পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য বস্ত্র খাতের সম্প্রসারণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ

পাকিস্তানের সুতি বস্ত্র শিল্প দেশের বৃহত্তম ম্যানুফেকচারিং খাত। এটি পাকিস্তানের জিডিপির ৮.৫ ভাগ, এখানে দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৫ ভাগ নিয়োজিত এবং শিল্পশ্রমিকের ৩৮ ভাগ কর্মরত।
তুলা উৎপাদনে পাকিস্তান বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম। চীন ও ভারতের পর পাকিস্তান হলো তৃতীয় বৃহত্তম সুতা উৎপাদনকারী দেশ। বৈশ্বিক স্পিনিং ক্যাপাসিটির ৫ ভাগ পাকিস্তানের। বর্তমানে ১,২২১টি জিনিং ইউনিট, ৪৪২টি স্পিনিং ইউনিট, ১২৪টি বৃহৎ স্পিনিং ইউনিট ও ৪২৫টি ছোট ইউনিট সুতি বস্ত্র উৎপাদন করছে।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে চীনের রফতানি সাময়িকভাবে (তারা বিশ্বের বৃহত্তম বস্ত্র রফতানিকারক) বন্ধ থাকায় পাকিস্তান বস্ত্র খাত আরো বেশি রফতানির অর্ডার পেয়েছে। তৈরী পণ্যের রফতানি বেড়েছে, তবে সুতাসহ কাঁচামালের রফতানি কমছে। পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য এটি ইতিবাচক ঘটনা।
আরও পড়ুনঃ পারমাণবিক দক্ষতা থেকে পাকিস্তানের আয় ৭.৪ বিলিয়ন ডলার
চলতি অর্থবছরে (জুলাই, ২০১৯-জুন, ২০২০) সময়কালের জন্য সুতি বস্ত্র রফতানির টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৪-২৫ বিলিয়ন ডলার। তা অর্জিত হয়েছে। অবশ্য করোনাভাইরাসের লকডাউন পাকিস্তানকে ভয়াবহভাবে আঘাত হেনেছে। বেশ কিছু অর্ডার বাতিল করা হয়েছে বা শিপমেন্ট স্থগিত করা হয়েছে।
আবার কাপড়ের দোকান বন্ধ থাকায় অভ্যন্তরীণ বস্ত্র সরবরাহ শৃঙ্খল পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। ফলে হাজার হাজার কারখানাশ্রমিকের চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
মার্চে পাকিস্তানের বস্ত্র রফতানি ৪.৪৬ ভাগ হ্রাস পায়। মার্চে দেশের বস্ত্র রফতানি দাঁড়ায় ১.০৩৯ বিরিয়ন ডলারে, গত বছরের একই সময় তা ছিল ১.০৮৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এর বিপরীতে পাকিস্তানের বস্ত্র ও পোশাক রফতানি গত বছরের ফেব্রুয়ারির বিপরীতে বেড়েছে প্রায় ১৭ ভাগ।
পাকিস্তানের বস্ত্রনীতি ঘোষণা করা হয় গত জানুয়ারিতে। এতে বস্ত্র রফতানি চাঙ্গা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে ১. তুলার উৎপাদন বাড়িযে তুলা চাষিদের লাভ বাড়ানো; ২. হাতে তৈরী খাতটিকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়া; ৩. আগামী ৫ বছরের জন্য আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার আলোকে জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করা; ৪. সেলস ট্যাক্স রিফান্ড ব্যবস্থা জোরদার করা এবং ৫. টেক্সটাইল ক্লাস্টার ও এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন প্রতিষ্ঠা।
করোনাভাইরাসের আগেকার অবস্থাটি প্রতিফলিত হয়েছিল এই খসড়া নীতিতে। এখন নতুন পরিস্থিতিতে অবিলম্বে সংশোধিত বা নতুন নীতি প্রণয়ন করতেই হবে। এমনকি লকডাউন তুলে নেয়া হলেও অর্থনীতি চাঙ্গা হতে সময় লাগবে। এই মহামারির আসন্ন ও সরাসরি প্রভাব হবে দীর্ঘ মেয়াদি। মন্দা এক বছর বা তারও বেশি সময় স্থায়ী হতে পারে।
লকডাউন যত বাড়বে, অর্থনীতির ওপর অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী সমস্যাগুলো তত বাড়বে। পুনরুদ্ধার তত বেশি মন্থর হবে। তাছাড়া বৈশ্বিক চাহিদা ও ভোক্তা অবশ্যই কমবে।
বস্ত্র খাত চাঙ্গা হওয়ার জন্য সহায়ত প্রয়োজন। এটি ম্যানুফেকচারিং খাতের সবচেয়ে বেশি শ্রমিক এখানে নিয়োজিত থাকে বলে একে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
বস্ত্র খাতের লকডাউন প্রত্যাহার করার ঝুঁকি আমাদের নিতে হবে। বস্ত্র খাতের জন্য একটি রিলিফ প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে। নগদ অর্থের সমস্যা কাটানোর জন্য যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের ত্রাণ প্যাকেজের ঘোষণা দেয়া হয়েছে তার আলোকে গ্রহণ করতে হবে। বন্ধের সময় যেসব শ্রমিকের বেতন দেয়া হয়নি বা আংশিক দেয়া হয়েছিল, সরকার তাদের অর্থ পরিশোধ করতে পারে। কর ছাড়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
পাকিস্তানের ব্যাংকগুলো বেশ মুনাফা করে। তাদের উচিত হবে লকডাউনের পর শিল্পগুলো আবার যাতে সাবলীলভাবে কাজ করতে পারে তাতে উৎসাহ যোগানো। তারা ঋণের সুদ ছাড় দিতে পারে বা অন্তত সুদের হার কমাতে পারে।
আরও পড়ুনঃ পাকিস্তানে সিপিইসির ৭.২ বিলিয়ন ডলারের রেল প্রকল্প অনুমোদন
পাকিস্তানে যে পরিমাণ ও মানের সুতা উৎপাদিত হয়, তা দিয়ে বস্ত্র রফতানি চাঙ্গা করা সম্ভব নয়। ২০২০ সালের জন্য ১৫ মিলিয়ন বেল তুলার দরকার। কিন্তু স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হতে পারে এর মাত্র অর্ধেক। এর মানে হলো, তুলা উৎপাদনের ক্ষেত্র বাড়াতে হবে এবং বা মান উন্নত করতে হবে বা উভয়টিই করতে হবে। অন্যান্য দেশের একরপ্রতি উৎপাদনের তুলনায় পাকিস্তানে উৎপাদন অনেক কম। তাছাড়া পাকিস্তানের সুতার মান বাড়াতে হবে দ্রুততার সাথে।
পাকিস্তান সরকারের বস্ত্র বিভাগের ওয়েবপেইজে ঘোষণা করা হয়েছে যে পাকিস্তানের বস্ত্র খাতের দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপর বিপুল প্রভাব রাখে। দেশের রফাতনির ৬০ ভাগ অবদান এই খাতের। বর্তমানের উচ্চ প্রতিযোগিতামূলক বৈশ্বিক পরিবেশে বস্ত্র খাতের প্রয়োজন তার সাপ্লাই চেইন আধুনিক করা, উৎপাদনশীলতা বাড়ানো।
তাদের এসব আশাবাদ বাস্তবায়িত হওয়া প্রয়োজন। ভালো পরিকল্পনা সফল হওয়া নির্ভর করে এর বাস্তবায়নের ওপর।
আমরা এসব খাতের ওপর লকডাউন আরোপ করতে পারি কেবল আমাদের অস্তিত্বের বিনিময়ে। রফতানির সাপ্লাই চেইনের বিঘ্নতা বিপর্যয়কর হবে। অর্থনীতির মূলধারাকে চলতে দেয়ার জন্য হিসাবি ঝুঁকি নিতেই হবে।
লেখক: ইকরাম সেহগাল প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক, আর ড. বেত্তিনা রোবোটতা সাবেক অধ্যাপক, সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, হামবোল্ডট ইউনিভার্সিটি, বার্লিন