আমরা লাইভে English বৃহস্পতিবার, মার্চ ৩০, ২০২৩

বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলার গুরুতর রোগ প্রকাশ করে দিয়েছে মেজর সিনহার হত্যাকাণ্ড

sinha
সিনহা হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওসি প্রদীপ কুমার দাস ও আরো দুজনকে কক্সবাজার কারাগার থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে

বাংলাদেশে মাদক বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র কক্সবাজারের একটি চেকপোস্টে পুলিশের হাতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলা ইস্যুর বাইরে এসে আরও বড় হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রের দুটো বড় প্রতিষ্ঠান পুলিশ আর সেনাবাহিনীর মধ্যে একটা সঙ্ঘাত উসকে দিয়েছে এটা। 

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ সম্প্রতি বিবৃতিতে বলেছেন যে তিনি দোষী ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। তার এই বক্তব্যকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এতে গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়েছে যে, হয়তো কারো কারো সাথে নরম ব্যবহার করার জন্য সরকারের উপর চাপ আসছে, বিশেষ করে প্রধান অভিযুক্ত পালের গোদা পুলিশ কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাসের সাথে। এবং সেনাবাহিনী (এবং জনগণ) সেটা ভালোভাবে নিচ্ছে না। 

অভিযুক্তদের দুজনের জবানবন্দী দেয়ার খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার পর মনে হচ্ছে যে, মেজর সিনহাকে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে হত্যার সম্ভাবনাটি যথেষ্ট শক্তিশালী। অনেকেই মনে করেন, জেনারেল আজিজ আহমেদের বিবৃতির অর্থ হলো যে সেনাবাহিনী মামলার প্রক্রিয়া নিয়ে খুবই সিরিয়াস। সিনহার মামলাকে তারা নিজেদের ইস্যু হিসেবে দেখছে। নিজেদের স্বার্থ বিপন্ন হলে তারা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উপর চাপ দিতে পারে। 

স্বীকারোক্তি

digest-eng-06-08-2020-bd-4
মেজর সিনহা

মেজর সিনহাকে একটা পুলিশি চেকপোস্টে হত্যা করা হয়, যেখানে তাকে এবং তার সাথের ভিডিও টিমকে বহনকারি গাড়িকে দাঁড় করানো হয়েছিল। লিয়াকত সিনহাকে চারটি গুলি করেছিল। সে বলেছে যে, প্রধান অভিযুক্ত টেকনাফ পুলিশ স্টেশানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদিপ কুমার দাস তাকে জানিয়েছিল যে, একদল ডাকাত টিভি ক্রুদের ছদ্মবেশে সেখান দিয়ে যেতে পারে এবং তাদেরকে ধরে ব্যবস্থা নেয়া/হত্যা করা উচিত। 

এনকাউন্টারের পরে প্রদীপ যখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়, সিনহা তখনও জীবিত ছিল কিন্তু পুলিশ সদস্যরা তখন তাকে লাথি দিয়েছে এবং তার ঘাড়ের উপর পা দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

তবে, এখনও কেউ জানে না যে, কেন সিনহাকে টার্গেট করা হয়েছিল। বাংলাদেশের গুজব শিল্প, যেটা চালিত হয় কল্পনা দ্বারা এবং যেখানে বাস্তব তথ্যের প্রভাব কম, সোস্যাল মিডিয়ার রটনা এবং মূলধারার মিডিয়ার রিপোর্টিং সবকিছু মিলিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজের ধরনের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে, যেটা তারা আইনি বিধিনিষেধের বাইরে চালিয়ে যাচ্ছিল। 

তবে, মনে হচ্ছে যেন ক্ষমতাধররা একটু পিছু হটেছে। সারা দেশে তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি এবং হত্যাকাণ্ডসহ বহু মামলা দায়ের করা হচ্ছে। 

কিন্তু প্রধান বিষয়টা হলো, পুলিশ যদি নতুন ভিলেন হয়ে থাকে, তাহলে মানুষের সুরক্ষা  দেবে কে? এই প্রশ্নের কোন উত্তর মিলছে না। মানুষ যদি পুলিশের উপর নির্ভর করতে না পারে, তাহলে তাদেরকে পালানো বা প্রার্থনা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। 

কে সবচেয়ে বেশি আর কম শক্তিশালী?

মিডিয়ায় পুলিশকে অশুভ হিসেবে প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে পুলিশ অ্যাসোসিয়েশান, যেটা সবার জন্যই উদ্বেগের। পুলিশ বলেছে যে, কিছু মানুষ দুটো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে একে অন্যের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে, দীর্ঘমেয়াদে যেটার ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে। অনেকেই এ ব্যাপারে একমত। 

তবে, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এই মামলাটি বর্তমান পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর সেনা পরিচয় একটা ভূমিকা রেখেছে। সম্প্রতি পালিত গুম দিবসে আমাদের আবারও মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, শত শত মানুষ মারা গেছে এবং হারিয়ে গেছে। অধিকাংশ মানুষ আইন প্রয়োগকারীদের প্রতি তাদের আঙ্গুল তুলেছে, যদিও তারা নিশ্চিত নন যে, পুলিশের কোন শাখা আসলে সবচেয়ে খারাপ। এই ইস্যুর চারপাশ ঘিরে যে নীরবতার দেয়ালে, সেখানে একটা আঁচড় কাটাও অসম্ভব হয়ে উঠেছে। 

সিনহার মামলায় স্বল্প সময়ে যে অগ্রগতি হয়েছে, এটা কোন ধাঁধাঁ নয়। ভুক্তভোগীর সেনা পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ এবং এতে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। ২০১৮ সালে ওই এলাকায় টেকনাফের মিউনিস্যাপ্যালিটির কাউন্সিলর আকরামুল হক র‍্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) হাতে নিহত হন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানে পরিকল্পিতভাবে হত্যার লক্ষণ থাকলেও, সেই ঘটনার আসলে কিছুই হয়নি। পরিহাসের বিষয় হলো, র‍্যাব এখন সিনহা হত্যার তদন্তের দায়িত্বে রয়েছে!

সাধারণ মানুষ কি বিবেচ্য?

যে কোন কারণেই হোক মানুষ হত্যা বা হয়রানির শিকার হওয়া, ঘুষ বা মুক্তিপণ দেয়া কখনই পছন্দ করে না। সে কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ঠিক খুব একটা জনপ্রিয় নয়। সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর এনকাউন্টার হত্যার মাত্রা কমে আসা প্রমাণ করে যে, চাপে কাজ হয়েছে। কিন্তু মানুষের চাপের কার্যকারিতার একটা মাত্রা আছে। জনগণ নামে পরিচিত অসহায় একটি গোষ্ঠিকে এই বাস্তবতা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে যে, মৃত্যু নেমে এসেছে। 

এনকাউন্টার হত্যাকাণ্ড ঘটার কারণ এটা নয় যে, পুলিশের হত্যার প্রবণতা রয়েছে বরং এর কারণ হলো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তাদের সক্ষমতা সীমিত। আর সেটা মূলত সুশাসনের প্রশ্ন। 

নিয়মিত আইন-শৃঙ্খলা প্রক্রিয়ার সিস্টেমটা অদক্ষ। এই প্রেক্ষাপটে এনকাউন্টারকে একটা সহজ উপায় হিসেবে নেয়া হয়েছে। কিন্তু তথ্য প্রমাণে দেখা যাচ্ছে যে, মাদক সরবরাহের সাথে জড়িত সন্দেহভাজনদের হত্যার পরও মাদক পরিস্থিতির মোটেই উন্নতি হয়নি। এর উদাহরণ রয়েছে অনেক। 

প্রশ্ন হলো: কর্তৃপক্ষের কি অপরাধ নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়ের কোন সক্ষমতা রয়েছে, যেখানে তাদের নিজেদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংক্রমনের কোন অভিযোগ উঠবে না? হত্যা মামলার রহস্য উদ্ধারের চেয়ে এই ইস্যুর সমাধান করা অনেক বেশি কঠিন।