ভারত কেন বাংলাদেশের ওপর সামরিক অংশীদারিত্ব ‘চাপিয়ে’ দিতে চায়?

করোনাভাইরাস মহামারী হতাশা সৃষ্টি করলেও বাংলাদেশের অনেকে আশঙ্কা করছিলেন যে ভারত যে বিতর্কিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে বাংলাদেশকে আবদ্ধ করার ‘স্বপ্ন’ দেখছে দীর্ঘ দিন ধরে, সেটি চূড়ান্তভাবে ঢাকার সামরিক এস্টাবলিশমেন্টে নয়া দিল্লির নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বাংলাদেশের মাটিতে আরো বেশি অবস্থান সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের ভারতীয় প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান না করলে বাংলাদেশ সরকার দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি হতে পারে।
বাংলাদেশকে সামরিক অংশীদারিত্বে রাজি করাতে ভারত নতুন যে চুক্তিতে আবদ্ধ করার চেষ্টা করছে, তাতে ঢাকার চেয়ে দিল্লিই বেশি লাভবান হবে। বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের সময় প্রস্তাবিত চুক্তিটি সই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯-এর কারণে সফরটি স্থগিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের কয়েকটি ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক গ্রুপ মোদিবিরোধী বিক্ষোভের কথা ঘোষণা করে বলেছিল যে সফরটির আয়োজন করা হলে তারা তাকে ঢাকা আসতে দেবে না।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান উপলক্ষে ১৭ মার্চ মোদির ঢাকা সফর করার কথা ছিল। কিন্তু সাধারণ বাংলাদেশীদের মধ্যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছিল যে আসলে তিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য নয়, বরং ভারতীয় সেকেলে ও অনুন্নত সামরিক সম্ভার বিক্রি করা সম্ভব, এমন একটি চুক্তি করতে আসছেন।
আরও পড়ুনঃ কোভিড-১৯ মোকাবেলায় মালদ্বীপে সাহায্য পাঠিয়েছে বাংলাদেশ
চীনা প্রভাব
চীন বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তম সামরিক সম্ভার সরবরাহকারী। ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বাংলাদেশের কাছে চীন ১.৯৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র সরবরাহ করেছে। এটি এই সময়ে বাংলাদেশের সামরিক ক্রয়ের ৭১.৮ ভাগ ছিল। এর ফলে ঢাকায় অস্ত্র সরবরাহ করার দিক থেকে চীন বিপুল ব্যবধানে প্রথম স্থানে থাকে।
সর্বশেষ চুক্তিটির কথা উল্লেখ করেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ২০২০ সালের ২ মার্চ ঢাকায় এক সেমিনারে। তিনি বলেন, আমাদের দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যকার আরো জোরদার অংশীদারিত্ব নির্মাণের চলমান প্রয়াসে উচ্চতর পর্যায়ে আস্থার ওপর জোর দেয়, বিশেষ করে আমরা ভারতে তৈরী সব সামরিক সম্ভার বিক্রি করতে আগ্রহী।
তিনি বলেন, ভারত সব পর্যায়ে অফিসারদের প্রশিক্ষণ সুযোগ দিতে চায়।
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ওপর ভারতের বাজি
বাংলাদেশের অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে চীনের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার চেষ্টা ভারত করছে দীর্ঘ দিন ধরে। কিন্তু চীন আগে থেকেই বাংলাদেশের সাথে জোরালো সম্পর্ক গড়ে রেখেছে। বাংলাদেশে অস্ত্র সরবরাহ ছাড়াও উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে ৩৮ বিলিয়ন ডলার প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার এই সময়কালে দেশে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বেশ কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছেন বলে তার সমালোচকেরা বলে থাকেন।
আশরাফুল (সরকারের প্রতিহিংসার ভয়ে প্রকৃত নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক) নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, যারা উপমহাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান রাখেন এবং গত প্রায় অর্ধ শত বছরে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আচরণ সম্পর্কে অবহিত, তাদের কেউই ভারতকে বাংলাদেশের বন্ধু বিবেচনা করে না। ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর থেকেই বাংলাদেশের ওপর অসংখ্য চুক্তি চাপিয়ে দিচ্ছে ভারত। তাজুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকারের সাথে করা চুক্তিতে সাতটি শর্ত ছিল। এর একটি ছিল, বাংলাদেশে কোনো পেশাদার সেনাবাহিনী থাকতে পারবে না। এখানে থাকবে একটি আধাসামরিক বাহিনী। পরে ভারতীয় কমান্ডের অধীনে রক্ষী বাহিনীর আত্মপ্রকাশ ঘটে।
অবশ্য, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান ওই চুক্তি অগ্রাহ্য করে পেশাদার সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ভারতের চক্ষুশূল হয়ে থাকে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার দক্ষতা ও সাহসিকতার জন্য প্রশংসিত হয়, জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী অভিযানে অবদান রাখে।
মিত্র লাভের জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বিপুল বিনিয়োগ করে ভারত। এর সুফল পাওয়া গেছে। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশ ঝুঁকেছে ভারতের দিকে। ভারতের অশেষ দাবি গ্রহণ করে দিল্লির প্রিয়ভাজন হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শাহাব ইনাম খান বলেন, মুসলিমদের প্রতি আচরণসহ ভারতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে দেশটির প্রতি বাংলাদেশের জনসাধারণের ধারণা নেতিবাচক। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে ভারতবিরোধী অনুভূতি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এর বড় কারণ ভারতের মিডিয়া বাংলাদেশকে ভারতের আঙিনা হিসেবে প্রচারসহ বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা চালায়। পাশাপাশি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে দুর্বলতাও রয়েছে।
ভারত কি তার সেকেলে অস্ত্র বাংলাদেশে বিক্রি করতে চায়?
বিদেশে বসরবাসরত বাংলাদেশীরা ভরতের উদ্যোগে দুর্গন্ধ টের পেয়েছেন। ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র ইরতাজা সালেহিন বলেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে ভেঙে দেয়ার নীলনক্সা রয়েছে ভারতের, এই সেনাবাহিনীকে ভেঙে দিতে একটির পর একটি ক্যু করার ইতিহাস রয়েছে। ভারত নিজে যেখানে বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান আমদানিকারক, তখন ভারতীয় অস্ত্র কিনতে কেন বাধ্য হবে বাংলাদেশ? ভারতে তৈরী অস্ত্রের মান এতই খারাপ যে ভারতীয় বাহিনীই এগুলো ব্যবহার করতে চায় না, এমনকি রাইফেলও না।
কৌশলগতভাবেই এটি গ্রহণযোগ্য নয় বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশরাফুল মনে করেন। তিনি বলেন, যেকোনো বৈরিতার সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিভাবে ভারতীয় অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে? সীমান্তে কোনো উত্তেজনার সৃষ্টি হলে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইসরাইল, জার্মানির অস্ত্র ব্যবহারকারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ভারতীয় অস্ত্র ব্যবহার করতে বাধ্য হবে বাংলাদেশ। ভারতীয় অস্ত্র নিয়ে আমাদের সেনাবাহিনী এমনকি মিয়ানমারের মুখোমুখি হতে পারবে না। কারণ চীন, রাশিয়া, ইসরাইল ও অন্যান্য দেশ থেকে অস্ত্র কেনে মিয়ানমার।
বাংলাদেশের সামরিক অফিসারদের ভারতে প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়টি আরো সন্দেহজনক। আশরাফুল বলেন, যারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে ভারতে যাবে, তাদের মগজ ধোলাই করা হবে। আমরা এমনটা আগেও দেখেছি। বিভিন্ন স্কলারশিপ নিয়ে যারা ভারতে গেছেন, শিক্ষা সফর করেছেন, সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন, তাদের মগজ ধোলাই করা হয়েছে।
বাংলাদেশের কিছু প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন যে ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তাদের শিক্ষকদের সাথে লড়াই করার মতো নৈতিক শক্তি পাবে না। তাদের শঙ্কা, এ ধরনের অংশীদারিত্বের ফলে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশে পরিণত করবে, যা শেষ পর্যন্ত চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে।
ভারতকে কেন বাংলাদেশ বিশ্বাস করবে?
ভারতকে বিশ্বাস করার পর্যাপ্ত কারণ নেই বাংলাদেশের। ভারত কেবল তার চুক্তি ও প্রতিশ্রুতিগুলোই ভঙ্গ করেনি, বাংলাদেশের ওপর তার নীতিও চাপিয়ে দিয়েছে। আশরাফুল বলেন, গঙ্গা, তিস্তা, সুরমাসহ ভারত ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর পানি থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছে। বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন যে ভারত তার জাতীয় নদী আন্তঃসংযোগ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য পশ্চিম ও দক্ষিণ অঞ্চলের সব নদীর পানি সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে। এটি করা হলে বাংলাদেশের জন্য মরণ আঘাত আসবে।
আরও পড়ুনঃ লকডাউনের সময় ত্রিপুরায় ইন্দো-বাংলা সীমান্তে অনুপ্রবেশ প্রায় শূন্য
আশরাফুল বলেন, ভারত আমাদের মহাসড়ক, রেলওয়ে, সমুদ্রবন্দর ও অন্যান্য সব স্থাপনা প্রায় বিনা মূল্যে ব্যবহার করলেও তারা মাত্র ২১ কিলোমিটর দূরে অবস্থিত ভুটান বা নেপালকে সংযোগকারী তার ভূমি বাংলাদেশকে ব্যবহার করার অনুমতি দিচ্ছে না। তিনি চিকেন নেক হিসেবে পরিচিত শিলিগুড়ি করিডোরের কথা উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশের সব ঘরানার বিশ্লেষকেরা একমত যে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেই ভারতের সাথে বাংলাদেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এই সম্পর্ক হতে হবে পারস্পরিক কল্যাণমূলক। তবে ভারতের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব প্রকট। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের সাথে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি হলেও ভারত এখন নতুন চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ আরো জোরদার করতে চাচ্ছে।
বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সাবেক কিছু সদস্যও এই প্রবণতার ব্যাপারে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ থেকে বিরত থাকেননি। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক এক সিনিয়র অফিসার (তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন) বলেন যে ভারতের সাথে যেকোনো চুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অবশ্যই বক্তব্য থাকতে হবে। তিনি বলেন, ভারতসহ প্রায় সব দেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সাধারণ রীতি হলো, দেশের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট সব চুক্তি, সমঝোতা স্মারক তারা খতিয়ে দেখে। তিনি বলেন, ভারতের সাথে সম্পর্কের জটিলতা ও বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ দাবি করে যে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সাথে আপস করতে পারে, এমন যেকোনো প্রতিরক্ষাসংশ্লিষ্ট চুক্তি থেকে আমরা বিরত থাকব।
(লেখক: নিউ ইয়র্কভিত্তিক বাংলাদেশী সাংবাদিক ও গবেষক)