গরিবদের ‘লং মার্চে’ নামতে বাধ্য করেছেন অনুভূতিহীন মোদি

ত্রিশের দশকে চীনের কিংবদন্তী চেয়ারম্যান মাও জে দং তার রেড আর্মিকে সারা চীনে ‘লং মার্চে’ নামিয়েছিলেন যাতে তার কমিউনিস্ট পার্টির লড়াইরত সেনাদেরকে চাইনিজ ন্যাশনালিস্ট (কুয়োমিনতাং) সেনাদের থেকে রক্ষা করা যায়। চীনে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে রক্ষার জন্য এটা ছিল সুচিন্তিত একটি কৌশলগত প্রয়োজন। আধুনিক চীনের ইতিহাসে এটা গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে টিকে আছে।
হিমালয়ের এপারে ভারতে, দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বর্তমানে আরেকটি ‘লং মার্চের’ আয়োজন করছেন। কিন্তু এটা কোনভাবেই মহান কিছু নয়। এটা একটা কলঙ্কজনক ও অনুভূতিহীন পদযাত্রা। ২৪ মার্চ হঠাৎ করে পুরো ভারতে ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করে মোদি সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে থমকে দিয়েছেন এবং গরিবদের শহর ছেড়ে বহু শত, বহু হাজার মাইল পারি দিয়ে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন।
২৪ মার্চ থেকে কারখানা ও মার্কেটগুলো বন্ধ হয়ে গেছে এবং নির্মাণ কাজগুলোও স্থগিত করা হয়েছে, এবং পরিস্থিতির উন্নতির কোন আশা না থাকায়, খেয়ে পরে বেঁচে থাকার মতো রোজগারের কোন পথই আর খোলা নেই। ধনীরা যেখানে পণ্য জমা করেছেন, সেখানে গরিবদের কাছে কিছুই নেই। তাদেরকে হয় না খেয়ে থাকতে হচ্ছে, অথবা গ্রামে ফিরে যেতে হচ্ছে। অনেকেই তাই গ্রামে ফিরে যাওয়াকেই বেছে নিয়েছেন। মহারাষ্ট্র এবং কেরালার মতো রাজ্যে এই চলাফেরাটা সমস্যাদায়ক, যেখানে করোনাভাইরাস এরই মধ্যে যথেষ্ট জীবন কেড়ে নিয়েছে।
থাকার কোন জায়গা নেই, কারণ বাড়ির মালিকরা মনে করছেন যে, তারা ভাড়া দিতে পারবে না, এবং সেজন্য তারা তাদেরকে রাখতে চান না। এ কারণে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যারা পদাতিক সেনা, তাদের জন্য গ্রামে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোন পথ খোলা ছিল না। এই আশায় তারা ফিরে গেছেন যে, সেখানে ঐতিহ্যগত সামাজিক সমর্থনটুকু হয়তো তারা পাবেন।
বান্টির স্ত্রী এনডিটিভিকে বলেন, “এখানে আমরা কি খাবো? পাথর তো খাওয়া যায় না”। একটা ব্যাগে সমস্ত জিনিসপত্র বোঝাই করে সেটা মাথায় করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে। তার পেছনে আরেকটি পরিবার হাঁটছে। ছোট ছেলেটাকে ঘাড়ে করে নিয়ে যাচ্ছে একজন। তার স্ত্রী ছোট মেয়েটাকে হাত ধরে নিয়ে এগুচ্ছে।
বান্টি বললেন, “দিল্লীতে কেউ আপনাকে সাহায্য করবে না, গ্রামে যেমনটা করে মানুষ”। ১৫০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে গ্রামে ফেরার যুক্তি বোঝানোর জন্যই হয়তো বান্টি আরও বললেন, “গ্রামে শুধু লবণ বা চাটনি দিয়ে রুটিটা খেতে পারবো। সেখানে শান্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু এখানে আমাদের কিছুই নেই। দিল্লীতে কেউ কাউকে সাহায্য করে না”।
বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কিন্তু তারপরও তাদেরকে কেউ নিরস্ত করতে পারেনি।
মুন্না লাল গত ২৪ ঘন্টার মধ্যে কোন খাবার বা পানি ছাড়াই ১০০ কিলোমিটারের বেশি হেঁটেছেন। বাড়ি পৌঁছাতে তাকে আরও ১৫০ কিলোমিটার পার হতে হবে। ৪৮ বছর বয়সী লাল আটজন শ্রমিকের একটা দলের সাথে উত্তর প্রদশের পূরো পূর্বাঞ্চল হেঁটে পারি দিচ্ছেন বাহরাইচ জেলায় নিজেদের পূর্বপুরুষের গ্রাম গাটলা বেলিতে পৌঁছার জন্য। কানপুর শহর থেকে এটা প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, যেখানে তারা রাজমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেছে।
লকডাউন ঘোষণা করার পরদিন তারা তারা তাদের নির্মাণকেন্দ্র থেকে ভোর তিনটায় রওনা দিয়েছে, যখন তত্ত্বাবধায়ক তাদেরকে বলেছে যে, ২১ দিনের লকডাউনকালে কাজ বন্ধ থাকবে।
হারভেশ ঝর ঝর করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “করোনাভাইরাস আমাদের মেরে ফেলবে, কিন্তু তার উপর সরকারই আমাদেরকে মেরে ফেলছে”। সে বললো, “আমরা দিনমজুর। এখানে এখন আমরা ক্ষুধায় মরতে চাই না”।
অধিকাংশই এসেছে আলীগড়ের কাছের গ্রামগুলো থেকে, যেটা দিল্লী থেকে দক্ষিণ-পূর্বে ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পৌঁছাতে কারো লেগেছে এক দিন, অন্যদের গ্রামে পৌঁছতে দুই থেকে তিন দিন লেগে গেছে।
দিল্লী থেকে দশ মাস বয়সী শিশুকে কাঁধে নিয়ে ১৫০ কিলোমিটার দূরে উত্তর প্রদেশে নিজের গ্রামে ফিরেছেন দিনমজুর বান্টি। টেলিভিশনে তার অবস্থা দেখে অনেকেই হতাশ হয়েছেন, ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হয়েছেন। সোশাল মিডিয়ায় এর বহিপ্রকাশ দেখেই সেটা বোঝা গেছে। একজন নেটিজেন আবেদন করেছেন, “একটু হৃদয়বান হোন, প্রধানমন্ত্রী”।
আরেকজন লিখেছেন: “তার কোন হৃদয় নেই, ২০১৫ সালের ডিমোনিটাইজেশানের কথা কি ভুলে গেছেন?”
তবে বর্তমান দুর্দশা ২০১৬ সালের ডিমোনিটাইজেশানের সময়কে ছাপিয়ে গেছে। সে সময় সরাকর ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিল করার পর বহু মিলিয়ন ভারতীয় – যাদের অধিকাংশই দরিদ্র – তাদেরকে রুপির নোট বদলের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে।
এক ফেসবুক ব্যবহারকারী এটাকে সংক্ষেপ করে বলেছেন, “এটা মোদির ট্রেডমার্ক। জনগণ কি ধরনের দুর্দশায় পড়তে পারে, সেটা একেবারে কিছুই না ভেবে হঠাৎ করে একটা ঘোষণা দেয়া”।
গতকাল জাতির উদ্দেশে টেলিভিশনে দেয়া বক্তৃতায় মোদি বলেছেন, “২১ দিনের লকডাউন হয়তো দীর্ঘ সময় মনে হচ্ছে, কিন্তু প্রত্যেকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এটাই একমাত্র উপায়”। তিনি বারবার বলেছেন, ঘরে থাকুন এবং এটা এখন অস্তিত্বের প্রশ্ন। কিন্তু বান্টি আর তার পরিবারের জন্য এটা দুটো বিপর্যয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নেয়ার মতো।
সরকার একইসাথে বারবার এটাও জোর দিয়ে বলছে যে, গরিবদের সাহায্য করতে হবে। নিজের নির্বাচনী এলাকা বারানসিতে কথা বলার সময় মোদি পরামর্শ দেন যে, যাদের সামর্থ আছে, তারা যেন ’২১ দিনের জন্য নয়টি পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার প্রতিশ্রুতি নেয়’। কিন্তু তার যে সব পরিচিতজনরা তার আমলে বিপুল মুনাফা করেছে, সেইসব পুঁজিপতি বন্ধুদেরকে বোঝাতে পারেননি তিনি। একমাত্র যে পুঁজিপতি এগিয়ে এসেছেন, তিনি হলেন আজিজ প্রেমজি। স্পাইসজেট প্রস্তাব দিয়েছে যে তারা মুম্বাই ও দিল্লী থেকে শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনবে।
বিজেপি তাদের ১০ মিলিয়ন কর্মীদেরকে নির্দেশনা দিয়েছে যাতে তারা এই ২১ দিন পাঁচজন ব্যক্তির খাবারের ব্যবস্থা করে। দলের প্রধান জে পি নাড্ডা এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। দলের আশা এই সিদ্ধান্ত ৫০ মিলিয়ন মানুষের খাবার নিশ্চিত করবে। কিন্তু এই সব তর্জন গর্জনই ফাঁপা শুনিয়েছে, যখন এক হাতে ছেলেকে ধরে অন্য হাতে লাগেজ নিয়ে বাড়িতে ফিরেছেন হারভেশ। তারই মতো আরও পঞ্চাশজন দক্ষিণ দিল্লী থেকে উত্তর প্রদেশে নিজেদের গ্রামে ফিরে এসেছে।
সরকার ১.৭ লাখ কোটি রুপির প্যাকেজ (গরিব কল্যাণ যোজনা) ঘোষণা করেছে, যেটা দিয়ে করোনাভাইরাস মহামারী ও লকডাউনের কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত গরিবদের দুর্দশা লাঘব করা হবে। কিন্তু জরিপকারী থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া যোগেন্দ্র যাদব টুইটারে দেখিয়েছেন যে, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন যে পরিসংখ্যানগত দাবি করেছেন এবং স্কিম-ভিত্তিক তিনি যে বরাদ্দ দিয়েছেন, তাতে এখানে যোগ হবে মাত্র ১.২ লাখ কোটি রুপি।
নিরোর মতো উদাসীনতা
ভারতের গণস্বাস্থ্য অবকাঠামো যেখানে কোভিড-১৯ এর মতো মহামারী মোকাবেলার জন্য স্পষ্টভাবে অক্ষম, সেখানে দেশজুড়ে লকডাউনের সিদ্ধান্তই ছিল একমাত্র উপায়। কিন্তু মোদি সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে মহামারীর হুমকি মোকাবেলায় ধীরে এগিয়েছে। জানুয়ারিতে যখন চীনে ভাইরাসটা ব্যাপক হারে ছড়াচ্ছিল, মোদি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা তখন মধ্য প্রদেশের কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাতে ব্যস্ত ছিল। অন্য দলের সাথে দর কষাকষির মাধ্যমে বিজেপি কংগ্রেসের জয়তীআদিত্য সিন্দিয়াকে তার ২২ জন আইনপ্রণেতাসহ ভাগিয়ে দিতে সক্ষম হয়। কংগ্রেস সরকারের পতন হয় এবং বিজেপি সেখানে সরকার গঠন করে।
ইউরোপে কোভিড-১৯ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পরার পরও মোদি এবং তার মন্ত্রীরা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে বিপুল সংখ্যায় জড়ো হয়েছেন। যেমন প্রেসিডেন্ট জে পি নাড্ডার ছেলের বিয়েতে তারা জড়ো হয়েছিলেন। কিছু বিজেপি নেতা – যাদের মধ্যে আইনপ্রণেতারাও ছিলেন – তারা ভাইরাস মোকাবেলায় গোবর খাওয়ার পরামর্শ দেন এবং মধ্য প্রদেশের একজন সিনিয়র বিজেপি নেতা এমনকি এটাও বলেন যে, “আমাদের কিছুই হবে না। আমাদের ৩৩ মিলিয়ন দেবতা আমাদেরকে রক্ষা করবেন”।
মার্চের মাঝামাঝি এসে মোদি সরকার শেষ পর্যন্ত হুমকির বিরুদ্ধে জেগে ওঠার চেষ্টা করে। পশ্চিম বঙ্গ, কেরালা ও দিল্লীর সরকারগুলো এর আগেই কাজে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু রাজ্য সরকারগুলো যখন জোর চেষ্টা চালাচ্ছিল এবং সীমিত লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মিডিয়ার মাধ্যমে চিন্তাভাবনার মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছিল, সেই পর্যায়ে ২৪ মার্চ মোদি হঠাৎ করে টেলিভিশনে এসে সারা দেশে লকডাউন জারি করলেন। আর এর প্রস্তুতির জন্য মাত্র চার ঘন্টা সময় দেয়া হলো জনগণকে।
কংগ্রেস এমপি শশী থারুর এর তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন যে, তড়িঘড়ি এই লকডাউনের ঘোষণা দেয়ার যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, সেখানে বিশাল জনগোষ্ঠির দুর্দশার বিষয়টি মোটেই বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
থারুর বলেছেন, “ডিমোনিটাইজেশান থেকে নিয়ে এখনকার লকডাউন পর্যন্ত, মোদি সরকার দরিদ্র ও অসহায় মানুষের দুর্দশা নিয়ে এতটাই অনুভূতিহীনতা দেখিয়েছে, যেটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে”।