আমরা লাইভে English শনিবার, জুন ১০, ২০২৩

বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের সেকেলে ধারণা উল্টা ফল বয়ে আনবে

Top News 2020-08-13 070328

দক্ষিণ এশিয়ায় একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রয়েছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক মাত্রা যুক্ত হয়েছে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর সৌজন্যতা নিয়ে। বাংলাদেশের সাথে দুটো ভিন্ন অঞ্চলের সীমান্ত রয়েছে। একদিকে চাল উৎপাদনকারী দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, অন্যদিকে আছে গম উৎপাদনকারী অঞ্চল – ভারত আর অন্যান্য দেশগুলো রয়েছে যেখানে। বাংলাদেশ এখানে একমাত্র দেশ, যে দেশের জন্ম হয়েছে যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদেরকে তারা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করে থাকে। 

আঞ্চলিক সঙ্ঘাতের সন্তান

এই সংগ্রামে, প্রধান শত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছিল এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় দেশ ভারত। বাংলাদেশ এভাবে স্বাধীন দেশ হয়ে ওঠে, যেটা পারস্পরিক শত্রুতার অংশ ছিল, যেটা দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘদিন বিরাজ করেছে। সেই সময়টাতে ভারত এ অঞ্চলে শ্রেষ্ঠত্বের জায়গায় ছিল এবং ১৯৭১ সালের পরে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোতে তারা প্রভাব বিস্তার করেছে। এভাবেই, বাংলাদেশকে অনেকে ভারতের ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক মিত্র হিসেবে দেখে আসছে। 

এই যুক্তি ছিল স্বাভাবিকভাবেই হালকা ধরনের। কিন্তু ক্ষমতার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই অঞ্চল সবসময়ই ছিল এ রকম হালকা মনোভাবের জন্য বিখ্যাত। ভারতসহ অনেকেই সম্পর্কের পেছনে কিছুটা ধর্মের ভূমিকাও উল্লেখ করে থাকে, অথচ বাস্তবে এই সম্পর্কটা হলো লেনদেনভিত্তিক। পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে যে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, এ অঞ্চলের কূটনৈতিক যুক্তিতর্কের ক্ষেত্রে সেটা বিশেষভাবে অগ্রাহ্য করা হতো। 

সে কারণে সরকার পর্যায়ে যখন দারুণ একটা ইন্দো-বাংলা সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে, তখন জনগণের পর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে ভারত সংবেদনশীলতা দেখাতে পারেনি কারণ তারা ধরে নিয়েছে যে, পাকিস্তান দুই দেশেরই অভিন্ন শত্রু, এবং বাংলাদেশ ভারতের স্বার্থকে নিজেদের স্বার্থ হিসেবে বিবেচনা করবে। 

আসলে, এই অবনতি শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ঠিক পরেই যখন ভারতীয় সেনারা বেশ কিছু বাহিনীর কাছ থেকে তাদের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম সরিয়ে নিচ্ছিল, একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত সম্পদের দেশে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং এই ঘাটতির সুযোগ নিয়ে, তাদের পণ্যের নেতিবাচক ব্র্যাণ্ডিং শুরু করেছিল। 

নতুন রাষ্ট্রের ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য একটা প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এটা কোন গোপন বিষয় নয় যে, পূর্ব বাংলার উপর দিল্লী আর কলকাতার আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনের মধ্যে জন্ম হয়েছিল তার, এবং ভারতের প্রতি স্বাভাবিকভাবে অতটা আগ্রহী ছিলেন না তিনি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনি তার দলের ‘ভারতপন্থী’ লবির চেয়ে আদর্শিকভাবে অনেকটাই ছিলেন স্বাধীন। 

রাষ্ট্রীয় ‘দূরত্ব’ বজায় রাখার চেষ্টা

শেখ মুজিব অর্গানাইজেশান অব ইসলামিক কোঅপারেশানে (ওআইসি) যোগ দেয়ার কারণেই শুধু ভারত বিরক্ত হয়নি। পাকিস্তানের সাথে ভারত যে সিমলা চুক্তি করেছিলে, সেখান থেকেও দূরে সরে ছিল বাংলাদেশ। অন্যভাবে বললে, প্রতিটি দেশই নিজেদের স্বার্থ দেখাশোনা করেছে। 

সমস্যা হলো ভারতের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের দিকে মনোযোগ দিলেই সেটা এমন একটা ধারণা তৈরি করে যেন ভারতের থেকে এবং তাদের কূটনৈতিক বলয় থেকে ‘দূরে সরে যাওয়া হচ্ছে’। এভাবে দ্রুত বর্ধনশীল প্রতিবেশীগুলোর সাথে ভারতের সমস্যা তৈরি হয়েছে, যারা কোন নির্দেশনা শুনতে চায় না বা ভারতকে ভেড়ার মতো অনুসরণ করতে চায় না। 

বাস্তবতা নিয়ে চলছে বাংলাদেশ

ভারতের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে দুটো বাস্তবতা মেনে নিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমত, বাংলাদেশের চেয়ে শক্তি ও আকারে বড় হওয়ায় তাদেরকে অগ্রাহ্য করাটা অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, সেই প্রতিবেশীর সাথে খুশি থাকাটা অসম্ভব যাদের আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাটা অনেক উঁচু এবং যাদের প্রতিবেশী নীতিতে নিজস্ব পররাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকার প্রাধান্য পেয়েছে।

Lift-Top News-Bangla-13 Aug 2020-1সম্ভবত সবচেয়ে সুপরিচিত সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছিল এখানে সার্ক। এই ফোরামে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশ একটা কূটনৈতিক ‘সমতার’ ধারনা তৈরি করতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই ভারত সেটা পছন্দ করেনি। সার্ক কোন দ্বিপাক্ষিক ফোরাম ছিল না, এটা ছিল বহুপাক্ষিক এবং দ্বিপাক্ষিক কোন ইস্যু এখানে নিয়ে আসার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ভারত এ ধরনের কোন প্ল্যাটফর্মের ধারণা/তত্ত্ব নিয়ে খুশি ছিল না, যেখানে অন্যান্য দেশের পাশে তাদের মর্যাদা হবে ‘সমান সমান’। সে কারণে অকার্যকর হয়ে গেছে সার্ক। 

ভারত বিমসটেককে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে যদিও এ অঞ্চলের ব্যাপারে তাদের সামান্যই আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু, এখানে ভারতের সমস্যা হয়নি কারণ তাদের শ্রেষ্ঠত্বকে কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি এখানে। কিন্তু চীনের উত্থানের সাথে সাথে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। চীনের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের সীমান্ত রয়েছে এবং এ অঞ্চলে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে, যে অঞ্চলকে নিজের উঠান মনে করে ভারত। 

চীন আগের মতো লাজুক নয়

চীন সবসময় পাশেই ছিল কিন্তু আধিপত্য বিস্তার করতে চায়নি। ভারতের সাথে বাণিজ্যের দিকেই নজর ছিল তাদের। কিন্তু সীমান্ত বিবাদ আর ভারত যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক প্রক্সি হয়ে ওঠায় সেটা চীনকে রাজনৈতিক ও কৌশলগত পর্যায়ে উত্যক্ত করতে শুরু করেছে। 

পাকিস্তানের দিক থেকে চীন তাদের জন্য নির্ভরতার একটা জায়গা হয়ে উঠেছে, যখন ভারত তাদেরকে চাপ দিচ্ছে। তবে, বাংলাদেশের জন্য বিষয়টা কঠিন। প্রকাশ্যে ভারত আর বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো বন্ধু। কিন্তু এর আরেকটি দিক রয়েছে। বেশি শোরগোল না করেও বাংলাদেশ তার দুর্বল অবস্থান নিয়ে ভারত আর চীনকে নিজেদের মধ্যে লড়াই করতে দিয়েছে। আর এর উপকার বাংলাদেশও পেয়েছে। 

টেলিফোন কূটনীতি

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করার কারণে বিষয়টি ভারতকে ক্রুদ্ধ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় মিডিয়া সোরগোল করেছে এবং অনেকেই এখানে ষড়যন্ত্র দেখতে পেয়েছেন যেটার কারণে ভারত তাদের ‘ঐতিহ্যবাহী বন্ধুকে’ হারাতে চলেছে। একটি অংশ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি থাকা বেশ কিছু ব্যক্তিকে পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবেও উল্লেখ করছে। কিছু মানুষকে মনে হচ্ছে, তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। 

এটা বোধগম্য কিন্তু বাংলাদেশ দেখছে যে চীনের কাছাকাছি হলে এতে তাদের সুবিধা বেশি। তবে ভারতের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই তারা এগুচ্ছে কারণ ভারতের সাথেও তাদের বাণিজ্য রয়েছে। টেলিফোন আলাপের কোন আনুষ্ঠানিক বা বাস্তবিক মূল্য নেই এবং আসলে বাংলাদেশে এটা তেমন কোন কৌতুহলেরও সৃষ্টি করেনি। কিন্তু ভারতে সেটা হয়েছে। ভারত বা চীনের সাথে তর্কযুদ্ধে জড়ানোর পর্যায়ে নেই বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ এটাকে চলে যেতে দেবে এবং উভয়েরই যুক্তি তর্ক শুনবে এবং দুই বড় শক্তির দ্বন্দ্ব থেকে যতটা পারা যায় লাভবান হওয়ার চেষ্টা করবে।