বাংলাদেশে সাবেক সেনা কর্মকর্তা হত্যা এনকাউন্টারের বাইরেও অনেক কিছু প্রকাশ করে দিয়েছে

কক্সবাজার পুলিশের একটি অংশ মেজর (অব.) সিনহাকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার পর এনকাউন্টারে হত্যাকাণ্ডের বাস্তবতাটি এমনভাবে সামনে উঠে এসেছে, যেটা কেউ আশা করেনি। এখানে হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তি অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা হওয়ায় সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। হত্যাকারীরা সবাই গ্রেফতার হয়েছে, যেটা অস্বাভাবিক আর বিষয়টা এখন জাতীয় ক্ষোভের বিষয় হয়ে উঠেছে।
অপরাধীদেরকে যখন বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়, মানুষ তখন আর প্রতিবাদ করে না বা সেটা নিয়ে মাথাও ঘামাতে চায় না। এটা ধরেই নেয়া হয়েছে যে, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটবে। কিন্তু এবার, হত্যার শিকার ব্যক্তির পরিচয় একটা বড় পার্থক্য নিয়ে এসেছে। একটা ট্রাজিক ঘটনার মধ্য দিয়ে একটা সহিংস সংস্কৃতি এখানে প্রকাশিত হয়েছে, যেটা নিয়ে সবাই প্রতিবাদ করলেও সেটা বাধাহীনভাবেই এতদিন চলে এসেছে।
দীর্ঘদিনের সঙ্কট
টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস এখন বাংলাদেশের ক্রসফায়ার হত্যার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। এই ওসি আর তার টিম এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ মানুষকে এভাবে হত্যা করেছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে উচ্চ অপরাধপ্রবণ এলাকায় এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আসার পর তিনি যদি নিজেকে আইনের উর্ধ্বে ভাবতে শুরু করেন, তাহলে তাকে এ জন্য ক্ষমা করে দেয়া যায়। কারণ, অনেক অভিযোগের পরও তাকে কেউ স্পর্শ করতে পারেনি।
টেকনাফ এলাকা হলো ইয়াবা মাদকের প্রবেশ দ্বার – যেটা বাংলাদেশের জাতীয় মাদক হয়ে উঠেছে। তাছাড়া রোহিঙ্গারাও এই পথেই প্রবেশ করে, যারা এখন আরও বেশি মাত্রায় পাচার আর আইন-শৃঙ্খলা সমস্যায় জড়িয়েছে। ওই এলাকায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নিয়োজিত পুলিশ এনকাউন্টারে হত্যাকাণ্ড চালায় এবং এটাকে তারা উদ্দেশ্য হাসিলের একটা অস্ত্র মনে করে। সম্ভবত এ কারণেই এই বিষয়টিকে সহ্য করা হয়ে আসছে।
কিন্তু তার পরও মিডিয়ার তথ্য অনুসারে দেখা যাচ্ছে এ বছর বাংলাদেশে আগের যে কোন বছরের তুলনায় বেশি ইয়াবা আর মাদক ঢুকেছে। তাহলে এই সব হত্যাকাণ্ড দিয়ে কি অর্জিত হলো, যদি আমরা ধরেও নেই যে, বাংলাদেশে ব্যবসায় চালানোর এটাই গ্রহণযোগ্য উপায়?
এর উপর বহু মানুষ এখন তাদের মুখ খুলছে এবং তারা বলছে যে, প্রদীপ ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে বহু মানুষের কাছ থেকে বিপুল অর্থ লুটে নিয়েছে।

সিনহা হত্যাকাণ্ড
মেজর সিনহার হত্যাকাণ্ড এখনও কিছুটা রহস্যে ঢাকা রয়েছে কারণ তিনি কখনও কোন অপরাধের সন্দেহভাজন ছিলেন না বা তার কোন ক্রিমিনাল রেকর্ডও নেই। তিনি এসএসএফের সদস্য ছিলেন, তার অর্থ হলো সামরিক বাহিনীর অভিজাত স্তরের সাথে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। মিডিয়ার বক্তব্য অনুসারে যে গাড়িতে তিনি সফর করছিলেন, সেখান থেকে তাকে বের করার পর বেশ কয়েকবার গুলি করা হয় তাকে। এখানে এনকাউন্টারের গতবাঁধা গল্পটা নেই যে, কথিত কোন অপরাধীকে সাথে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে বের হওয়ার পর গোলাগুলির মাঝে পড়ে সে নিহত হয়েছে। তবে, বিষয়টি অনুসন্ধানের দায়িত্ব তদন্ত কমিটির।
মানুষকে যেটা আঘাত দিতো সেটা হলো পুলিশের হত্যাকাণ্ড মানেই দায়মুক্তভাবে পার পেয়ে যাওয়া। সেনাবাহিনী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং অভিযুক্ত ঘাতকদের গ্রেফতারসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যেহেতু সেনাবাহিনীকে এই ক্ষেত্রে পাশে পাওয়া গেছে, তাই এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জনগণের ক্ষোভ এখন প্রকাশিত হচ্ছে।
এই ঘটনা এরইমধ্যে সরকারের মধ্যে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে এবং পুলিশ আর সেনাবাহিনীর মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। তবে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতি সামলানোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
পুলিশ আর সেনাবাহিনীর প্রধানদ্বয় যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছেন – সম্ভবত এ যাবতকালের মধ্যে প্রথমবারের মতো এটা করা হলো। সবাইকে তারা আশ্বস্ত করেছেন যে, তারা একসাথে কাজ করছেন। তারা বলেছেন যে, টেকনাফের হত্যাকাণ্ড একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং দুই বাহিনীর আন্তরিক সম্পর্কের উপর সেটা কোন প্রভাব ফেলবে না। এর পরই সংবাদ প্রকাশিত হয় যে, ওই এলাকায় সেনাবাহিনী-পুলিশের যৌথ টহল শুরু হবে।
প্রথমদিকে হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুলিশ সাধারণত যেটা করে, সেটাই তারা করেছিল। পুলিশ এফআইআরে বলা হয় যে, সিনহার কাছে মাদক পাওয়া গেছে এবং তিনি পুলিশকে গুলি করার চেষ্টা করেন, যারা পাল্টা গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করে। কিন্তু সেনাবাহিনীর মধ্যে তার মৃত্যু নিয়ে ক্ষোভ ছিল প্রচণ্ড এবং তাদের এই বক্তব্য টেকেনি।
দায়িত্বরত এবং অবসরপ্রাপ্ত সব কর্মকর্তাই এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এর অর্থ হলো এটা সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠানের উপর প্রভাব ফেলেছে। বেশ কিছু বিবৃতি দেয়া হয়েছে এবং সেখানে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তাদের সরিয়ে আনা হয়েছে।
এই চাপ আরও বাড়তে থাকে এবং সিনহার পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের পর, টেকনাফ থানার নয় জনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়। এদের মধ্যে প্রদীপও রয়েছেন, যিনি এখন পুরো জাতির ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছেন। আরও তদন্ত চলছে। এদিকে অভিযুক্ত ঘাতকদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমাণ্ডে নিয়েছে র্যাব।
শিকড় অক্ষত রয়ে গেছে
এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের মূল ঘাটতে গেলে দেখা যাবে সমাজে এ ধরনের বিপুল অপরাধ হচ্ছে। সেখানে যারা মনে করে যে, অপরাধ করে তারা পার পেয়ে যাবে, তারাই সেই অপরাধটা চালিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এদের মধ্যে আইন ভঙ্গকারী এবং আইন প্রয়োগকারী সবাই রয়েছে।
সেই তুলনায় আইন প্রয়োগকারী ব্যবস্থার সক্ষমতা সীমিত। এর একটা কারণ হলো আইনি ব্যবস্থাটা এখানে এত পুরনো আর ঝামেলাদায়ক যে, যে সব অপরাধীর কিছু অর্থ আর যোগাযোগ আছে, তারা সবাই নিজেদের নিরাপদ মনে করে। সে কারণে সিস্টেমের ভেতরেই এনকাউন্টারে হত্যার বিষয়টি এভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। অনেক সাধারণ মানুষও এটাকে সমর্থন করে কারণ নিহতদের অধিকাংশই হলো অপরাধী।
গত দুই দশক ধরে এই প্রক্রিয়াটা চলে আসছে এবং প্রতি বছর এটার মাত্রা এমনভাবে বাড়ছে যে প্রতিবছর নিহতের সংখ্যা বহু শততে গিয়ে পৌঁছেছে। কেউ এটা নিয়ে প্রশ্ন করার সাহস করে না এবং এমনকি মানুষ যখন সমালোচনা আর অভিযোগ করে, সেগুলোকে অগ্রাহ্য করা হয়। কিন্তু সবশেষ এই হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তির পরিচয় এই সবকিছুকে বদলে দিয়েছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেকেই ‘ক্রসফায়ার অর্থনীতি’তে জড়িয়েছে, যাদের মধ্যে প্রদীপও রয়েছে। ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে এরা অর্থ রোজগার করে। তবে, পুলিশের আইজি বলেছেন যে, ‘ক্রসফায়ার’ ‘এনজিওদের তৈরি করা শব্দ’। এর অর্থ হলো আনুষ্ঠানিক হিসেব নিকেশে এর কোন অস্তিত্ব নেই। সেই কারণে এটা শেষ হওয়া দূরে থাক, এটার মাত্রা কমার সম্ভাবনাটাও খুবই কম।
ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে সিনহার মামলায় অন্তত ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে। এর কারণ সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনী এটাকে কর্পোরেট ইস্যু হিসেবে নিয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী এই পদক্ষেপকে সমর্থন দিয়েছেন। সিনহার পরিবারকে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা হবে।
এই মামলায় হয়তো বিচার হবে, কিন্তু কেউই আশা করে না যে, এনকাউন্টার শিগগিরই বন্ধ হবে।