আমরা লাইভে English শনিবার, জুন ০৩, ২০২৩

দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেকে এত নিঃসঙ্গ আর দেখেনি ভারত

TOP NEWS-ENG-30-06-2020-2

দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকেরা ভারত-চীন সঙ্ঘাতকে তাদের মার্কিন প্রতিপক্ষদের চেয়ে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন। ভারতীয়রা ঠিক মার্কিন সুরে কথা না বললেও অনেক ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক দৃশ্যত ধারণা করছেন যে এটা হলো চীনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক সঙ্ঘাতের অংশবিশেষ এবং পরাশক্তির মর্যাদা লাভের ভারতীয় আকঙ্ক্ষাকে অনুমোদন করবে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে ভারত একথা বিশ্বাস করুক যে চীনের সাথে তার সঙ্ঘাত চীনের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করছে। কিন্তু ইন্দো-চীন সঙ্ঘাত যদি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বৈশ্বিক দ্বন্দ্বের অংশ না হয়ে আঞ্চলিক সীমান্ত ইস্যু হিসেবে বিরাজ করে, তবে সবার জন্যই ভালো। 

তবে ট্রাম্পের কাছের লোক ও দীর্ঘ দিনের সুপার হক জন বল্টন তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের তালিকায় ভারত নেই। বরং যুক্তরাষ্ট্র চায় চীনের সাথে হাত মেলাতে। আর ভারত আঞ্চলিক প্রক্সি হিসেবে তার ভূমিকা পালন করতে পারে। ভারতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে শক্তিশালী হওয়ার স্ব-সৃষ্ট ধারণা জাঁকিয়ে বসে আছে। আবার বিশ্ব করোনা জ্বরে থর থর করে কাঁপতে থাকার প্রেক্ষাপটে চীনও সবাইকে গলা ফাটিয়ে একথা বলতে আগ্রহী যে, হিসাবে আনার মতো অন্য একমাত্র শক্তি হলো তারাই এবং কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই তার প্রতিদ্বন্দ্বী। অবশ্য, যুক্তরাষ্ট্র ‘প্রক্সি’ হিসেবে দেখার কারণে ভারত যদি চীনকে উচিত শিক্ষা দিতে চায়, তবে সে নিজেই এর শিকার হয়ে যেতে পারে।

Lifts-1-Top News-Bangla-30 June 2020-দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেকে এত নিঃসঙ্গ আর দেখেনি ভারত

আঞ্চলিক পরিস্থিতি: ১৯৭১-২০২০

ভারত মনে করে, সে হলো আশপাশের এলাকায় একমাত্র বাঘ। ১৯৭১ সালে সর্বোচ্চ অবস্থায় ভারত দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রতিটি রাষ্ট্রকে তার পক্ষপুটে নিয়ে আসে, তার একমাত্র শত্রু পাকিস্তান শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। আজ এই অঞ্চলে তার কোনো বন্ধু নেই, অঞ্চলটি ব্যাপকভাবে বদলে গেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করা হয় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় বন্ধুপ্রতীম বাংলাদেশের জন্ম হয়। এখন মৃত সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থন করেছিল ভারতকে, ওই সহায়তা করা হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের অংশ হিসেবে। ভারত এখন আবার ওই পর্যায়ে উপনীত হতে চায়।

চীন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের হাত ধরার সময় তার তেমন ভালো অবস্থা ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানকে তার ইতিহাসের সবচেয়ে বিপর্যয়কর মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে সহায়তা করেনি।

ভারতের উচিত এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বন্ধুত্ব বলে কোনো ধারণা নেই, আছে কেবল সুবিধা ও জাতীয় স্বার্থ। বিষয়টি সবার জন্য প্রযোজ্য।

আরও পড়ুনঃ আশেপাশে কেন বন্ধু নেই তা দেখতে হবে ভারতকে

অবশ্য চীনের প্রতি স্থায়ী বৈরিতা অবলম্বন করাটা ভারতের জন্য সহায়ক হবে না। কিছু সময়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্র হয়তো এ ধরনের বৈরিতাকে উৎসাহিত করবে, কিন্তু কোনো না কোনো আকারে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বড় ধরনের বাণিজ্যচুক্তি হওয়া মাত্র ভারতকে ‘গরম আলুর’ মতো ফেলে দেয়া হতে পারে। সীমান্ত সঙ্ঘাত থেকে ভারত বা চীন কেউ লাভবান হবে না।

এই লেখকের ১৯৭১ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, ভারত ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভয়াবহভাবে আহত হয়েছিল। এতে ভারতের গর্বে চীন এমনভাবে আঘাত করেছিল, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। এ কারণে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) বড় ধরনের সামরিক অভিযানের প্রশ্ন এলে ভারত পার্বত্য গিরিপথগুলোতে বরফ না পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকে, যাতে চাইলেও পাকিস্তানের সহায়তায় এগিয়ে আসতে না পারে চীনা সৈন্যরা। এতটাই গভীর ছিল ক্ষতটি।

Lifts-2-Top News-Bangla-30 June 2020-দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেকে এত নিঃসঙ্গ আর দেখেনি ভারত

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলছেন, সীমান্ত বিরোধ সত্ত্বেও ১৯৭৫ সাল থেকে চীন-ভারত সীমান্তে কোনো গুলি হয়নি। তবে ক্রোধ ছিল এবং বিরোধও ছিল। এই পর্যায়ে এসে তা বিস্ফোরিত হয়েছে। ভারত তার মর্যাদায় আরেক দফা বিপর্যয় ছাড়া আর কিছুই পায়নি। শারীরিক সহিংসতায় ভারতীয় সেনাবাহিনী সৈন্য হারিয়েছে, কিন্তু লাভবান হয়নি। সঙ্ঘাতটি অনেকটা ‘সুরেল কমেডি’র মতো মনে হলেও এতে পাথর আর কাঁটাতার প্যাঁচানো মুগুর ব্যবহৃত হওয়ায়  লড়াইটি নৈরাজ্যকর প্রকৃতিতে পরিণত হয়েছে।

এটা আসলে এই অঞ্চলে ভারতের দুর্দশার প্রতিক্রিয়া, ভারতের উচিত হবে খুবই গুরুত্ব দিয়ে এটি পাঠ করা। ভারত যখন বৈশ্বিক শক্তির মর্যাদা তালুবন্দী করার চেষ্টা করছে, তখন সে তার প্রতিবেশী অঞ্চলটিই খুইয়ে ফেলেছে। ভারত এমন নিঃসঙ্গ আর কখনো ছিল না, এমনকি তার সর্বশেষ অনিচ্ছুক মিত্র বাংলাদেশ পর্যন্ত প্রবোধমূলক কিছু করেনি। আর বোধগম্য কারণেই ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে কেবল মার্কিন মিডিয়া। 

আরও পড়ুনঃ প্রতিবেশীদের প্রতি ভারতের ভীতি প্রদর্শনই চীনকে শক্তিশালী করেছে

মার্কিন অবস্থান

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের তৈরী একটি প্রতিবেদনে, ভারতের বেশ কিছু মিডিয়া এর উদ্ধৃতি দিয়েছে, বলা হয়েছে যে ভারতীয় সামরিক বাহিনী অনেক বেশি শক্তিশালী- তাদের হাতে আছে অনেক বেশি বিমান, তাদের সৈন্যরা অনেক বেশি দক্ষ- এবং ভারত হলো আত্ম-অবমূল্যায়নের শিকার। অন্য কথায় বলা যায়, ভারত যা চিন্তা করে, তার চেয়ে ভালো করা উচিত। বিশেষজ্ঞরা যুদ্ধের প্রস্তাব করেননি, তবে বলছেন যে ভারত নিজেকে যতটা মনে করে, তার চেয়ে সে বেশি শক্তিশালী। এই বার্তায় সূক্ষ্মভাবে ভারতকে বোকার মতো কিছু কাজ করতে ইন্ধন দেয়া হয়েছে। (https://www.belfercenter.org/sites/default/files/2020-03/india-china-postures/China%20India%20Postures.pdf)

পরিস্থিতির অবনতি হলে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হবে, আর সঙ্ঘাত না হলে লাভবান হবে ভারত। এই মুহূর্তে ভারত ছাড়া আর কোনো হাতিয়ার নেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। ভারত জয়ী হওয়ার মতো অবস্থায় আছে, এমনটি কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনী মনে করেন না, বরং এই ধারণায় মজে আছে দেশটির মিডিয়া ও পররাষ্ট্র দফতরের একটি অংশ। যুদ্ধের চেয়ে ভালো কোনো যুদ্ধ নেই এবং ভারত ও চীন উভয়ে তা স্বীকার করে, কিন্তু লাদাখের ঘটনা প্রমাণ করেছে, কত দ্রুত পরিস্থিতি হাত থেকে ফসকে যেতে পারে, এমনকি সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি অংশ মনে করে, ইন্দো-চীন যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভালো, তবে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যাতে মনে হতে পারে যুদ্ধরত কোনো পক্ষের জন্য তা কল্যাণকর হবে। শক্তি ও অস্ত্রের জোরে সীমান্ত সুরক্ষিত রাখার জন্য অনেক বেশি সময় ব্যয় করা হয়েছে, কিন্তু শান্তির হাতিয়ারগুলো ব্যবহার করার জন্য তেমন সময় খরচ করা হয়নি। আর মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র সহায়ক নয়।