কলম্বো বন্দরে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ: ভারতের কাজ পাওয়া এখনো অনিশ্চয়তায়

শ্রীলঙ্কায় কলম্বো বন্দরের পূর্ব কনটেইনার টার্মিনালের (ইসিটি) নির্মাণ কাজের দায়িত্ব ভারতকে দেয়া হবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চিয়তা কিছুতেই কাটছে না। ভারতকে এই কাজ দেয়ার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী মনোভাব প্রবল।
শ্রীলঙ্কা পোর্ট অথরিটি (এসএলপিএ) এবং পক প্রণালীর ওপারে ‘বিগ ব্রাদার’ ভারত ও জাপানের গঠিত একটি কনসর্টিয়ামকে ইসিটি নির্মাণের দায়িত্ব দেয়ার ব্যাপারে গোতাবায়া রাজাপাকসা সরকার প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলো। তার আগে ভারত-পন্থী হিসেবে পরিচিত প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমসিঙ্ঘের সরকার এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
বর্তমান অনিশ্চয়তার জন্য আসন্ন ৯টি প্রাদেশিক কাউন্সিল নির্বাচন দায়ি বলে অনেকে মনে করছেন। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কাজটি ভারত-জাপানকে দেয়া হলে উগ্র-জাতীয়তাবাদি ও স্বার্থবাদি গ্রুপগুলো নির্বাচনে ক্ষমতাসীন শ্রীলঙ্কা পদুজানান পেরামুনা (এসএলপিপি)’র জন্য অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। উগ্র-জাতীয়তাবাদি জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিভি) ইতোমধ্যে ইস্যুটি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। রাজাপাকসা পারিবারের নেতৃত্বাধীন এসএলপিপি নিজেদেরকে জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। যার জের ধরে তারা যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম তহবিলও ফিরিয়ে দিয়েছে। এটা ছিলো ক্ষমতাসীনদের উগ্র-জাতীয়তাবাদীদের তোষণ করার চেষ্টা।
বিপুল শক্তিমত্তা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে এসএলপিপি। কিন্তু তাদেরকে এখন এন্টি-ইনকমবেন্সি সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। করোনাভাইরাস মোকাবেলা করতে গিয়ে কঠোর লকডাউন দিয়ে তাদেরকে এমনিতেই জনগণের বিরাগভাজন হতে হয়। লকডাউনের কারণে কর্মসংস্থান ও মানুষের আয়ের উপর প্রভাব পড়েছে। ফলে এই মুহূর্তে ইসিটি কোন বিদেশীকে দেয়া হলে তা বিরোধীদের হাতে একটি মোক্ষম অস্ত্র তুলে দেয়া হবে।
বিলম্বের কৌশল
ইসিটি উন্নয়নের কাজ ভারতকে দেয়ার বিষয়টি মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে বলে যে খবর বেরিয়েছে গত ২২ ডিসেম্বর তা অস্বীকার করেছেন এসএলপিএ চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল দায়া রত্নায়েক। তিনি জানান, দুটি কমিটি উন্নয়নের বিষয়টি মূল্যায়ন করছে। একটি কমিটি ইতোমধ্যে স্থানীয়দের জন্য বিনিয়োগ সুযোগ-সংশ্লিষ্ট সুপারিশ পেশ করেছে।
তিনি মিডিয়াকে বলেন, এসব কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাতে পারে।
এই টার্মিনাল উন্নয়নের জন্য বিক্রমসিঙ্গে সরকার ২০১৯ সালের মে মাসে ভারত ও জাপানের সঙ্গে এমওইউ চুক্তি সই করে। চুক্তি অনুযায়ী এর ১০০ ভাগ মালিকানা থাকবে এসএলপিএ’র। কিন্তু ভেতরের কাজ করবে টার্মিনাল অপারেশন কোম্পানি (টিওসি) নামে আরেকটি কোম্পানি, যার মালিকানা হবে যৌথ। সেখানে এসএলপিএ’র অংশ ৫১%, জাপানের ৩৪% ও ভারতের ১৫%।
ইসিটি উন্নয়নে ৫০০-৮০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে জাপান, যা ৪০ বছরে শোধ করা হবে।
এই প্রকল্পে ভারতের সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে রত্নায়েক বলেন, শ্রীলঙ্কার যত ট্রান্সশিপমেন্ট বিজনেস হয় তার ৮২% হয় ভারতের সঙ্গে। এর আবার ৬১% হয় কলম্বো বন্দরের মাধ্যমে।
তাই ভারতকে যুক্ত করা হলে ভারতীয় শিপিং লাইনের মাধ্যমে প্রচুর ব্যবসা আসতে পারে। এই অঞ্চলে অনেক বন্দর থাকায় প্রতিযোগিতাও অনেক তীব্র।
তবে বন্দরের কাজ প্রদানের ব্যাপারে এখানো কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়ার বিষয়টি রত্নায়েক নিশ্চিত করেছেন।
ব্যর্থতার আশঙ্কা
ইসিটির জন্য প্রথম টেন্ডার ডাকা হয় ২০১৫ সালে। কিন্তু সব দরপত্রদাতাকে অযোগ্য ঘোষণা করে তৎকালীন মন্ত্রিসভা কমিটি।
২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও ২০২০ সালের আগস্টে পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় এই ইস্যু তোলে জাতীয়তাবাদীরা। এসএলপিপি প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা জয়ী হলে সব জাতীয় সম্পদ নিজেদের হাতে রাখবে।
কিন্তু বিষয়টি এত সহজ নয়। কারণ ভূকৌশলগত কারণে ভারত এখানে কাজ করতে চাচ্ছে। পাশে কলম্বো ইন্টারন্যাশনাল কনটেইনার টার্মিনাল (সিআইসিটি) পরিচালনা করছে একটি চীনা কোম্পানি।
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিমণ্ডলে শ্রীলঙ্কাকে যুক্ত করতে চাচ্ছে ভারত। কলম্বোতে মেরিটাইম সিকিউরিটির সচিবালয় করা হচ্ছে। ভারত মনে করে কলম্বো বন্দরের কাজ পাওয়ার বৈধ অধিকার তাদের রয়েছে।
রাজাপাকসা সরকার এই বন্দরের জন্য যখন ঋণের বদলে এফডিআই চাইলো তখন জাপান বলে যে তারা বিনিয়োগকারী হতে রাজি।
কাজ শুরু করার জন্য ইসিটি’র ডেকও খালি করা হয়েছিলো। কিন্তু করোনাভাইরাস এসে সব কাজ বন্ধ করে দেয়। এখন সেখানে শ্রমিক বিক্ষোভ চলছে বিদেশীদের কাজটি দেয়ার বিরুদ্ধে।
বিলম্বের মূল্য
এ ব্যাপারে শিপার্স একাডেমি কলম্বোর সিইও রোহান মাসকারোলা বলেন, সরকার যে ঢিলেঢালা মনোভাব দেখাচ্ছে তাতে ট্রা্সশিপমেন্ট প্রবৃদ্ধি ১০% কম হবে।
তিনি বলেন, সাত বছর ধরে বিষয়টি ঝুলে আছে। ইসিটি চালু হলে কলম্বো বন্দরের জট কমে আসতো বা থাকতো না। তাহলে ৫%-৬% কম ট্রান্সশিপমেন্ট হতো না। সিঙ্গাপুরে জট তৈরি হওয়ায় কলম্বোতে ব্যবসা আসতো।
তিনি এই লেখককে বলেন যে, অন্য টার্মিনালগুলো কাছাকাছি হওয়ায় ইসিটিকে দ্রুত উন্নয়ন করা উচিত। এতে জাহাজ বন্দরের ভিড়তে পারতো দ্রুত।
জাপানি সূত্রগুলো জানায় যে, ভারতীয়দের টাকা নিয়ে চিন্তা করা উচিত নয়, কারণ এই বন্দর অবশ্যই লাভজন হবে।