাসিনা যেকোনো প্রকল্পই পরিত্যাগ করবেন।

এই তথ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সব পক্ষই এর বাস্তবতা সম্পর্কে অবগত। ফলে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের মধ্যকার সম্পর্কের স্থিতিবস্থা পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

 

লেখক: ইউরোপভিত্তিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক