আমরা লাইভে English শনিবার, জুন ০৩, ২০২৩

শ্রীলংকায় ৫ আগস্টের নির্বাচনে প্রাধান্য পাচ্ছে যেসব ইস্যু

Annotation 2020-08-05 185422

রাজাপাকসাদের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন শ্রীলংকা পোদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) ৫ আগস্টের শ্রীলংকার পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তবে, সেখানে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারা পেতে পারে, আবার না-ও পেতে পারে। এর কারণ হলো বিরোধী দলগুলো ভেঙ্গে গেছে এবং কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসা। 

আগের সরকারে চরম ব্যর্থতার কারণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিঙ্গের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) এবং সাবেক আবাসন মন্ত্রী সাজিথ প্রেমাদাসার নেতৃত্বাধীন সামাগি জন বালাবেগায়া (এসজেবি) রয়েছে খুবই দুর্বল অবস্থায়। 

এর পরও, নির্বাচনী প্রচারণায় জটিল অনেক ইস্যু সামনে উঠে এসেছে, যেগুলো শ্রীলংকার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। 

সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ

২০১৯ সালের নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এসএলপিপি স্বচ্ছন্দ্যে সংখ্যালঘু তামিল আর মুসলিমদের ভোট ছাড়াই জিতে গেছে। মূলত সিংহলি বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠির প্রতি আবেদনের উপর ভিত্তি করে তারা এই জয় পেয়েছে। এবারও তারা একই কৌশল গ্রহণ করেছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতার পর অনেকেই আশা করেছিলেন যে প্রেসিডেন্ট গোতাবায় রাজাপাকসা জাতীয় ঐক্য ও কার্যকর সরকার গঠনের জন্য তামিল আর মুসলিমদের সাথে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু সেই বিভাজনটাকে তিনি জিইয়ে রেখেছেন এই আশায় যে, পার্লামেন্ট নির্বাচনেও সেটা তাদেরকে ভালো ফল দেবে। 

Lifts-Top News-Bangla-3 August 2020 _1

যেহেতু তার আগ্রহেই আগাম নির্বাচনের দিকে গেছে শ্রীলংকা, সে কারণে তিনি বিরোধীদলের আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন যে, কোভিড-১৯ এর কারণে নির্বাচন অনির্দিষ্টাকালের জন্য স্থগিত করে বিলুপ্ত পার্লামেন্ট আবার সক্রিয় করা উচিত। তবে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে প্রেসিডেন্ট কোভিড-১৯ মোকাবেলায় যে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন, সেটা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে তাকে সাহায্য করেছে। সে কারণে, বিরোধী দলের সামরিকায়নের অভিযোগ খুব একটা কাজে লাগেনি। 

একই কৌশলের অংশ হিসেবে এসএলপিপি সরকার ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিলের বোমা হামলার ঘটনাটি পুনরায় তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মাধ্যমে সহিংস ইসলামি জঙ্গিদের ব্যাপারে সিংহলি বৌদ্ধদের আতঙ্ককে তারা সজিব রেখেছে। জনপ্রিয় মুসলিম নেতা রিশাদ বাথিউদ্দিন নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করেছিলেন যাতে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই তদন্ত স্থগিত রাখা হয়, কিন্তু তাদের আবেদন নাকচ হয়ে গেছে। এদিকে, বর্তমান সরকার মন্ত্রিসভায় কোন মুসলিমকে নিয়োগ দেয়া থেকে বিরত রয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো শ্রীলংকার মন্ত্রিসভায় কোন মুসলিম প্রতিনিধি নেই। 

তামিলরা যে ফেডারেল সংবিধান এবং তামিল অধ্যুষিত নর্থ ও ইস্ট অঞ্চলের জন্য সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়েছে, এসএলপিপি সুনির্দিষ্টভাবে সেটা নাকচ করে দিয়েছে। এসএলপিপি বরং ভারত-প্রভাবিত ১৩তম সংশোধনীটি পুনরায় বিবেচনার কথা বলেছে, যেখানে সামান্য স্বায়ত্তশাসনের বিধানসহ নির্বাচিত প্রাদেশিক কাউন্সিলের কথা বলা হয়েছে। এসএলপিপি নেতারা বলছেন যে, প্রাদেশিক কাউন্সিলের কাছে ক্ষমতা না দিয়ে স্থানীয় তৃণমূল পর্যায়ের ক্ষমতা দিয়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হতে পারে। তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (টিএনএ) নর্দার্ন প্রভিন্সিয়াল কাউন্সিল পরিচালনার ক্ষেত্রে যে দারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, সেটাকে প্রাদেশিক কাউন্সিলের ব্যর্থতার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। 

তামিল পুনরুত্থানবাদ

এসএলপিপি যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে তামিলদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে আসছে, তাই তামিলদের দর এখন অনেক বেড়ে গেছে। সকল তামিল দলগুলো একটি কেন্দ্রীয় সংবিধান তৈরি করেছে যেখানে সংযুক্ত নর্থ আর ইস্ট অঞ্চলকে সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে, এবং এটাকে তারা তাদের প্রধান দাবি হিসেবে তুলে ধরছে। কিন্তু নর্দার্ন প্রভিন্সের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সি ভি বিগ্নেসরনের নেতৃত্বাধীন তামিল পিপলস ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (টিপিএনএ) দাবি করেছে যাতে জাতিগত ইস্যুতে তামিলরা যে সব সমাধানের দাবি করছে, সেগুলোর জন্য যাতে জাতিসংঘের অধীনে তামিলদের মধ্যে একটা গণভোটের আয়োজন করা হয়। টিপিএনএ’র ম্যানিফেস্টোতে আরও বলা হয়েছে যে, কথিত গণহত্যার জন্য লংকান সরকারকে তারা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে নিয়ে যাবে। মধ্যমপন্থী টিএনএ ফেডারেল ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছে এবং যুদ্ধের সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুগুলোর সমাধানের জন্য আংশিক আন্তর্জাতিক বিচারিক মেকানিজম গঠনের দাবি জানিয়েছে।

Lifts-Top News-Bangla-3 August 2020 _2 

কিন্তু এই দাবিগুলোর কোনটাই এসএলপিপি’র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এসএলপিপি সামরিক বাহিনীর সপক্ষে এবং এই দাবিগুলোকে তারা দেশবিরোধী এবং অবমাননাস্বরূপ মনে করে। ইউএনপি এবং এসজেবি আরও বিকেন্দ্রীকরণ চায়, কিন্তু সেটা হবে একক সংবিধানের অধীনে। অন্যদিকে তামিল দলগুলো জোর দিয়ে বলছে যে, জাতিগত প্রশ্নে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ থাকতেই হবে, এসএলপিপি যেটাকে দেশবিরোধী মনে করে। ইউএনপি আর এসজেবি কাগজে কলমে লংকান-আন্তর্জাতিক মিশ্র বিচারিক সিস্টেমের পক্ষে, কিন্তু বাস্তবে তারা সেটা চায় না বলে তারা ক্ষমতায় থাকাকালে মনে হয়েছে। জাতিগত ইস্যুতে সিংহল-তামিলদের মধ্যে বিভাজন রয়েছে। 

মুসলিমরা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানায় না, তবে তারা চায় তাদের সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় অধিকার যাতে সংরক্ষিত হয়। রাজনৈতিক উচ্চপদস্থ জায়গাতেও নিজেদের অবস্থান চায় তারা। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি বৌদ্ধ এবং এসএলপিপি এই দাবিগুলোতে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে না এবং এগুলোকে ইসলামি স্বতন্ত্রবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং এমনকি সন্ত্রাসবাদের সূচনা হিসেবে মনে করে, বিশেষ করে ২০১৯ সালের ইস্টার সানডের বোমা হামলার পর থেকে তাদের এই মনোভাব তৈরি হয়েছে। মুসলিমরা সেভাবে জোরালোভাবে তাদের কণ্ঠস্বর জানান দিচ্ছে না, কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, তারা এসএলপিপিকে ভোট দেবে না। 

এটা ধারণা করা যায় যে, নির্বাচন পরবর্তীকালে এসএলপিপি সরকার তাদের সিংহলি বৌদ্ধ ভোট ব্যাংককে আরও সুসংহত করার চেষ্টা করবে, বিশেষ করে তাদের বাহ্যিক, রাজনৈতিক ও আদর্শিক চাহিদাগুলো মেটানোর মাধ্যমে তারা এটা করবে। 

কেন্দ্রীকরণ

কলম্বোতে শক্তি কেন্দ্রীভূত করে একটা শক্তিশালী সরকার গঠনের যে আকাঙ্ক্ষা রয়েছে এসএলপিপি’র, সেটা সবারই জানা। প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসা – যিনি এসএলপিপি’র নির্বাচনী প্রচারণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তিনি ১৯তম সংশোধনী ছাড়াই নতুন সংবিধান গ্রহণের ডাক দিয়েছেন। ১৯তম সংশোধনীতে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে কাটছাট করে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও চাকরিচ্যুতির ক্ষমতাগুলো বিভিন্ন স্বাধীন কমিশনের কাছে দেয়া হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে সংবিধানের এই সংশোধনীর অধীনে সরকারী কর্মকর্তাদেরকে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং চাকরিচ্যুতির ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

Lifts-Top News-Bangla-3 August 2020 _3 

২০০১ সালের ১৭তম সংশোধনীর মাধ্যমে কন্সটিটিউশনাল কাউন্সিল এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন গঠনের পর থেকে প্রতিটি সরকার এবং প্রেসিডেন্ট এই অনির্বাচিত বডিগুলোর বাধার মুখে পড়েছে। সবশেষ বাধার মুখে পড়েন প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা, যিনি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ পুজিথ জয়াসুন্দারাকে শাস্তি বা বরখাস্ত করতে পারেননি, যদিও ভারতের কাছ থেকে গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার পরও এই কর্মকর্তা ইস্টার সানডের হামলা ঠেকাতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। ১৯এ ধারা অনুযায়ী, আইজিপিও কোন কর্মকর্তাকে নিয়োগ বা বদলি বা বরখাস্ত করতে পারবেন না, যদিও তার কাছে ওই কর্মকর্তার সক্ষমতা বা দক্ষতার প্রত্যক্ষ প্রমাণ রয়েছে। 

১৯এ ধারা নিয়ে ক্ষোভের একটা বড় কারণ হলো, এর মধ্যমে নির্বাহী প্রেসিডেন্টের হাত বেঁধে ফেলা হয়েছে, যিনি সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। এতে প্রধানমন্ত্রীর শক্তিকেও কাটছাট করা হয়েছে, যিনি নির্বাচিত পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পেয়ে থাকেন। সে কারণে ১৯এ ধারাতে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টের প্রতি জনগণের সমর্থনকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। 

২০১৫-২০১৯ সালের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, ১৯এ সংশোধনীটি মূলত প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, আর পার্লামেন্টের ক্ষমতা নিয়ে বিভ্রান্তির একটা সমষ্টি মাত্র, যেখানে একটি প্রতিষ্ঠানকে আরেকটির উপরে কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে। 

এসএলপিপি চায় ১৯এ বাতিল করা না গেলেও এটাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা। ১৮তম সংশোধনী (১৮এ) পুনরায় ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দেয়া হতে পারে, যেটা মাহিন্দা রাজাপাকসা ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে উত্থাপন করেছিলেন। ১৮এ’র মাধ্যমে ২০০১ সালের ১৭তম সংশোধনী (১৭এ) বাতিল করা হয়েছিল, যেটার মাধ্যমে কন্সটিটিউশনাল কাউন্সিল ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন গঠনের মাধ্যমে নির্বাহী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছিল। তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা। ১৮এ সংশোধনীতে কন্সটিটিউশনাল কাউন্সিলের বদলে পার্লামেন্টারি কাউন্সিল গঠন করার প্রস্তাব রয়েছে এবং এর মাধ্যমে অনির্বাচিত বডি থেকে নির্বাচিত বডির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে। 

Lifts-Top News-Bangla-3 August 2020 _4

এসএলপিপি ১৯এ কাটছাটের কোন পদক্ষেপ নিলে ইউএনপি ও এসজেবির পাশাপাশি টিএনএ’র দিক থেকেও প্রতিরোধ আসবে, কারণ তারাই ছিল এই সংশোধনীর প্রণেতা। তবে, টিএনএ’র মুখপাত্র এম এ সুমান্তিরান যেমনটা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এই দলগুলো ১৯এ’র কিছু অকার্যকর উপাদান সংশোধনের প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। এটাও বলা হয়েছে যে, প্রয়োজনে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে এসএলপিপি ইউএনপি, এসজেবি এবং কিছু মুসলিম এমপিকে নিজেদের দলে ভিড়াতে পারে। কারণ সংবিধান সংশোধনের জন্য তাদের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। 

পররাষ্ট্রনীতি

পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে এসএলপিপি আর বিরোধীদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। প্রস্তাবিত মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশান কমপ্যাক্টের ভূমি ইস্যু এবং কথিত যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নিয়ে এসএলপিপি প্রকাশ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আর পশ্চিমা দেশগুলোর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কলম্বো বন্দরের ইস্টার্ন টার্মিনাল এবং ত্রিনকোমালি তেল ট্যাঙ্কে ভারতের বিনিয়োগ নিয়েও ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ক্ষমতাসীন সরকার। কিন্তু ইউএনপি আর এসজেবি এই সব ইস্যুতে অন্যদের আরও অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী। এসএলপিপি যেখানে সন্দেহাতীতভাবে চীনপন্থী, সেখানে অন্যরা বেইজিংয়ের ব্যাপারে কিছুটা উদ্বিগ্ন, এবং মূলত পশ্চিমাপন্থী। 

সে কারণে এতে অবাক হওয়ার বেশি কিছু নেই যে, বিদেশী শক্তিগুলোও ৫ আগস্টের নির্বাচনের ফলাফলের জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছে।