আমরা লাইভে English মঙ্গলবার, জুন ০৬, ২০২৩

গ্যাঁড়াকলে ভারতের গেরুয়া ব্রিগেড

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্পর্শকাতর আসাম রাজ্যের জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) হালনাগাদ এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৯ (সিএবি ২০১৯) পাসের পর ধর্মের ভিত্তিতে ভারতের ভোটারদের মেরুকরণ করার ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) পরিকল্পনার বিশেষ দিক বিবেচিত হচ্ছে।

কিন্তু উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে এই জোড়া পদক্ষেপ বিজেপিকে কঠিন অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। দলের ভেতরের লোকজন আশঙ্কা করছে, অদূর ভবিষ্যতে গেরুয়া ব্রিগেড দুই নৌকায় দু’পা রাখার মতো অবস্থায় পড়ে যেতে পারে।

এনআরসি বাস্তবায়ন আসামের জাতিগত ও ভাষাভিত্তিক সংখ্যালঘুদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে এবং তা পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য প্রতিবেশী রাজ্যে কট্টরপন্থী বাঙালি গ্রুপগুলোর সমর্থন পাচ্ছে। এসব গ্রুপের অভিযোগ, এনআরসি আসলে আসামে ১৯৬০-এর দশকের ‘বাঙালি খেদাও’ আন্দোলনের মাধ্যমে সূচিত আসামকে বাঙালি মুক্ত করার আন্দোলনকেই বেগবান করছে।

এনআরসি থেকে বাদ পড়া ১৯ লাখ লোকের মধ্যে ১০ লাখের বেশি হলো বাঙালি হিন্দু এবং চার লাখের মতো বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিম। এছাড়া এক লাখ রয়েছে গোর্খা, তারা নিবেদিতপ্রাণ হিন্দু।

কলকাতাভিত্তি ‘বাঙলা পক্ষের’ মতো গ্রুপগুলো পুরো প্রক্রিয়াকে দেখছে আসামকে বাঙালি মুক্ত করার আন্দোলন হিসেবে, আর পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস ২৫ নভেম্বরের তিনটি উপনির্বাচনে জয়ী হতে সফলভাবেই এনআরসি-বিরোধী ভাবাবেগ ব্যবহার করেছে।

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস সফলভাবেই এনআরসিকে কেবল মুসলিমবিরোধী পদক্ষেপই নয়, একে বাঙালিবিরোধী পদক্ষেপ (যা শুরুতে ভারতের সেক্যুলার গ্রুপ ও রাজনৈতিক দলগুলো দাবি করে আসছিল) হিসেবেও উপস্থাপন করেছে। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুর আসনে ২১ হাজার ভোটে পরাজিত হয়। এই আসনে ২০১৬ সালের রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনে বিজেপির রাজ্য শাখার সভাপতি দিলিপ ঘোষ জয়ী হয়েছিলেন। তিনি ২০১৯ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ৪৫ হাজার ভোট বেশি পেয়েছিলেন। খড়গপুরে পরাজয় দিল্লিতে গেরুয়া শিবিরে খারাপ খবর পাঠায়।

ঘোষ স্বীকার করেছেন যে লোকসভার নির্বাচনের পর প্রকাশিত এনআরসির হালনাগাদ করা প্রতিবেদন বড় ধরনের পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। এটি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিবিরোধী ভাবাবেগের সৃষ্টি করেছে, রাজ্যে দলের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নষ্ট করে দিয়েছে।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলো বিজেপি এখন অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন ও আসাম পাবলিক ওয়ার্কসের মতো আসামের কট্টরপন্থী গ্রুপগুলোর সাথে হাত মিলিয়ে এনআরসি বাতিল করা এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য এনআরসির সমন্বয়কারী প্রতীক হাজেলাকে দায়ী করছে।

আসামের শক্তিশালী মন্ত্রী ও নর্থইস্ট ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এনইডিএ) নামে গঠিত জোটের প্রধান হিমন্তা বিশ্ব শর্মা এমনকি হাজেলার বিরুদ্ধে এনআরসি-তহবিল তসরুপের অভিযোগও এনেছেন। ওই কর্মকর্তাকে দ্রুততার সাথে মধ্যপ্রদেশে বদলি করা হয়।

শর্মা তার উদ্বেগ গোপন করেননি: অনেক অনুপ্রবেশকারীকে (পড়ুন: মুসলিম) এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, আবার অনেক প্রকৃত নাগরিককে (পড়ুন: হিন্দু) বাদ দেয়া হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে আঞ্চলিক কয়েকটি গ্রুপের পাশাপাশি আসামে নতুন এনআরসির জন্য সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে আসাম বিজেপি।

আসামীয় ও উপজাতীয়- উভয়ের (এবং সেইসাথে বাঙালি হিন্দুদেরও এই তিন গ্রুপই তিন বছর আগে বিজেপিকে রাজ্যে ক্ষমতায় এনেছিল) সমর্থন হারানোর আশঙ্কায় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে পুরো ভারতে এনআরসি করার সময় আসামেও আবার করা হবে। শাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে ২০২৪ সালে মোদি সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সারা ভারতে এনআরসি সম্পন্ন হবে।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমারের মতো অনেক আঞ্চলিক নেতা এনআরসির বিরোধিতা করেছেন, পশ্চিমবঙ্গে মোদি-শাহের এনআরসি রুখে দেয়ার ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছেন মমতা।

মমতা ব্যানার্জি সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, এখানে আমার সরকার যত দিন থাকবে, তত দিন পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি হতে দেব না। এটা আসামের বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। ওই রাজ্যে মানুষের দুর্দশা দেখার পর পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য এলাকায় তা প্রয়োগ করার কোনো কারণ নেই।

কংগ্রেসও ‘মেরুকরণের রাজনীতির’ বিরোধিতা করছে, অন্যান্য সেক্যুলার দলও এতে যোগ দিয়েছে। ফলে ভারতজুড়ে এনআরসি করা খুব সহজ হবে না। বড় রাজ্যগুলোর মধ্যে বিজেপির নিয়ন্ত্রণে আছে মাত্র তিনটি। এগুলো হলো উত্তর প্রদেশ, কর্নাটক ও গুজরাট। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে কংগ্রেস ও আঞ্চলিক দলগুলো। রাজ্য প্রশাসন সহযোগিতা না করলে এনআরসি’র মতো একঘেয়ে প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন কঠিন হবে।

বিশ্লেষক মানস রায় বলেন, আসামের মতো অন্যান্য রাজ্যের প্রশাসন সংখ্যালঘুদের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ নয়। এই প্রেক্ষাপটে যদি এসব রাজ্যে খুব কম লোক বাদ পড়ে, তবে কী হবে? বিজেপি যে ভারতে বিপুল অবৈধ অভিবাসীর দাবি করে আসছে, তার বিরুদ্ধে এটি হবে বড় ধরনের আঘাত এবং তা হবে এই বিশাল উদ্যোগের প্রতি একটি বিদ্রুপ।

অবশ্য অনেকে আরো বড় মৌলিক প্রশ্ন তুলছেন: এনআরসি যদি আসামের সব অংশকে (আসামীয়, উপজাতীয়, বাঙালি হিন্দু এবং ভিন্ন কারণে মুসলিমদেরও) সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়, এর পেছনে এত অর্থ ব্যয় করার কী যুক্তি থাকতে পারে, বিশেষ করে ভারতীয় অর্থনীতি যখন ভয়াবহ সমস্যায় আছে।

ইন্ডিয়ান ইউনিয়নে আসামকে প্রায়ই ব্যর্থ রাজ্যের তকমা দেয়া হয়। আসামীয়দের এলিট আধিপত্য ও অন্যান্য এলাকার প্রতি অবহেলার কারণে উপজাতীয় ক্রোধ প্রশমিত করার জন্য এখান থেকে কেটে চারটি রাজ্য- নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মেঘালয় ও অরুনাচল প্রদেশ গঠন করা হয়েছে। এছাড়া আলাদা রাজ্যের দাবিতে তিনটি শক্তিশালী উপজাতি গ্রুপ –বোড়ো, দিমাসা ও করবি গোত্র সশস্ত্র আন্দোলন করছে।

এনআরসির হাজার হাজার লোককে আটক কেন্দ্রে পাঠিয়েছে, ৫৭ জন আত্মহত্যা করেছে। এর জের ধরে বরাক উপত্যকায় আলাদা বাঙালি রাজ্য গঠনের দাবি ওঠেছে। এখানে প্রবল ভাষা আন্দোলনের পর এলাকার সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে এখানকার গ্রহণ করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যখন দাবি করেন যে পুরো আসামের সরকারি ভাষা হবে আসামীয়, তখন বরাক উপত্যকার কট্টর বাঙালি নেতা প্রদীপ দত্ত রায় তীব্র প্রতিবাদ করেন, ১৯৬০-এর দশকে ভাষা আন্দোলনের অর্জিত সাফল্য ক্ষতিগ্রস্ত করার যেকোনো চেষ্টা করে বিচ্ছিন্ন হওয়ার হুমকি দেন।

ওই ভাষা আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে ১১ জন নিহত হয়েছিল। যাকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করা করা হয়। যার জের ধরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো।

বাংলা পক্ষের নেতা গর্গা চ্যাটার্জি বলেন, আসামে সবাইকে অসন্তুষ্ট করার পরও কেন বিজেপি সারা ভারতে এনআরসি তৈরি করতে চায়?

আইন পাসের পর বিক্ষোভ

কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশের পর উত্তরপূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো ও পশ্চিম বঙ্গে বিক্ষোভ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এখন আসাম কিছুটা শান্ত হওয়ার পর দেশের অন্যান্য অংশে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।

পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙ্গায় সবচেয়ে বড় সহিংসতা হয়েছে। সেখানে বিক্ষোভকারীরা রেল স্টেশন, থানা ভাঙ্গচুর করে। অনেক যানবাহন পোড়ানো হয়। পুলিশও আহত হয়। ফলে ইস্টার্ন রেলওয়ের শিয়ালদা ট্রেন সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। হাওড়া জেলার উলুবেরিয়া রেল স্টেশন তছনছ করেছে ক্যাব বিরোধী বিক্ষোভকারীরা।

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাসের জন্য কেন্দ্রের সমালোচনা করেছেন মমতা ব্যানার্জি। তিনি এই আইনকে ‘মানবতার উপর নির্যাতন চালানো’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

ক্যাব প্রত্যাহারের দাবিতে আলিগড় ও গোয়ায় বিক্ষোভ হয়েছে। শুক্রবার জুমার নামাজের পর ক্যাব বিরোধী বিক্ষোভে শামিল হতে পশ্চিম বঙ্গের মুসলিম সংগঠনগুলো জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। মুসলিম অভিবাসীদের বহিষ্কারের জন্য প্রণীত ক্যাবের বিরুদ্ধে কলকাতা, আরামবাগ, পশ্চিম মেদিনিপুর, উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হয়েছে।

আইনটি প্রত্যাহারের দাবিতে আসামে আদিবাসিদের ৩০টি সংগঠন সড়কে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে। মনিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুনাচল প্রদেশ, মিজোরাম ও ত্রিপুরাতেও একই ধরনের বিক্ষোভ হচ্ছে। এসব আদিবাসী গ্রুপ বাংলাদেশ থেকে আসা সব অভিবাসীকে (তারা বাঙালি হিন্দু বা মুসলিম বা বৌদ্ধ চাকমা যাই হোক না কেন) তাদের রাজ্যের জনমিতিক ও সামাজিক ধারার বিরুদ্ধে হুমকি মনে করে। তারা অভিযোগ করছে, বিজেপি এনআরসির মাধ্যমে বিদেশীদের বহিস্কার করে তারপর সিএবির মাধ্যমে এখানে বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করছে।

সিএবি ইস্যুতে এনইডিএ জোট ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে বিজেপির আঞ্চলিক মিত্ররা। তা ঘটলে গেরুয়া দলটি মেঘালয়, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামের মতো কয়েকটি রাজ্যে নিয়ন্ত্রণ হারাবে। এসব রাজ্যে বিজেপি জোট সরকারের সংখ্যালঘু অংশীদার।

এনআরসি-সিএবি নিয়ে বিরোধের জের ধরে ২০১৬ সালে আসামে বিজেপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা গুজরাট-ধরনের মহা হিন্দু জোটকেও হুমকির মধ্যে ফেলে দেবে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সাফল্য হারিয়ে যাওয়ার হুমকি সৃষ্টি করবে।

বিজেপি-আরএসএস মনে করছে যে কাশ্মির, রাম মন্দির ও এনআরসি হলো ধর্মীয় রেখায় ভারতের ভোটদের মেরুকরণ করার হিন্দুত্ববাদের তিনটি অস্ত্র। এগুলোর ওপর ভর করেই তারা জয়ের ধারা বহাল রাখতে পারবে। কিন্তু এনআরসি ও সিএবি এমন পরস্পর বিপরীত সঙ্ঘাত আর চাপ সৃষ্টি করতে পারে যা মোদি ও শাহ পর্যন্ত সামাল দিতে নাও পারেন।