যেভাবে রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনছে সিন্ধের পুলিশ

সিন্ধের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) ড. সাইয়েদ কলিম ইমাম রাজ্যের পুলিশ কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নিয়েছেন। জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য প্রদেশের মানুষের কাছে আরও ভালো সেবা পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তদন্ত, অর্থায়ন ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক স্কুল চালু ছাড়াও তিনি লব্ধ জ্ঞান ও প্রদেশের মানুষের সাথে বিনিময়ের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বেশ কিছু কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন।
একটা নতুন বিষয় হলো বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে মতবিনিময়ের একটি সেশান, যেটার নাম দেয়া হয়েছে ‘অ্যান আওয়ার উইথ অ্যা গেস্ট’।
এ পর্যন্ত করাচির সিন্ধের সেন্ট্রাল পুলিশ অফিসে এ পর্যন্ত সমাজের বিভিন্ন অংশের ৩১ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এইসব অতিথিদের মধ্যে ছিলেন এয়ার চিফ মার্শাল উসাতুল্লাহ খান, আনোয়ার মাকসুদ, বুশরা আনসারী, তারিক খোসা, এবং হাসান আব্বাস।
এক ঘন্টার সেশানের মধ্যে আধা ঘন্টা নিজের জীবন, ধারণা ও অর্জন নিয়ে কথা বলেন অতিথি। ২৫ মিনিটের প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশগ্রহণকারীরা তার অভিজ্ঞতার বিষয়ে প্রশ্ন করেন।
এই অধিবেশনগুলোতে প্রায় ৫০ জন বিভিন্ন র্যাঙ্কের পুলিশ কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। চাতাম হাউস নীতিমালার অধীনে তারা এই উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন।
২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি এই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যাওয়ার সম্মান পেয়েছিলাম আমি। আইজিপি এবং সিন্ধ পুলিশের অন্যান্য সিনিয়র কর্মকর্তারা আমাকে স্বাগত জানান। আইজিপি আমাদের উপস্থিত অংশগ্রহণকারীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আমার আলোচনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালনকালীন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করি। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের পাকিস্তান ও ভারতের যুদ্ধকালীন সময়টার ব্যাপারে বেশি মনোযোগ ছিল। ইন্ডিয়ান প্রিজনার অব ওয়্যার ক্যাম্প থেকে আমার পালানোর বিষয়টি দর্শকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণের বিষয় ছিল, কারণ সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি ছিল মারাত্মক চ্যালেঞ্জের।
এর পরই আমি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সামনে আগামীতে কি চ্যালেঞ্জ রয়েছে তার একটা সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করি এবং পাকিস্তানে ‘হাইব্রিড ওয়্যারফেয়ারের’ উন্নয়নশীল ক্ষেত্র সম্পর্ক আলোচনা করি।
পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বিশেষভাবে প্রয়োজন। তাদেরকে সাইবার অপরাধ ও সোশাল মিডিয়া অঙ্গনে ভবিষ্যতে পুলিশের চ্যালেঞ্জগুলোর জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ঘন্টাব্যাপী আলোচনার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে আমার ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যু – সব বিষয়েই প্রশ্ন করা হয়।
ড. সাইয়েদ কলিম ইমামের গতিশীল নেতৃত্বে সিন্ধের পুলিশ যে অর্জন করেছে, সেটার স্বীকৃতি জানিয়ে করাচি মেট্রোপলিটন এলাকা – যেখানে একসময় সন্ত্রাস আর রক্তপাতের ছড়াছড়ি ছিল – সেখানে শান্তি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আমি সিন্ধু পুলিশ নেতৃবৃন্দের অব্যাহত প্রচেষ্টার সাধুবাদ জানায়।
পুলিম, রেঞ্জার্স ও নিরাপত্তা বাহিনীসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জওয়ানরা যে রক্ত ঢেলেছে এবং আত্মত্যাগ করেছে, সেটার বিনিময়েই এই নগরীতে আবার আলো ফিরে এসেছে। এই প্রদেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে গিয়ে প্রায় ২৩০০ জওয়ান ও কর্মকর্তাকে জীবন দিতে হয়েছে।
সিন্ধের মানুষের এবং বিশেষ করে করাচির মানুষের বিশেষ ঋণ রয়েছে এই সব শহীদদের মা, বাবা, বিধবা স্ত্রী, ছেল ও মেয়েদের কাছে, যারা বিরাট আত্মত্যাগ করেছে।
সিন্ধ পুলিশের কঠোর পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের মানসিকতার ব্যক্তিগত উদাহরণ হিসেবে আমি ক্যাপ্টেন পারভেজ মালিকের লেখা ‘ফার অ্যাবাভ দ্য কল অব ডিউটি’ নিবন্ধ থেকে এখানে কিছুটা উদ্ধৃত করছি:
“২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে আমার প্রাইভেট নিরাপত্তা সার্ভিস কোম্পানি ওয়াকেনহাট প্রাইভেট লিমিটেডের একটা সাঁজোয়া ক্যাশ-ইন-ট্রানজিট (সিআইটি) যানবাহন করাচির সামিট ব্যাঙ্কের ইউসুফ প্লাজা শাখার বাইরে অর্থ সংগ্রহের জন্য পার্ক করা ছিল। নিরাপত্তা গার্ড গুলাম আব্বাস ও যানবাহনের কমাণ্ডার মোহাম্মদ নাজির ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়ে বেরিয়ে এসে সেগুলো গাড়িতে রাখেন। গাড়ির দরজা যখন তারা বন্ধ করতে যাবেন, তখন তিন অস্ত্রধারী ব্যক্তি বেপরোয়া গুলি ছুড়তে শুরু করে। এই বন্ধুকযুদ্ধে গোলাম আব্বাসের গায়ে তিনটি গুলি লাগে এবং কমাণ্ডার নাজিরের কাঁধে একটি গুলি লাগে। মোহাম্মদ নাজির তার গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেও পাল্টা গুলি ছুড়তে শুরু করেন এবং যানবাহনের ভেতর থেকে হামলাকারীদের উপর গুলি ছুড়তে থাকেন। তার পেশাদারিত্ব ও প্রশিক্ষণের ফলস্বরূপ হামলাকারীর পেটে গুলি লাগে। এই যুদ্ধের পর হামলাকারীরা একটি ক্যাশব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, যেটা যানবাহনের ভল্টে রাখা হচ্ছিল। এখানে যানবাহনের ক্রুদের প্রশংসা করতে হবে। শুরু থেকেই হামলাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল সবাইকে হত্যা করে যতগুলো সম্ভব টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু ক্রুদের পক্ষ থেকে এই প্রতিরোধ বা মানসিকতা তারা আশা করেনি। পাল্টা প্রতিরোধের কারণে হামলাকারীরা তাদের জঘন্য কাজ পুরোপুরি করতে পারেনি। নাজির প্রতিরোধ গড়ে তোলায় যানবাহনের ভেতরের অন্যান্য ক্যাশ ব্যাগগুলো তারা নিতে পারেনি”।
“সিআইটি ড্রাইভার দুজন গার্ডকেই তাৎক্ষণিক উত্তর নাজিমাবাদের জিয়া উদ্দিন হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসার পর নাজিরকে ওইদিনই ছেড়ে দেয়া হয়। তিনটি গুলি বিদ্ধ হয়ে গুলাম আব্বাসকে হাসপাতালে জীবনের জন্য লড়তে হয়। তিন ঘন্টা ধরে বড় ধরণের অপারেশন করা হয় এবং এরপর তাকে আইসিইউতে পাঠানো হয়। এই আহত গার্ডের জন্য তার কোম্পানির সহকর্মীরা সেদিন ৫৫ বোতল রক্ত দিয়েছিল”।
করাচি ছিল বিশ্বের ষষ্ঠ বিপজ্জনক শহর। এই শহরে সফর এড়িয়ে চলার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের নাগরিকদের জন্য নির্দেশনা দিতো। এখন পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টার মাধ্যমে ২০২০ সালে বিশ্বের বিপজ্জনক শহরের তালিকায় করাচি ৯৩তম অবস্থানে উঠে এসেছে। এমনকি ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লীর চেয়েও এগিয়ে গেছে তারা।
সিন্ধের আইজিপি আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে, এই মেগাশহরে শান্তি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তাদের দৃঢ়তা আরও বেড়ে গেছে এই বিশ্বাসের কারণে যে, সিন্ধ পুলিশ তাদের পেশাদারিত্ব, দায়বদ্ধতা এবং সহনশীলতার মাধ্যমে বিস্ময়কর অর্জন করতে সক্ষম।
সিন্ধু পুলিশ আমাকে যে স্মারক উপহার দেয়, সেটার জন্য কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি এই অনন্য ফোরামে পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলার সুযোগ দেয়ার জন্য আমি সাইয়েদ কলিম ইমামকে ধন্যবাদ জানাই। আমার কাছে সবচেয়ে মর্যাদার মুহূর্ত হলো নতুন নির্মিত ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে’ শ্রদ্ধা জানানো। স্মৃতিস্তম্ভটি সেন্ট্রাল পুলিশ অফিসে নির্মিত একটি দেয়াল যেখানে সকল শহীদের নাম খোদাই করা আছে।
লেখক একজন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক