আমরা লাইভে English শনিবার, জুন ০৩, ২০২৩

করোনাভাইরাস দমনে পদ্ধতিগত ত্রুটি ও অস্থির বাংলাদেশ

bangladesh-virus-230520-01

রাজনৈতিক তৎপরতা এমনিতেই ধীর হয়ে পড়েছিলো কিন্তু করোনা সঙ্কট তা একেবারে স্থবির করে দিয়েছে। পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেয়া হবে তার চেয়ে বেশিরভাগ মানুষ এখন উদ্বিগ্ন জীবন ও জীবিকা নিয়ে। ভিন্নমতের প্রতি খুব একটা সাড়া মিলছে না।

পরিস্থিতি যখন এই, তখন বাংলাদেশ সরকার জনগণকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে ক্ষমতাসীন দলের ‘কোন নেতার জন্য অপমানজনক’ হয় এমন কোন সমালোচনা মেনে নেয়া হবে না। এমন সমালোচনা করার জন্য এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (ডিএসএ) গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে পুলিশি তদন্ত চলছে। ফলে বিরোধীরা যে রাজনৈতিক সুবিধা পাবে বলে ভেবেছিলো তা তারা পাচ্ছে না।

তাই যে বার্তাটি আসছে সেটা হলো বিরোধী দলের রাজনীতি ছাড়াই জীবন চলতে পারে। আরো সাদামাটাভাবে বললে, রাজনীতির দরকার নেই। এ কথার প্রতিবাদও করছে না তেমন কেউ।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ, রাজনীতি নির্জীব

রাজনৈতিক তৎপরতার জায়গা না থাকায় সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বরাবরের মতোই নির্জীব অবস্থায় রয়েছে। তবে রাজনীতির জায়গা এখন যেটি রয়েছে তা শুধু ভার্চুয়াল বা কল্পবাস্তব। এখন নতুন রাজনৈতিক ময়দান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ফেসবুক। এখানে মিলিত হয়ে সবাই আলোচনা, সমালোচনা ও তাদের মতামত তুলে ধরতে পারেন। অনেক দিন ধরেই ভৌত রাজনৈতিক স্থানটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর করোনাভাইরাসের কারণে এখন সেটির অস্তিত্বও তেমন একটা নেই ।

প্রথমদিকে বেশ কিছু গ্রুপ সরকারের তীব্র সমালোচনা করলেও তারাও এখন মলিন হয়ে পড়েছে বা ইতোমধ্যে মলিন হয়ে গেছে। ফেসবুকে বিবৃতি ও পোস্ট দেয়ার ক্ষেত্রে বামপন্থী/এলিট শ্রেনীর মিশ্রণে একটি গ্রুপ ছিলো খুবই সক্রিয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এগুলো উপেক্ষা করা যেতো। তাদের জন্য ফেসবুকে পোস্ট দেয়াই একমাত্র উপায়। তবে সেটাও কমে গেছে।

অন্যান্য গ্রুপের মধ্যে ত্রাণকর্মী ও রাজনৈতিক এক্টিভিস্টরা রয়েছেন। বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাদেরও বিচার পাওয়ার সুযোগ কমে গেছে। আদালতে ধর্না দেয়ার সুযোগ আগের চেয়ে অনেক কম। পরিস্থিতি বিরোধীদের জন্য হয়ে উঠেছে অত্যন্ত প্রতিকূল। আর ক্ষমতাসীন দল যেকোন সময়ের চেয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

তাই বলে সরকারের হোচট খাওয়া বন্ধ নেই। কোন সমালোচনাই সরকারের জন্য হুমকি নয়। তাই বলে, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে, সরকার কখনো নিরাপদ থাকে না। দুই ব্যাংকার গ্রুপের মধ্যে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ এর একটি খারাপ উদাহরণ। অবশ্য এটা কোন রাজনৈতিক হুমকি নয়। যদিও ভালো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার জন্য রাজনৈতিক নিরাপত্তা কোন গ্যারান্টি নয় কিন্তু করোনা ও করোন-উত্তর চ্যালেঞ্জ ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে।

লকডাউনের রাজনৈতিক অর্থনীতি

সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপের কারণে লকডাউন শিথিল করতে বাধ্য হচ্ছে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলো। আবার জনগণের একটি বড় অংশকে পীড়নের মধ্যে না রেখে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও দীর্ঘ সময় লকডাউন চালিয়ে যেতে পারে না। ব্রাক, পিপিআরসি ও আইএমএফসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার করা সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে যে বেশিরভাগ গরীব মানুষ তাদের আয়ের বড় অংশ হারিয়েছে।

এটা বাংলাদেশের গরীব জনগণের সামলে ওঠার সামর্থে্যর বিষয়টি কঠিনভাবে মনে করিয়ে দেয়। এই অবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবার শুরু করা জরুরি ছিলো। কিন্তু গত দুই মাস ধরে যে লকডাউন চলে তাকে অনেক চেষ্টা করেও পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। বেশিরভাগ মানুষ এই লকডাউনকে তাচ্ছিল্য করায় এখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাওয়ার আশা বৃথা। আর এখন লকডাউন শিথিল, আধা-চলাচল শুরু হওয়ার পর দ্রুত বাড়ছে সংক্রমণ।

আরো পড়ুনঃ দক্ষিণ এশিয়া ও কোভিড-১৯ রাজনীতির উত্থান

এটা অবরুদ্ধ পরিস্থিতির উপর আরো চাপ সৃষ্টি করেছে। গণস্বাস্থ্য কাঠামো পর্যাপ্ত নয় এবং তা বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় ব্যাপক আকারে সংক্রমণ সামাল দিতে পারছে না। বড় বড় শহরগুলোর বাইরে হাসপাতালের সুবিধা তেমন একটা নেই। তাই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে মৃত্যু হার মোকাবেলা করা বড় একটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে।

প্রশাসনের রাজনীতি

বিশ্বের বেশিরভাগ সরকারের মতো বাংলাদেশ সরকারও প্রস্তুত ছিলো না, এটা ঠিক। কিন্তু সে কেন প্রশাসনের অগ্রাধিকার ঠিক করতে আরো বেশি মনযোগী হয়নি। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থা কখনোই সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিলো না।

শহরের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থা এরই মধ্যে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে এবং রোগীরা হাসপাতাল থেকে বিমুখ হয়ে ফিরে যাচ্ছে। আতঙ্ক এতটাই যে কেউ যদি করোনা আক্রান্ত বলে সন্দেহ হয় তাহলে তার পরিবারের সদস্যরা পর্যন্ত তাকে পরিত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। তাই শুধু সমাজই যে অজ্ঞ তা নয়, এই অজ্ঞতা দূর করতে তেমন সফল কোন গণস্বাস্থ্য প্রচারণাও ছিলো না।

এটা কোন কট্টর দলীয় রাজনীতির ইস্যু নয়। এটা রাষ্ট্রের প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত, যার সঙ্কট সামাল দেয়ার দক্ষতা ও সামর্থ্য উভয় ক্ষেত্রেই ঘাটতি আছে বলে মনে হচ্ছে।

যেখানে সঙ্কট দেখা দিচ্ছে সেখানেই দুর্বলতা ভেসে উঠছে। রাষ্ট্রের সামর্থ্য বৃদ্ধি প্রয়োজন। এটা কোন অরাজনৈতিক দলীয় কাজ নয়, এটা একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক করণীয়। এখানে শত্রু আছে এবং আমাদের সবার জীবনের জন্য হুমকি তৈরি করেছে। এক দিন করোনা সঙ্কট হয়তো চলে যাবে কিন্তু এই ত্রুটিগুলো থেকে যেতে পারে। তাই ক্ষমতাসীন শ্রেনীসহ সবার উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। এটা বাংলাদেশে একার নয়, এটা একটি বৈশ্বিক সমস্যা।