আমরা লাইভে English মঙ্গলবার, মে ৩০, ২০২৩

পাকিস্তানকে পররাষ্ট্র নীতির সঙ্কটে ঠেলে দিয়েছে ইব্রাহিমি চুক্তি

TOP NEWS-ENG-26-09-2020 (1)
হোয়াইট হাউজের সাউথ লনে ইব্রাহিমি চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও অন্য নেতারা

ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়া এবং তাদের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রশ্নটি নিশ্চিতভাবে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে ‘মুসলিম বিশ্বের’ সামনে একটা মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাত যদিও এখনও রয়েছে, তবে ইসরাইলের সাথে উপসাগরীয় অঞ্চলের সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ হওয়ায় এই সঙ্ঘাতের তীব্রতা অনেকটাই কমে গেছে; কারণ ইসরাইলের দখলদারিত্ব ও বর্বরতা এবং ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন আর মুসলিম বিশ্বের কাছ থেকে আগের মতো সমর্থন পাবে না। উপসাগরীয় আরব ব্লক যদিও ইসরাইলের প্রতি নমনীয়তা দেখাচ্ছে, এবং অনেকেই আশা করছে যে, সৌদি আরব ও আরও কিছু দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের পথে হাঁটবে। কিন্তু তুরস্ক আর ইরানের মতো অনারব বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সিদ্ধান্তকে ফিলিস্তিন প্রশ্নে ‘বড় ধরনের প্রতারণা’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। সে কারণে যে রাজনৈতিক বিভাজনরেখা তৈরি হয়েছে, সে অবস্থায় বিশ্বের প্রায় সবগুলো মুসলিম দেশের জন্যই পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন আনাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। 

পাকিস্তানের জন্য এটা সমানভাবে এবং বিশেষভাবে সত্য, যে দেশটির তুরস্ক আর সৌদি আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শক্তিশালী সম্পর্কের পাশাপাশি দেশের জনগণের মধ্যেও শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। সৌদি আরবকে যদি পবিত্র ভূমি হিসেবে দেখা হয়ে থাকে, তাহলে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তুরস্ককে দেখে খেলাফতের শেষ প্রতীক হিসেবে। ফিলিস্তিনিদের সমর্থন দেয়ার জন্য তুরস্ক যে জোরালো অবস্থান নিয়েছে, সেটা শুধু তাদের রাজনৈতিক শক্তিকেই সংহত করেনি, বরং তাদের কোমল শক্তিও বাড়িয়েছে। 

ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রশ্নে পাকিস্তানের অবস্থান পুরোপুরি তুরস্ক আর ইরানের পক্ষে, আরব আমিরাত বা সৌদি আরবের অবস্থানে নয়। সৌদি আরব যদিও ইসরাইলকে এখনও স্বীকৃতি দেয়নি, তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, যে বাহরাইন তাদের সামরিক নিরাপত্তার জন্য সৌদি আরবের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল, তারা সৌদির সম্মতি ছাড়া এই সিদ্ধান্ত নেয়নি। সে কারণে ইসরাইলকে সৌদি আরবের স্বীকৃতি দেয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিভিন্ন প্রতিবেদনে ইঙ্গিত মিলেছে যে, মোহাম্মদ বিন সালমান তার অসুস্থ বাবার মতো নন, এবং ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করাকে তিনি দেশের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটা করা উপকারী বলে মনে করেন। 

ফিলিস্তিন দখলদারিত্বের প্রশ্নে পাকিস্তান সবসময় ইসরাইলের বিরোধিতা করেছে। এখন উপসাগরীয় দেশগুলো ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য লাইন ধরার অর্থ হলো এই প্রশ্নে পাকিস্তান উপসাগরীয় দেশগুলোর বিরুদ্ধে চলে যাবে। এই বিরোধিতা নিঃসন্দেহে ওআইসির মতো প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত হবে, পাকিস্তান যেখানে (সৌদি বিরোধিতার মধ্যেও) কাশ্মীর ইস্যুটি নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করছে। 

তবে, প্রশ্নটা হলো সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতের বিরোধিতার জায়গায় পাকিস্তান কতদূর যেতে পারবে?

এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ, এ ব্যাপারে উপসাগরীয় দেশগুলোকে বিরোধিতা করার বিষয়টি শুধু রাজনৈতিক প্রশ্ন নয়, এর একটা বিশাল অর্থনৈতিক দিকও রয়েছে। 

অর্থনৈতিক সহায়তা, বিলম্বিত তেলের বিল, বহু মিলিয়ন কর্মীর কর্মসংস্থান এবং তারা পাকিস্তানে যে রেমিটেন্স পাঠায়, সেটা দেশের সবচেয়ে বড় অর্থের উৎস – এই সব ইস্যুতে পাকিস্তান উপসাগরীয় দেশগুলোর উপর এত বেশি নির্ভরশীল যে, সেখানে পাকিস্তানের সামনে বিকল্প খুবই সীমিত। তাছাড়া অর্থনীতির ক্ষেত্রে আরেকটি দিক হলো পাকিস্তানের অর্থনীতি এখনও নড়বড়ে অবস্থার মধ্যেই রয়ে গেছে। পুরনো মিত্রদের সাথে দূরত্ব তৈরি হলে দেশের সমস্যায় শুধু বাড়বে। 

এটা খুবই স্পষ্ট হয়ে গেছে যখন ওআইসির উচ্চ পর্যায়ে কাশ্মীর নিয়ে আলোচনায় পাকিস্তানের অব্যাহত জোরাজুরি এবং সৌদির নিষ্ক্রিয়তার ব্যাপারে সমালোচনায় ক্ষুব্ধ হয়ে সৌদি আরব পাকিস্তান থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের পুঁজি সরিয়ে নেয়। সৌদির এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের জন্য যথেষ্ট কঠোর ছিল এবং দুই দেশ যাতে আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারে, সে জন্য পাকিস্তানকে সংশোধনীমূলক পদক্ষেপ নিতে হয়। যদিও বৃহত্তম স্বতন্ত্র ভূরাজনৈতিক শক্তিগুলো এখনও দুই দেশের ‘ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্কের’ উপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। 

গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই একই স্বতন্ত্র ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনগুলোর কারণেই হয়তো পাকিস্তান উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর বিপরীতে আরও শক্ত ভূমিকা নিতে পারবে, সেটা স্বাভাবিকভাবে মনে করা যায় না। এটা স্পষ্ট হয়েছে যখন ‘মুসলিম উম্মাহ’র স্বঘোষিত নেতৃত্বের ব্যাপারে সৌদি আরবের অবস্থান নিয়ে শুধু উপসাগরের আরব দেশগুলোই নয়, বরং অনারব দেশগুলো থেকেও চ্যালেঞ্জ আসতে শুরু করেছে। এটা আরও স্পষ্ট হয় যখন দেখা যায় ইয়েমেন আর লিবিয়াতে এমনকি আরব আমিরাতও সৌদি আরবের সাথে এক অবস্থানে নেই। ইয়েমেনে সৌদি আরবের পাঁচ বছরের ব্যর্থতা তাদের বাহ্যিক শক্তির ক্ষতি করেছে। যেভাবে তারা বাছবিচারহীনভাবে ইয়েমেনে এখনও বোমা হামলা অব্যাহত রেখেছে, সেটা তাদের কোমল শক্তিকেও নষ্ট করে দেবে। 

তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিয়ে আফ্রিকা পর্যন্ত তাদের প্রভাব সম্প্রসারণ এবং তাদের অটোম্যান যুগের প্রভাব ফিরিয়ে আনার জন্যে যে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, সেটা আরব আমিরাত আর সৌদি আরবের জটিতলতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যভাবে বললে আরব আমিরাত যেখানে মুসলিম উম্মাহর নেতা হিসেবে সৌদি আরবের জায়গা নেয়ার চেষ্টা করছে, সেখানে তুরস্কও একই প্রতিযোগিতায় নেমেছে এবং নিজস্ব পন্থায় তারা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যেটা লিবিয়াসহ অন্যান্য জায়গায় সরাসরি আরব আমিরাতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। 

এই বহু বিভক্ত পরিস্থিতির কারণে পাকিস্তানের জন্য একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে পরিস্থিতিকে বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান সুবিধা নিতে পারে। 

তবে উপসাগরীয় দেশগুলোর উপর থেকে অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমাতে না পারলে এটা হয়তো সম্ভব হবে না। 

নির্ভরতা কমানোর একটি উপায় হলো শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তোলা। আরেকটি উপায় হলো নতুন বন্ধু সৃষ্টি, যারা পাকিস্তানকে সাহায্য করতে রাজি হবে। সৌদি আরব সম্প্রতি যখন তাদের পুঁজি সরিয়ে নিলো, পাকিস্তান তখন চীনের কাছে গেছে। পাকিস্তান যদি সিপিইসি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে ইরানকে সহ নতুন সিল্ক রোডের সাথে নিজের সমন্বয় করতে পারে, তাহলে পাকিস্তান নিশ্চিতভাবে দেশের ভেতরে ও বাইরে অর্থনীতির মানচিত্র নতুন করে গড়তে পারবে, নিজেদের তেল ও গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে, এবং সৌদি আরবের উপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে সেটা ইরানের দিকে নিতে পারবে।