আমরা লাইভে English শনিবার, এপ্রিল ০১, ২০২৩

আমরা আর কাশ্মীরী জনগণকে এড়িয়ে থাকতে পারি না, মনে করিয়ে দিচ্ছে বইটি

সাহবা হোসাইনের কাশ্মীরের সাহস এবং চলমান ভালোবাসা, হারানো ও আকাঙ্ক্ষা ওইসব বই ও প্রবন্ধের ক্রমবর্ধমান তালিকায় যুক্ত হয়, যেখানে তিন দশক ধরে কাশ্মীর ও কাশ্মীরী জনগণের ওর নেমে আসা মৃত্যু ও ধ্বংসের তালিকা করার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে সুসংগঠিত রাজনৈতিক সহিংসতার প্রতি তাদের প্রতিরোধের ওপরও গুরুত্বারোপ করে। এখানে তিনটি সাম্প্রতিক গ্রন্থের কথা উল্লেখ করছি: ‘ডু ইউ রিমেম্বার কুনান পুষ্পরা’ (সম্পাদনায় ইসার বাতুল, নাতাশা রাথার, ইফরা বাট, মুনাজা রাশিদ ও সামরিনা মুশতাক); ‘ইনশাহ মালিকের মুসলিম ওম্যান, এজেন্সি অ্যান্ড রেসিসস্ট্যান্স পলিটিক্স: দি কেস অব কাশ্মীর’; এবং আকতার জিয়ার ‘রেসিস্টিং ডিসঅ্যাপেয়ারেন্স: মিলিটারি অকুপেশন অ্যান্ড ওম্যান্স অ্যাক্টিভিজম ইন কাশ্মীর’।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ডক্টর্স উইদাউট বর্ডার্সের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সহিংসতার প্রভাব নিয়ে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাছাড়া স্থানীয় নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলোও অনেক বিশ্লেষণমূলক তথ্য দিচ্ছে। এসবের কয়েকটির নাম হলো ‘টরচার: ইন্ডিয়ান স্টেটস ইনস্ট্রুমেন্ট অব কন্ট্রোল ইন ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্টার্ড জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর’ (এটি প্রকাশ করেছে এসোসিয়েশন অব প্যারেন্টস অব ডিসঅ্যাপেয়ার্ড পারসন্স), ‘স্ট্রাকচার্স অব ভায়োলেন্স: দি ইন্ডিয়ান স্টেট ইন জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর’ (দি ইন্টারন্যাশনাল পিপলস ট্রাইবুনাল অন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড জাস্টিস ইন ইন্ডিয়া-অ্যাডমিনিস্টার্ড কাশ্মীর অ্যান্ড দি এপিডিজি), ‘অ্যাজিড পারপেট্রাটর্স- স্টেরিস অব ইমপিউনিটি ইন জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর’।

তাছাড়া গত চার বছর ধরে কাশ্মীরীরা যে দুর্ভোগে রয়েছে তার কাহিনীও রয়েছে অনেক।

সহিংসতা আর যন্ত্রণার মুখে হারিয়ে যাচ্ছে লক্ষ্য

হোসাইন তার বইয়ের মাধ্যমে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে ভারতীয়দের চিন্তার বাইরে চ্যালেঞ্চ ছুঁড়ে দেয়ার আরেকটি শক্তিশালী কারণ রয়েছে। তিনি জানিয়েছেন তিনি প্রথমে অক্সফামের হয়ে গবেষণার জন্য বইটি লিখতে শুরু করেছিলেন। পরে আমান ট্রাস্টের হয়ে কাজটি করেন। তিনি সহিংসতার শারীরিক ও মানসিক প্রভাব বোঝার চেষ্টা করেছেন সর্বাত্মকভাবে।

কাশ্মীর সম্পর্কে তার প্রথম যে ধারণাটির সৃষ্টি হয়েছে তা হলো এই যে ভারতের মূলধারার গণমাধ্যম যদিও বলে আসছে যে এটি ভারতের অবিভাজ্য অংশ, কিন্তু তার মনে হয়েছে যে তিনি অধিকৃত কোনো এলাকায় প্রবেশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, তিনি যতই এগিয়েছেন, ততই লোকজন তাকে ঘিরে প্রশ্ন করেছে? কেন তারা তাকে বিশ্বাস করবে?

রাজনীতিবিদদের কাণ্ডজ্ঞান না থাকা

কয়েক বছর ধরে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছেন যে তিনি আগে কখনোই সশস্ত্র সঙ্ঘাত জোনে কাজ করেননি। তার মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে, যে দেশটি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে দাবি করে থাকে, তারা কেন তাদের নিজের লোকজনের প্রতি এমন নৃশংস আচরণ করে? সাম্যের চেতনা কোথায় – সে প্রশ্নও তার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি কেবল কাশ্মীরী মুসলিম বা কাশ্মীরী নারীদের নিয়েই থেমে থাকেননি। তিনি জম্মুতে গিয়ে কাশ্মীরী পণ্ডিতদের সাথেও কথা বলেছেন। তিনি সেখানে গিয়ে ভিন্ন পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন।

হোসাইন কাশ্মীরী পণ্ডিতদের দুর্দশা, হতাশা, ক্রোধের কথাও লিখেছেন। তিনি অবশ্য কাশ্মীর পণ্ডিত ও মুসলিমদের মধ্যকার বক্তব্যে বিপুল পার্থক্য দেখতে পেয়েছেন।

তবে রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের বেশির ভাগই কাশ্মীরী মুসলিম ও কাশ্মীরী পণ্ডিতদের মধ্যে যে পার্থক্য আছে তার আসল সুরটি ধরতে পারেন না।

কেউ রেহাই পায়নি

হোসাইনের গ্রন্থের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয় হলো এখানে জঙ্গি এবং বিশেষ করে আরো বড় পরিসরে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে কাশ্মীরীদের সহিংস দুর্ভোগের পরিণাম বিস্তারিতভাবে দেয়া হয়েছে। এটিই আজকের দিনে খুব বেশি প্রয়োজনীয়। গত ৩০ বছর ধরে কাশ্মীরীরা ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিতদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই তারা প্রতিনিয়ত বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। হোসাইন ওইসব নারীদের সাথে সাক্ষাত করেছেন যাদের পুরুষেরা গুমের শিকার হয়েছে। এসব নারীদের কেউ মা, কেউ স্ত্রী। তাদের মধ্যে আশা আছে, আবার নিরাশাও ভর করে। তবে হতাশাই বেশি। কারণ গত তিন দশকে নিরাপত্তা বাহিনী যাদের তুলে নিয়ে গেছে, তাদের মধ্যে খুব কমই বাড়ি ফিরে এসেছে।

তবে সামরিক বাহিনীর অবৈধ ব্যবস্থা ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের প্রতি নারীদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার নানা উপায়ের বর্ণনা দিয়েছেন। তারা তাদের বাড়ি ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হয়েছেন, রাস্তায় নেমেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, পাথর নিক্ষেপ করেছেন। আর সবই করেছেন পুরুষদের রক্ষা করার জন্য। তারা না চাইলেও বদলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তারা সংগ্রামের মাধ্যমেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে। তারা আর ভারতীয় রাষ্ট্র ও ভারতীয় রাষ্ট্রের মধ্যে আর কিছু করতে চায় না।

তাছাড়া এসব নারী ও কাশ্মীরীরা আর মধ্যস্ততাকারী চায় না। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর সমঝোতার রাস্তা শেষ হয়ে গেছে বলেই তারা মনে করছে।

সব মিলিয়ে যারাই সাহবা হোসাইনের ‘লাভ, লস অ্যান্ড লঙ্গিংস ইন কাশ্মীর’ গ্রন্থটি পড়বেন, তারাই আত্মনিবিষ্ট হওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানবে। তারা এর রাজনৈতিক সীমার বিষয়টিও স্বীকার করে নেবে। এই বইটি লিখে হোসাইন আমাদের জন্য অনেক বড় কাজ করেছেন। এখন আমাদের প্রয়োজন বইটি পড়া এবং এর উদ্বেগ আর মূল্যায়নগুলো আরো বড় আকারে উত্থাপন করা।