আমরা লাইভে English শনিবার, জুন ০৩, ২০২৩

যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তানে আটকে রাখার আগ্রহ নেই ইরানের

TOP NEWS-ENG-14-07-2020

যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের প্রায় অন্তহীন দ্বন্দ্ব সিরিয়া, ইরাক ও ভেনেজুয়েলাসহ বেশ কিছু জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। এই জায়গাগুলোতে তাদের স্বার্থের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। দুই দেশের সম্পর্ক এখনও উত্তপ্ত। এ অবস্থায় পশ্চিমা মূলধারার মিডিয়াগুলোতে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, ইরান চায় আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হোক এবং তারা যুক্তরাষ্ট্রকে সেখানে ফাঁদে ফেলে আটকে রাখতে চায়, যাতে তাদের আরও বহু বিলিয়ন ডলার সেখানে ব্যয় হয়, এবং সেটা যাতে মার্কিন অর্থনীতির উপর আরও চাপ সৃষ্টি করে, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে যে অর্থনীতি এমনিতেই চাপের মধ্যে আছে। 

যুক্তিটা এ রকম: ইরান যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও আর্থিক নিষেধাজ্ঞার প্রতিশোধ নিতে চায়। জেনারেল সোলায়মানি হত্যার প্রতিশোধটাও এভাবেই নিতে চায় তারা। 

যেমনটা দেখা যাচ্ছে, আদর্শিক পার্থক্য এবং ইসলামের দুটো ভিন্ন এবং প্রায় বিপরীত সম্প্রদায়ের অনুসারী হওয়া সত্বেও তালেবানদের সাথে ইরানের সম্পর্ক ক্রমেই উষ্ণ হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হলো আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের অবস্থানের বিরুদ্ধে তারা পরস্পরের অভিন্ন অবস্থানকে সংহত করেছে। 

এই ধরনের চিন্তাভাবনা রাশিয়ার ব্যাপারে সিআইএ’র সাম্প্রতিক তথ্য প্রকাশের মতো, যেখানে তারা অভিযোগ করেছে যে, মার্কিন সেনাদের হত্যার জন্য রাশিয়ানরা তালেবানদের কথিত অর্থ দিয়েছে।  

আরও পড়ুনঃ মধ্যপ্রাচ্যকে কি ‘পরিত্যাগ’ করছে যুক্তরাষ্ট্র?

তবে, আমরা যখন বাস্তব প্রেক্ষাপটে এবং ইরানের মূল স্বার্থের জায়গা থেকে বিষয়টি দেখি, তখন মনে হয় যে, আফগানিস্তানে মার্কিন সেনারা উপস্থিত না থাকলে ইরানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ আরও ভালোভাবে সংরক্ষিত হবে। 

অন্যভাবে বললে, এই অঞ্চলটি যখন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে থাকবে না এবং ইরানের ঠিক পাশেই যখন মার্কিন সামরিক ঘাঁটি থাকবে না, যেখান থেকে যে কোন সম্ভাব্য মার্কিন-ইরান যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ইরানের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে সেখানে হামলা চালাতে পারবে না, সেই অবস্থায় ইরানিরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে। 

আসলে ইরানিরা আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা ও হস্তক্ষেপ কমানোর ব্যাপারে অনেক বেশি আগ্রহী। সম্প্রতি দোহাতে ইরানের দূত যখন তালেবানদের সাথে বৈঠক করেছেন, তখন এই বার্তাটাই দেয়া হয়েছে। ইরান ‘আন্ত:আফগান’ সংলাপকে শুরুর প্রয়োজনীয়তাকেই শুধু সমর্থন দেয়নি, বরং একই সাথে এই প্রক্রিয়াকে মার্কিন প্রভাব এবং হস্তক্ষেপের আওতামুক্ত রাখার বিষয়ে বেশি করে জোর দিয়েছে। 

Lifts-Top-bangla-14 July 2020-1

ইরানের চিন্তাভাবনার কারণ হলো তাদের পর্যালোচনা অনুযায়ী বিশেষভাবে মার্কিন প্রভাবের অধীনে যদি শান্তি প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়, তাহলে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণে মার্কিন ভূমিকা থাকবে বেশি। কাবুলের উপর প্রভাবের আকারে অব্যাহত মার্কিন উপস্থিতি থাকার অর্থটাও হলো ইরানের ভূমিকা এখানে সীমিত থাকবে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষার সুযোগও থাকবে সীমিত। 

একইভাবে, ইরানের ‘ফাঁদে পড়ে’ আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র যদি আরও দীর্ঘ সময় অবস্থান করে, তাহলে দেশটির অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। 

সে জন্য যেহেতু ইরান আর আফগানিস্তানের মধ্যে শতছিদ্র সীমান্ত রয়েছে এবং আফগানিস্তানের চলমান সঙ্ঘাতের কারণে হাজার হাজার মানুষ ইরানে আশ্রয় নিয়েছে, সে কারণে ইরান চাইবে যাতে তাদের পূর্বের সীমান্তে স্থিতিশীলতা আসে এবং যত দ্রুত সম্ভব সেখানে সঙ্ঘাত নিরসন হয় যাতে শরণার্থীদের ঢেউ আর ইরানে প্রবেশ না করে। 

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, শরণার্থীদের অব্যাহত প্রবাহের কারণে ইরানের বিপর্যস্ত অর্থনীতির উপর সেটা বাড়তি বোঝা হবে, যেটা প্রথমত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং এখন মহামারীর কারণে এমনিতেই বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। 

এর বিপরীতে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার-পরবর্তী স্থিতিশীল আফগানিস্তান ইরানী পণ্যের জন্য একটা সম্ভাবনাময় বাজার হয়ে উঠবে। 

আরও পড়ুনঃ আফগান সরকারের কঠোর অবস্থান, ঝুঁকিতে মার্কিন-তালেবান চুক্তি

একইসাথে তালেবানদের সাথে ইরানের সম্পর্ক উন্নয়নের অর্থ এটা নয় যে, তারা উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়েছে এবং তাদের তিক্ত অতীত বর্তমানের উপর কোন প্রভাব ফেলবে না। 

তালেবান আর তেহরানের প্রতিদ্বন্দ্বিতার তিক্ত ইতিহাস রয়েছে। ১৯৯৮ সালে আফগানিস্তানের ভেতরে ইরানি কূটনীতিক হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশ যুদ্ধের প্রায় দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। 

তেহরান এটা বুঝে যে, তালেবানদের কট্টরপন্থী অংশ, যারা স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান আর সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ, তারা শর্তহীনভাবে ক্ষমতায় আরোহন করলে ইরানের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। 

তবে, এমনকি তালেবান নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে কট্টর ব্যক্তিরাও আফগানিস্তানে তৎপর ইসলামিক স্টেটের ভগ্নাংশের (ইসলামিক স্টেট ইন খোরাসান) মতো কট্টরপন্থী নয়। 

তালেবানরা আইএস-কে’র শত্রু হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই তেহরানের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে তালেবানরা। এটা থেকেই বোঝা যায় যে, তেহরান কেন স্বেচ্ছায় তালেবানদের সাথে সম্পর্ক মেরামতে সোচ্চার হয়েছে এবং অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে তাদেরকে সমর্থন দিচ্ছে। 

Lifts-Top-bangla-14 July 2020-2

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আইএস-কে বড় ধরনের ও ভয়াবহ সহিংসতা চালানোর সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে, যার মধ্যে মে মাসে জানাযার নামাজে এবং প্রসূতি ওয়ার্ডে নারকীয় হামলার বিষয়টিও রয়েছে। এই হামলাগুলো হয়েছে আফগানিস্তানের পূর্ব প্রান্তে পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায়, যেটা ইরান থেকে অনেক দূরে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতি বদলে গেলে অভিন্ন শত্রুর মোকাবেলার ক্ষেত্রে তালেবানদের সমর্থন পাবে ইরান। 

একইসাথে তালেবানরা এই সত্যের ব্যাপারে অজ্ঞ নয় যে, দুটো বড় আঞ্চলিক শক্তি রাশিয়া আর চীনের সাথে ইরানের শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। 

সম্প্রতি ইরান ঘোষণা দিয়েছে যে, চীনের সাথে ২৫ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি তারা চূড়ান্ত করছে। এটা স্পষ্ট যে, এই পরাশক্তিগুলো আইএস-কে জঙ্গিবাদীদের ব্যাপারে ইরানের উদ্বেগের বিষয়টিকে নিজেদের জন্যও গুরুতর মনে করে। 

তাছাড়া, চীন এবং রাশিয়া উভয়েই যেহেতু তালেবানদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, সে কারণে আফগানিস্তান তালেবান আধিপত্যের অধীনে চলে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে ইরানকে তত বেশি উদ্বিগ্ন হতে হবে না। 

২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তান/তালেবানের ব্যাপারে ইরানের হিসেব স্পষ্টভাবেই বদলে গেছে যখন আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের ব্যাপারে পরোক্ষ গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছিল তারা। 

তালেবানদের অধীনস্থ আফগানিস্তান আর তেহরানের রাজনৈতিক ও আদর্শিক প্রতিদ্বন্দ্বী হবে না। চীনের সংযোগ কর্মসূচি যেভাবে এ অঞ্চলের ভূ-অর্থনীতিকে নতুন রূপ দিচ্ছে, সেখানে এই তত্ত্বের ভিত্তি খুবই দুর্বল যে, তেহরান আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রকে ফাঁদে ফেলে আটকে রাখতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ফাঁদে’ ফেলার জন্য তালেবানদের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন করেনি তেহরান। বরং যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এসে যে আফগানিস্তান আঞ্চলিক সংযোগ প্ল্যাটফর্মগুলোর সাথে যুক্ত হচ্ছে, সেই আফগানিস্তানের সাথে সম্পর্কে সামঞ্জস্য আনতেই এটা করেছে তারা।