আমরা লাইভে English মঙ্গলবার, জুন ০৬, ২০২৩

দ্রুত বিশ্বাস হারাচ্ছে বাংলাদেশের আর্থিক খাত

বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাস্থ্য অব্যাহতভাবে খারাপ হতে থাকায় তা রোধ করার সরকারি পদক্ষেপগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, নিম্ন যোগ্যতা ও রাজনৈাতিক প্রভাবের কথা বলছেন।

এর ফল হলো সঞ্চয়কারীদের মধ্যে উদ্বেগ বৃদ্ধি, বাজে কর্ম সম্পাদন দক্ষতা ও খাত ব্যবস্থাপকদের দায়মুক্তি। এতে করে সার্বিকভাবে খাতটির আস্থার মারাত্মক অভাব সৃষ্টি হচ্ছে।

ভয়াবহ সব দুর্নীতি হয় পরিকল্পিতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে কিংবা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

ক্রমবর্ধমান চাপ ও জনসাধারণের বিরূপ মনোভাবের মুখে সরকার ঘোষণা করেছে যে বিষয়গুলো ঠিক করতে একটি কমিটি গঠন করা হবে। শীর্ষ বিশেষজ্ঞরা একে সমর্থন করলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন যে কমিটিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিলে তারা কিছুই করতে পারবে না।

সমালোচকদের সমালোচনা

বাংলাদেশের সবচেয়ে শ্রদ্ধাভাজন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সরকারের এ ধরনের অনেক নীতির প্রতি কঠোর সমালোচনা করেছে। জবাবে সরকার অভিযোগ করেছে যে সিপিডি বিরোধী দলের ঘনিষ্ঠ। তবে সিপিডি যেহেতু রাজনৈতিক না হয়ে টেকটিক্যাল সংস্থা এবং তাদের উচ্চ মর্যাদা ও দৃশ্যগ্রাহ্যতা রয়েছে, তাই বেশির ভাগ লোক বেশির ভাগ সরকারি মুখপাত্রের চেয়ে তাদের কথাতেই বেশি আস্থা রাখছে।

এ কারণেই ব্যাংকিং খাতের একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আর্থিক খাতকে জিম্মি করে রেখেছে বলে সিপিডি সম্প্রতি যে বক্তব্য দিয়েছে তা অর্থমন্ত্রীর নিজেকে বিশ্বের সেরা অর্থমন্ত্রী বলে যে দাবি করেছেন তার চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছে। 

সিপিডির ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন যে আট বছর আগে খাতটি নাড়িয়ে একটি বড় কেলেঙ্কারির সময়ই (ওই সময় হলকার্ম কেলেঙ্কারি ঘটে এতে সরকারি খাতের সোনালী ব্যাংক জড়িত ছিল) সংগঠনটি এ ধরনের কমিশন গঠন করতে বলেছিল। ওই সময়ে তখনকার অর্থমন্ত্রীর একটি বক্তব্য বিখ্যাত হয়ে আছে। তিনি এই কেলেঙ্কারিকে ‘অতি সামান্য’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তিনি তদারকির কমিটি গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

১৯৮০-এর দশকে বিকশিত হওয়ার পর থেকে ব্যাংকিং খাতকে নজরদারির বাইরেই রাখা হয়েছে। একটার পর একটা কেলেঙ্কারি খাতটিকে আঘাত হেনেছে, সংখ্যাটি গুণে শেষ করার মতো নয়। বর্তমানে সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, প্রায় সব ব্যাংকই মারাত্মক তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। অনেক ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধসে পড়ার মুখে রয়েছে।

চুরি, প্রভাব ও কানেকশন

দুটি ঘটনা বলা যেতে পারে: একটি হলো ফার্মাস ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়া এবং এরপর পদ্মা ব্যাংক হিসেবে এর পুনর্জন্ম। এটির মালিক ছিলেন ওই সময়ের শক্তিশালী মন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর। ব্যাংকটি সাধারণ সঞ্চয়কারীদের কোটি কোটি টাকা লোপাট করে, সরকারি সঞ্চয়ের কথা না হয় নাই বললাম। তারপর নাম আসে জনৈক মো. এহসান খসরু। অনেকে বলেন, তিনি ক্ষমতাসীন মহলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।

এদিকে পিপলস লিজিং নামের একটি নন ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান অনেকের বিনিয়োগ লোপাট করে। বস্তুত, বেশির ভাগ লিজিং কোম্পানির স্বাস্থ্যই ভয়াবহ রকমের খারাপ। বেশির ভাগ আর্থিক পর্যবেক্ষক মনে করেন যে প্রভাবভিত্তিক লাইসেন্সব্যবস্থাই এই সঙ্কটের জন্য দায়ী।

সরকার যদিও বলছে যে সে কোনো ধরনের অব্যবস্থাপনা সহ্য করবে না, কিন্তু তারা বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক খাতের কার্যক্রম তদারকি করার সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারছে না। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করছে, জনসাধারণের কোনোই আস্থা নেই এগুলোর ওপর।

সরকার কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য নতুন একটি লিজিং কোম্পানিকে অনুমোদন দিয়েছে। পুনর্গঠিত পদ্মা ব্যাংকের মালিকেরাই এই কোম্পানির মালিক। স্পন্সরেরা বলছেন যে তারা অন্যদের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছে। কিন্তু এমন প্রবল অনাস্থা ও উদ্বেগের সময় এটি চালু হচ্ছে যখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের সূচকগুলোর চেয়ে প্রভাবই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হচ্ছে।

অরাজকতায় আর্থিক খাত

আর্থিক খাতে বিরাজ করছে এক ধরনের অরাজকতা। এখানে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা দায়মুক্তি নিয়ে যা খুশি করতে পারে। হালদারের মামলাটি একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে। এই ব্যবসায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিক কোম্পানি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে ৩৫০ টাকা চুরি করে কানাডায় চলে গেছে। খুব কম লোকই বিশ্বাস করে যে তাকে পাকড়াও করা হবে কিংবা ওই অর্থ ফেরত আনা হবে।

এদিকে হাইকোর্ট সন্দেহভাজন হিসেবে আইএলসির পরিচালকদের পাসপোর্ট জব্দ করার নির্দেশ দিযেছে। সিনিয়র ব্যাংকার ইব্রাহিম খালিদ বোর্ডের নিরপেক্ষ চেয়ারপারসন নিযুক্ত হয়েছেন।

আবারো দুর্বল বা ধসে পড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূত করার বিষযটি আলোচনায় এসেছে। এদিকে সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার হ্রাস করা ও জমার সীমা কমিয়ে দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত বিনিয়োগের নিরাপদ স্থান সন্ধানকারী মূখ্য সঞ্চয়কারীদের অর্থাৎ নিম্ন আয়ের গ্রুপকে আঘাত করেছে।

অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ব্যাংকের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার লক্ষ্যেই এমনটা করা হয়েছে। কিন্তু যেভাবে তা করা হয়েছে তা মধ্যবিত্ত ও গরিব শ্রেণিকে আঘাত করেছে। দৃশ্যত, অজনপ্রিয় হওয়ার কারণেই হার এখন পুনঃবিবেচনা করা হচ্ছে।

ধনীরা, তাদের অনেকেই অর্থ পাচারকারী ও ঋণ খেলাপি, নিরাপত্তার জন্য কোনো চাপ অনুভব করে না, যদি না তারা হালদারের মতো মারত্মক অপরাধ করে। কিন্তু তারপরও তারা নিরাপদে পালিয়ে যেতে পারে। বেশির ভাগই বিদেশে অর্থ পাচার করে নানা স্থানে নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তুলেছে। কিন্তু বেশির ভাগ নিম্ন আয়ের সঞ্চয়কারীর ক্ষেত্রে সরকার দৃশ্যত তাদের বিকল্প ও নিরাপত্তা হ্রাস করে যন্ত্রণাদগ্ধ করছে।

গরীব মানুষে দেশে ধনীবান্ধব আর্থিক ব্যবস্থাপকেরা কাঠামোগত সঙ্ঘাত সৃষ্টি করেছেন, যা আর্থিক খাতের স্বাস্থ্য ফেরানোর ক্ষেত্রে একটি প্রধান বাধায় পরিণত হতে পারে।