শ্রিংলার ঝটিকা সফর: বাংলাদেশ কি তার কার্ডগুলো দেখিয়েছে?

ভারতীয় কোন কর্মকর্তার রহস্যময় ঢাকা সফরের মধ্যে এটা ছিল অন্যতম। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা হঠাৎ বিমানে ঢাকা এলেন এবং কয়েকটি বৈঠক করে ফিরে গেলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হলো ভ্যাকসিন পরীক্ষার বিষয়ে আলোচনা ছিল এটা। কথায় সত্যতা থাকতে পারে, কিন্তু কেউ সেটা বিশ্বাস করেনি। সফরের যে সব কারণ জানানো হয়েছে, সেটার কারণে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে জল্পনাই শুধু বেড়েছে।
বাংলাদেশ আর ভারতের সম্পর্ক যেভাবে শান্তি আর ধারাবাহিকতার সাথে চলে আসছিল, সেখানে এ ধরনের জরুরি সফরের কোন প্রয়োজন ছিল না। পাশের প্রতিবেশী দেশ যে কোন সময় টেলিফোন করতে পারে। জরুরি ভিত্তিতে সফরের মতো কোন ‘সীমান্ত’ ইস্যুও সামনে নেই।
“তাহলে কেন? এই প্রশ্নটাই জিজ্ঞাসা করছে ঢাকা। যদিও গুজব সৃষ্টিকারী ও জল্পনার সোশাল মিডিয়া অনেকটাই দ্বিধায় পড়ে গেছে। বাংলাদেশ কি করেছে, যে কারণে তার প্রতি এই বিশেষ মনোযোগ দেয়া হচ্ছে?
আরও পড়ুনঃ শেখ হাসিনার সামনে অগ্নি পরীক্ষা
গুরুত্বপূর্ণ কি না?
ভারতীয় মিডিয়াসহ অন্যান্য মিডিয়ার রিপোর্ট বলছে, এই সফর ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কৌতুহলের ব্যাপার হলো বাংলাদেশের মিডিয়া এমনকি এটা উল্লেখ পর্যন্ত করেনি, কারণ এটা ঘটেছে একেবারে শেষ মুহূর্তে। বাংলাদেশের কোন সীমান্ত বিবাদ নেই, কোন সামরিক পরিকল্পনা নেই, এমন কোন রাজনীতিও নেই যেটা ভারতকে উদ্বিগ্ন করতে পারে। কেউ আসছে না, কেউ যাচ্ছেও না। বাংলাদেশের সোশাল মিডিয়া হয়তো ভারত কি বলছে বা করছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামায়, কিন্তু শেখ হাসিনার বাংলাদেশ সরকার সেটাতে গুরুত্ব দেয় না, তারা তাদের নিজস্ব জীবন যাপন করছে।
কারণ নিয়ে গুঞ্জন
সফরের কারণ হিসেবে তিনটি বিষয় নিয়ে জল্পনা চলছে:
ক) ভারত চায় বাংলাদেশ যাতে তিস্তা বা অন্যান্য প্রকল্পগুলোর জন্য বড় ধরনের ঋণ না নেয়। খ) সীমান্ত ইস্যুসহ অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশ চীনের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় ভারত সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন। গ) আঞ্চলিক ও দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে অভিন্ন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে ভারত আগ্রহী।
জনগণের আগ্রহ হলো ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে বাংলাদেশীদের হত্যা বন্ধ হোক এবং সেই সাথে আছে রোহিঙ্গা ইস্যু। আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে যে, একটি বিমান করিডোর চালু এবং ভ্যাকসিন পরীক্ষার জন্য এই সফর করা হয়েছে। কিন্তু কেউ হয়তো বলবেন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে বলেই এ রকম সফর হয়েছে। আর এই ধারণাটা সহসাই চলে যাবে না।
যত অনানুষ্ঠানিকই হোক এই সফর, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় আসেন অফিসিয়াল বিমানে। বলা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তরফে বার্তা নিয়ে এসেছিলেন তিনি, যে কারণে এই সফরকে অফিশিয়াল বলা যায়। এর পরও তার নিয়ে আসা পণ্যের ‘গুরুত্ব’ থাকা সত্বেও আচরণ করা হয়েছে অনেকটাই অস্বাভাবিক।
বিমানবন্দরে শ্রিংলাকে কোন আনুষ্ঠানিক প্রটোকল দেয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের জন্য পুরো দিন তাকে অপেক্ষায় রাখা হয়েছে এবং কোন যৌথ বিবৃতি দেয়া হয়নি। অবশ্যই এটা হতে পারে যে, এর পেছনে খুবই যৌক্তিক এবং এমনকি নির্দোষ কারণ রয়েছে, কিন্তু এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি গ্রহণ করে নেয়াটা কঠিন।
ত্রিপক্ষীয়বাদ
যে বিষয়টা এই সময়টাতে ইন্দো-বাংলা সম্পর্ককে চালিয়ে নিচ্ছে, সেটা হলো অভিন্ন স্বার্থ। ১৯৭১ উভয়ের পক্ষে ছিল, সে কারণে অভিন্ন উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে ফল পাওয়া গিয়েছিল। এরপর যেটা হয়েছে, সেটা হলো ভারতের আধিপত্য আর বাংলাদেশের নতজানু হওয়া। চীনের উত্থানের সাথে সাথে সেই সমীকরণটা বদলে যেতে শুরু করেছে। অর্থনৈতিক স্বার্থের পাশাপাশি সম্ভবত কৌশলগত দিক থেকেও বাংলাদেশের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছে চীন। বেল্ট অ্যাণ্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) চীনকে আগের চেয়েও শক্তিশালী করে তুলেছে।
ত্রিপক্ষীয়বাদ সক্রিয় রয়েছে যেখানে চীন-ভারতের সম্পর্ক একইসাথে দেশ দুটির সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের উপরও প্রভাব ফেলে। কোন বৈরিতা তৈরি হলে দুই দেশই বাংলাদেশকে তুষ্ট করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ পরিস্থিতিটাকে অতিক্রম করতে দেয়, কারণ এখান থেকে তারা উপকৃত হয়। এ ক্ষেত্রে, যে অধিকতর ভালো ও বড় প্রস্তাব দেবে, সে-ই এখানে জয়ী হবে। এখানে নতুন শীতল যুদ্ধের কোন নীতি নেই, আছে বাস্তবিক সুবিধা অর্জনের বিষয়। উভয়কেই এখানে উন্নততর ‘জোট’ পণ্য বিক্রি করতে হবে।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কাউকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অবস্থানে নেই বাংলাদেশ, এমনকি মিয়ানমারকেও নয়। সামরিক দিক থেকে বাংলাদেশ সেই ভানও করে না। মজার ব্যাপার হলো, সেটাই দেশটিকে সবচেয়ে ভালো সুরক্ষা দেয়। বাংলাদেশ কোন হুমকিদাতা দেশ নয়। ভারত এখানে হামলা করতে পারবে না বা বহু মিলিয়ন শরণার্থীও পাঠাতে পারবে না। বাংলাদেশের উপর কিভাবে তাহলে চাপ দেয়া যাবে? আর চীনের সাথে তো অভিন্ন কোন সীমান্তই নেই।
আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের সেকেলে ধারণা উল্টা ফল বয়ে আনবে
চীন কার্ড?
এটাও বলা হয়েছে যে, বিআরআই এখানে প্রধান অস্ত্র কিন্তু চীন বিমান অবতরণ ও অন্যান্য সুবিধাসহ বাংলাদেশ থেকে আরও ছাড় চায়। এগুলোর মোকাবেলা করতে হলে ভারতকে আরও বেশি প্রস্তাব নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু চীনের অর্থ প্রচুর, ভারতের তা নেই। তাই চীন আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে। ভারতের যে একতরফা সম্পর্ক ছিল, সেটা একটা বড় ধরনের হোচট খেয়েছে।
এটা একটা জল্পনা, কিন্তু বন্ধুত্বের আলিঙ্গন না দেখিয়ে, বাংলাদেশ ভারতকে তার কার্ডগুলো দেখিয়েছে। ভারত যতদিন পর্যন্ত শুধু বন্ধুত্বের বক্তৃতা শুনিয়ে যাবে এবং এর বেশি কিছু দিতে পারবে না, ততদিন তারা খেলতে পারবে না। বাংলাদেশ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেবে না। আর সে কারণে প্রতিদান হিসেবে কিছু চায় তারা, ন্যাশনাল সিটিজেন্স রেজিস্টার নয়। এটা মনে হতে পারে যে, ভারত এটাকে স্বাভাবিক হিসেবে নিয়েছে। কিন্তু আরেকটু বোঝাপড়ার সাথে এগুলো গ্রহণ করা হলে তা উভয়ের জন্যই ভালো হবে।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ ধরনের সফরের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য উভয়কেই আরও ভালোভাবে কাজ করতে হবে। জরুরি ঝটিকা সফরের কারণ হিসেবে ভ্যাকসিন পরীক্ষা আর এয়ার করিডোরের কথা বলা হলে তাতে এখানকার মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে অপমান করা হয়।