মেঘা মজুমদারের শক্তিশালী প্রথম উপন্যাসের প্লট তৈরি করলো এক সন্ত্রাসী হামলা

মেঘা মজুমদারের সম্ভাবনাময় প্রথম উপন্যাস ‘অ্যা বার্নিং’ সূচনার ইতিহাস একটি বাক্যে উপস্থাপন করা যায়: কলকাতার বস্তিতে বাস করা জীবন নামের এক মুসলিম তরুণীর একটি ফেসবুক পোস্ট। এই তরুণী থেমে থাকা একটি ট্রেনে আগুন দিতে দেখেন। এতে প্রায় ১০০ জন মারা যায়। এ সময় পুলিশ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। জীবন যখন এই কথাটি দুঃখ, কষ্ট নিয়ে (অবশ্য, অনেক লাইক পাওয়ার আশাও করেছিলেন) অনলাইনে প্রকাশ করেন, তখন তিনি জানতেন না যে অপরাধ করার জন্য তাকে গ্রেফতার হতে হবে, তার পোস্টটি প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা হবে।
এটি আধুনিককালের ভারতের কাহিনী। এখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের সমালোচনা করে কিংবা কার্টুন বা মাইম ইত্যাদি সামাজিক মিডিয়ায় পোস্ট করার কারণেও অনেককে গ্রেফতার হতে হয়। পিটিয়ে হত্যা বাড়ছে, আবার মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যমূলক নতুন একটি নাগরিকত্ব আইনও পাস হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হয়েছে। দাঙ্গাবাজেরা অবাধে মসজিদ, মুসলিমদের বাড়িঘর, প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে। হামলাকারীদের সাথে যোগ দেয় পুলিশ। ৫০ জনের বেশি লোক মারা যায়, এদের মধ্যে ৮৫ বছর বয়স্কা এক নারীও ছিলেন। তিনি তার ঘরে জীবন্ত পুড়ে মরেছেন। এ সময় হিন্দু উগ্রবাদীরা তার বাড়ির বাইরে স্লোগান দিচ্ছিল।
মজুমদার তিনটি চরিত্র অনুসরণ করেছেন: জীবন, কারাগারে দিনতিপাত; তার সাবেক শারীরিক শিক্ষা শিক্ষক তথা পিটি স্যার, যিনি স্থানীয় ডানপন্থী রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছিলেন; এবং লাভলি, এক হিজড়া, যিনি খ্যাতিমান হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
পরিচালক আকিরা কুরোসওয়া প্রতিটি দৃশ্য চিত্রায়নে তিনটি ক্যামেরা ব্যবহার করার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। একটি ক্যামেরা তিনি স্থাপন করতেন একেবারেই চিরচেনা পজিশনে। বি ক্যামেরা দিয়ে দ্রুত ছবি তুলতেন। আর সি ক্যামেরাকে তিনি বলতেন গেরিলা ইউনিট। কোনো ডিটেইল যাতে মিস না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্যই তিনি তিনটি ক্যামেরা ব্যবহার করতেন।
মজুমদারও একই কৌশল ব্যবহার করেছেন। তিনিও এক চরিত্র থেকে আরেক চরিত্রে গেছেন। সেদিন কী হয়েছিল, তা কেবল জানতেন জীবন। কিন্তু পিটি স্যারই পুরো ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন তার দলের কাছে এবং সেখানেই জীবনের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়।
আর গেরিলা ইউনিটের লাভলি এই উপন্যাসের সবচেয়ে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা চরিত্র। তিনি প্রচলিত শিক্ষা গ্রহণ না করলেও অভিনয় শেখার জন্য কোর্স করেছেন। তিনি রাস্তার জীবনের শিক্ষার্থী। তিনি যা দেখেন, তা থেকেই শেখেন।
বইটির ডিটেইলের জন্যই বেশ আকর্ষণীয় হয়ে। জীবনের নানা প্রসঙ্গ লেখক বেশ সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। ফলে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেছে বইটি। বর্তমান ভারতের চলমান ইতিহাসই ওঠে এসেছে তার কলমে।
বইতে জীবনের জীবন-কাহিনী চমৎকারভাবে আঁকা হয়েছে। তার এই কঠিন জীবন যেদিন শুরু হলো, অর্থাৎ ওই ট্রেনটি তার দেখা কি তার নিয়তিই ছিল? লেখক এখানেই থেমে থাকেননি, পাশাপাশি নারীবিদ্বেষ, পুলিশের নৃশংসতা, পরিষ্কার পানির কষ্ট, হিজড়া সম্প্রদায়ের কঠিন দারিদ্রতাও ওঠে এসেছে সাবলীলভাবে। মজুমদার সবকিছু বেশ দক্ষ হাতেই চিত্রিত করেছেন।
জীবন নামের তরুণীকে সারা জীবন কাটাতে হয়েছে জীবন সংগ্রাম করেই। তার স্কুলে যাওয়ার পথে পড়ত একটি কসাইয়ের দোকান। ছোট্ট জীবন নিজের কাছেই প্রশ্ন করত, এই ছাগলেরও হয়তো আমার মতোই জীবন আছে। সেও হয়তো তার ভবিষ্যত জানে।
তবে জীবন কোথায় গিয়ে থাকে, তা কেবল ভাগ্যই জানে। এখানে বাছাই করার অবকাশ আছে সামান্যই। উপন্যাসের একেক চরিত্রের একেক ধরনের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টিও প্রাণবন্তভাবে উঠে এসেছে। যেমন পিটি স্যার চান স্বীকৃতি, লাভলি চান তার গরিবি জীবনের অবসান। আর জীবন আনন্দ পান সামাজিক মাধ্যমে। এই পারস্পরিক সম্পর্ক আর টানাপোড়েন নিয়েই এগিয়েছে এই উপন্যাস। আর সেইসাথে নতুন এক শক্তিমান লেখকের আবির্ভাবের কথা বলেছে।