আত্মহননের পর্যায়ে চলে গেছে বাংলাদেশের আর্থিক খাত

শেয়ার বাজার ধসের খবর শুনে একজন ৫২ বছর বয়সী ইন্সুরেন্স নির্বাহী তার ১৩ তলা অফিসের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এই ঘটনাটি বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির একটা প্রতীকী চিত্র।
গত দশ বছরের মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। বহু ব্যবসায়ীর পুঁজি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এখন রাস্তায় বিক্ষোভে নেমেছেন। কিন্তু পরিস্থিতির আসলে অবনতি হচ্ছে বহু দিন ধরে।
পুঁজি বাজার ধসের খবর এমন সময় আসলো যখন আরেকটি চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, পি কে হালদার নামের এক ব্যক্তি আক্ষরিক অর্থে বহু বিলিয়ন টাকা নিয়ে কানাডায় পালিয়ে গেছেন। তার কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো ছিল সিস্টেমেটিক এবং সুপরিকল্পিত এবং গুরুত্বপূর্ণ অ-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বহু প্রতিষ্ঠান এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মনে হচ্ছে, হালদার এমনভাবে তার প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে যে, কোন রাষ্ট্রীয় রেগুলেটরি সংস্থা থেকেই তাকে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি। এ কারণে অনেকেই অনুমান করছেন, এটা সম্ভবত ভেতরের মানুষদের কাজ।
দুর্নীতি এখন এতটা ছড়িয়ে পড়েছে যে, এমনকি আমলাতন্ত্রের নিচের দিকের ছোট খোটো অপরাধীরাও মিলিয়নিয়ার হয়ে গেছে। সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধকে এখন আর অপরাধ জ্ঞান করা হয় না, কারণ এটা এখন উন্মুক্ত এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। অধিকাংশ মানুষ এখন এ সব করছে, যেগুলোর ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পুরোপুরি অবগত।
মাদক অর্থনীতির আকার অনেক বড় এবং শক্তিধর ও শক্তিহীন সব স্তর থেকেই বহু মানুষ এতে যুক্ত রয়েছে। কেউ কেউ এমনকি মনে করেন যে, এই খাতটি প্রাতিষ্ঠানিক অন্য যে কোন খাতের চেয়েও বড়।
মনে হচ্ছে যে, আর্থিক খাতের অভিভাব যে বাংলাদেশ ব্যাংক, তারা বর্তমানে বিদ্যমান জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। এ কারণেই, রাজনৈতিকভাবে সফল একটা সরকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তেমন ভালো করতে পারছে না।
সমস্যার একটা দিক হলো বাজার
সঙ্কটের কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা নিজেরাই বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, উচ্চ সুদের হার, যেটাকে ব্যবসায়ী লবি উচ্চ ঋণ খেলাপি বা অলস ঋণের প্রধান কারণ হিসেবে দাবি করছেন। বর্তমানে, সুদের হার দুই অঙ্কের কোঠায় রয়েছে এবং এটাকে ৯ শতাংশে নিয়ে আসার জন্য সরকার চাপ দিচ্ছে। ব্যাংকগুলো এটা প্রতিহত করে এসেছে কিন্তু এখন এই হার কমানো এড়িয়ে যাওয়াটা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি আশা করেছিলেন যে ব্যাংকগুলো তার কথা শুনবে। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ব্যাংকিং খাত সামগ্রিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী এবং অতি ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রীর সাথেও তারা দর কষাকষি করতে পারে।
প্রধান রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংককে (বিবি) সাধারণত দুর্বল ও অদক্ষ হিসেবে দেখা হয়, যারা বড় বড় প্রাইভেট খাতের খেলোয়াড়দের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারে না, যাদের সাথে এমনকি রাজনৈতিক যোগসাজশও রয়েছে। এর ফল হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনার সক্ষমতার ব্যাপারে সাধারণভাবে আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে এবং এই আত্মবিশ্বাসের ঘাটতির কারণে সেটা শেয়ার বাজারের উপরও প্রভাব ফেলছে।
মূলত লুটপাটের কারণে কিছু বড় বড় ব্যাংক ধসে পড়েছে। একটি ক্ষেত্রে ব্যাংকের নাম বদলানো হয়েছে – ফার্মার্স ব্যাংককে পদ্মা ব্যাংক করা হয়েছে এবং পুণরায় কাজ শুরু করা হয়েছে। আরও কয়েকটি ব্যাংক এ রকম পরিস্থিতিতে পড়ার আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু, ঋণ পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, পুরো খাত বড় ধরনের তারল্য সঙ্কটে পড়ে গেছে।
ব্যাংকগুলো ঋণ খেলাপিদের জন্য বড় ধরনের ছাড় দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যেটা শুধু টিকে থাকার কৌশল মাত্র। কিন্তু এই খাতের ভালো অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা এই মুহূর্তে খুব একটা উজ্জ্বল দেখা যাচ্ছে না।
বিনিয়োগকারীদের কি হবে?
সুদের হারের অবনতির অর্থ হলো অবশ্যই ফিক্সড ডিপোজিট সুদের হারও কমবে এবং সেটা বহু ক্ষুদ্র ও মাঝারি আয়ের পুঁজি বিনিয়োগকারীর উপর প্রভাব ফেলবে, যাদের কাছে নিরাপদে বিনিয়োগ করার উপায় প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এটা যদি বর্তমানের ৮% থেকে কমে ৬% হয়, তাহলে তারা দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্তমানে, সুদের হার হ্রাস এবং করের কারণে তারা সরকারের বণ্ড থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। ব্যাংকের অবস্থা যদি এখন দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে তাদের যাওয়ার জায়গা আরও কমে যাবে।
এই ধারাটির প্রতিফলন ঘটেছে অন্যান্য সূচকের সাথে সাথে স্বর্ণের দামের উপরও যেটা সম্প্রতি নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে, কারণ আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজি সংরক্ষণের জায়গা থেকে মনোযোগ এখন প্রথাগত ‘আওয়াতের’ দিকে সরে যাচ্ছে। এনবিএফআই সম্ভবত কখনও ভালো অবস্থায় ফিরতে পারবে না। সে কারণে, শক্তি প্রয়োগ করা না হলে সেভিংসের অবস্থার আরও বড় ধরনের অবনতি হবে।
উচ্চ প্রবৃদ্ধির সাথে উচ্চ উদ্বেগ
বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও অনেক খাতেই সমস্যার বোঝা বেড়ে চলেছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে, এই ধরনের দাবিগুলো ঔজ্জ্বলতা হারাতে শুরু করেছে। সরকার যদিও দাবি করছে যে, এখন সর্বকালের মধ্যে সবচেয়ে ভালো এবং সর্বসাধারণের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রবৃদ্ধির হার এখন বজায় রয়েছে, কিন্তু মিডিয়াতে উল্টা ঘটনার খবর প্রকাশিত হচ্ছে, যেখানে প্রতিদিন আর্থিক খাতের সমস্যার চিত্র উঠে আসছে।
সরকারের রাজস্ব সংগ্রহের দুর্বলতাও একটা সমস্যা, যে কারণে সরকারকে বাধ্য হয়ে বাজার থেকে ধার করতে হচ্ছে, এবং এখন এটাকে একটা বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। গ্রামীণফোনের সাথে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বের বিষয়টি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদেরকে আতঙ্কিত করেছে। একমাত্র যে খাতটি এখনও সচল রয়েছে, সেটা হলো রেমিটেন্স খাত, এবং এখানে সরকারের আসলে ক্রেডিট দাবি করার কিছু নেই।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি হযবরল হয়ে আছে। এর সমস্যা লুকিয়ে আছে আর্থিক সুশাসনের দুর্বলতার মধ্যে। তবে সেটা ব্যবস্থাপনা করার পর্যায় পার হয়ে গেছে কি না, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।