আমরা লাইভে English শনিবার, জুন ০৩, ২০২৩

চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আবারো স্বাভাবিক করার পথেই হাটছেন মোদি

TOP NEWS-ENG-02-07-2020

নরেন্দ্র মোদি সরকারের চীন নীতি যদিও যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্রশান্ত কৌশলের সাথে জড়িত, যেখানে চীনকে ‘শত্রু রাষ্ট্র’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তবে বিতর্কিত ভূখণ্ড/সীমান্ত এলাকায় সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ, ভারত ও চীনের মধ্যে সঙ্ঘাত এবং সেখানে ভারত যে আঘাত পেয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত এই সত্যটা উন্মোচিত হয়ে গেছে যে, ভারতীয় নীতির ভিত্তিটাই শুধু দুর্বল নয়, বরং এই ঘটনাপ্রবাহ তাদেরকে চীনের সাথে সম্পর্ক ‘পুনরায় স্বাভাবিকীকরণের’ দিকে যেতে বাধ্য করেছে। 

যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে কূটনৈতিক সহায়তা দেয়া সত্বেও ভারতের দিক থেকে এই ‘রিসেট মুড’ চালু করা হয়েছে। 

এখানে যেটা দেখা গেছে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নিয়েও ভারত চীনের মাথা নোয়াতে পারেনি বা সীমান্তবর্তী বিতর্কিত অঞ্চলগুলো নিয়ে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করার জন্য অন্যান্য প্রতিবেশীদের বল প্রয়োগে রাজি করাতে পারেনি। 

আরও পড়ুনঃ দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেকে এত নিঃসঙ্গ আর দেখেনি ভারত

সে কারণে সম্পর্ক পুনরায় স্বাভাবিক করাটা অবশ্বম্ভাবী ও কৌশলগত প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভারতে বিভিন্ন পর্যায়ে এই পুনঃস্বাভাবিকীকরণ ঘটেছে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অঙ্গনে মোদি সরকার সর্বদলীয় সম্মেলনের (এপিসি) কৌশল গ্রহণ করেছে। লাদাখে চীনের তথা-কথিত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ‘জাতীয় ঐক্যমত’ গঠনে সমন্বিত সামরিক ও কূটনৈতিক জবাব দেয়ার জন্যই শুধু এটা করা হয়নি, বরং এখানে এই ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে, এতদিনের চীন নীতি সরকারের জন্য কাজ করেনি, যে সরকার তাদের ভোটারদের উজ্জীবিত করতে এবং ভোট-ব্যাংক সম্প্রসারনের জন্য উগ্র জাতীয়তাবাদী হিন্দুত্ব আদর্শকে ব্যবহার করে থাকে। 

ভারতীয় সেনারা যদিও আঞ্চলিক আধিপত্য ও হিন্দুত্ববাদের শ্রেষ্ঠত্বের আদর্শে বিশ্বাসী, তবু তারা চীনা সেনাদের বিরুদ্ধে সফল হতে পারেনি। এর অর্থ বর্তমান সরকার শুধু সামরিক দিক থেকেই পরাজিত হয়নি, বরং রাজনৈতিকভাবেও হেরে গেছে। আর সে কারণেই এই পুনঃস্বাভাবিকীকরণ, যদিও হিন্দুত্ববাদের বিভিন্ন অনুসঙ্গগুলো এখনও চীনের বিরুদ্ধে আগ্রাসী নীতি গ্রহণের ঢোল বাজিয়ে চলেছে, এবং তাদের নিহত সেনাদের পক্ষে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ‘পাল্টা আঘাত হানার’ দাবি জানাচ্ছে। 

Lifts-Top News-Bangla-2 July 2020-1

অন্যদিকে, সর্বদলীয় সম্মেলনের মাধ্যমে এটা বোঝা গেছে, ভারত চীনের বিরুদ্ধে এ ধরনের একটি যুদ্ধে শুধু পরাজিতই হবে না, বরং এ ধরনের একটি যুদ্ধ ভারতের জন্য মহা-বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। 

এই প্রেক্ষাপটে, এপিসি’র উদ্দেশ্য এটা নয় যে, চীনের বিরুদ্ধে ‘শক্ত পদক্ষেপ’ নেয়ার জন্য মোদি সরকারের পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করা, বরং এর উদ্দেশ্য হলো বর্তমান সরকারের উপর চাপ কমানো এবং যুদ্ধের চেয়ে– তা সেটা যত সীমিতই হোক না কেন– আলোচনার মাধ্যমে সীমান্ত বিবাদ মেটানোটাই যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই বক্তব্যটাকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করা। 

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর যখন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে রাজনৈতিক চ্যানেল চালু করলেন যাতে দুই দেশের মধ্যে একটা মধ্যম অবস্থান খুঁজে বের করা যায় এবং উত্তেজনা নিরসন করা যায়, তখনও তার পেছনে উদ্দেশ্য এটাই ছিল। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আরআইসি (রাশিয়া, ভারত, চীন) ভার্চুয়াল কনফারেন্সের আগে এটা করা হয়েছে। 

Lifts-Top News-Bangla-2 July 2020-2

এটা বলা হয়তো অতিরিক্ত হবে যে, ভারতের পররাষ্ট্র নীতি একেবারে উল্টা বাঁক নিয়েছে এবং নিজেদের নীতিগুলোর আঞ্চলিকীকরণের ব্যাপারে দেশের নেতারা হঠাৎ করেই সজাগ হয়ে উঠেছেন, কিন্তু এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আরআইসি বৈঠকে ভারতের অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য ছিল চীনের সাথে দর কষাকষির দরজা খোলা রাখা এবং সম্ভব হলে রাশিয়াকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিয়ে আসা। 

একইসাথে উল্টা দিক থেকে চিন্তা করলে, মোদি সরকার যদি লাদাখে তথা-কথিত ‘চীনা আগ্রাসনের’ অজুহাত দেখিয়ে আরআইসি বৈঠকে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকতো এবং যুদ্ধের ঢোল বাজানো জারি রাখতো, তাহলে নিশ্চিতভাবে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের পুতুলে পরিণত হতো তারা, এবং একটি উদীয়মান পরাশক্তির বিরুদ্ধে একটি বিলীয়মান পরাশক্তির সাথে তাদেরকে জোট বাঁধতে হতো।

এটা নিশ্চিত যে, ভারত এ ধরনের একটি ধারণা দিতে চায়নি। সেটা শুধু তাদের নিজের স্বার্থেই নয়, বরং অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের স্বার্থে তারা এটা এড়িয়ে গেছে। 

আরও পড়ুনঃ চরম বিশৃঙ্খলায় পড়েছে মোদির ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি

তবে, গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: আরআইসিতে ভারতের অংশগ্রহণ এবং ইউএনএসসিতে ভারতের স্থায়ী আসনের পক্ষে রাশিয়ার সতর্ক সমর্থন কি বিশ্বের দরবারে ভারতের অবস্থান সংহত করার জন্য যথেষ্ট হবে?

ইউএনএসসিতে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদের পক্ষে রাশিয়ার সমর্থন দেয়ার অর্থ এটা নয় যে, ভারত-চীন অচলাবস্থার মধ্যে রাশিয়া একটি পক্ষ নিচ্ছে এবং ভারতকে তারা সমর্থন করছে। তাছাড়া, এতেও কোন সন্দেহ নেই যে, রাশিয়ার চেয়ে অনেক বেশি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে আছে ভারত। আর বিবদমান ইস্যুগুলো সমাধানের জন্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনাকেই সমর্থন করে রাশিয়া। ‘কোয়াডে’ ভারতের অব্যাহত অংশগ্রহণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের গভীরতর প্রতিরক্ষা সম্পর্ক কোনভাবেই রাশিয়ার দৃষ্টি এড়াবে না। 

মোদি সরকারের অধীনে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বেশ কতগুলো প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। এগুলোর মাধ্যমে একে অন্যের সশস্ত্র বাহিনী থেকে পারস্পরিক লজিস্টিক্স সহায়তা নেয়ার বিষয়টি উন্মুক্ত হয়েছে (লজিস্টিক্স এক্সচেঞ্চ মেমোরান্ডাম অব এগ্রিমেন্ট বা এলইএনওএ), যেটার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাডভান্সড প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে ভারত, এবং আরেকটি চুক্তির (কমিউনিকেশান্স কমপ্যাটিবিলিটি অ্যাণ্ড সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট বা সিওএমসিএএসএ) মাধ্যমে ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদনের প্রাইভেট খাতগুলোর সাথে মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর অংশীদারিত্বের পথ উন্মুক্ত হয়েছে। 

Lifts-Top News-Bangla-2 July 2020-3

রাশিয়া ও চীন উভয়েই অন্য দেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ করতে শিখেছে যদি না সেটার সরাসরি কোন প্রভাব তাদের উপর পড়ে। এবং অবশ্যই, উভয়েই তারা একে অন্যের মূল জাতীয় স্বার্থগুলোকে শ্রদ্ধা করতেও শিখেছে। 

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের গভীর সম্পর্ক এবং সুস্পষ্ট কৌশলগত জোটবদ্ধতার কারণে চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক সমস্যাগ্রস্তই থেকে যাবে। এবং, এমনকি ভারত যদি সেটা পুনরায় স্বাভাবিক করতেও চায়, সেখানে বিশ্বাস অর্জনের মতো একটা প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে অনেক সময় লেগে যাবে। এ জন্য কিছু শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বিশেষ করে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগের মাধ্যমে সীমান্ত বিবাদ মিটিয়ে ফেলতে হবে। 

তবে, এপিসি ও আরআইসির উদাহরণ দেখে মনে হচ্ছে, লাদাখের মানসিক আঘাত ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে একটা অতিরিক্ত ধাক্কা দিয়েছে যাতে তারা সঙ্ঘাত নিরসনের জন্য অ-সামরিক ও অ-হিন্দুত্ববাদী পথে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে।