আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহর সাথে কেন সংলাপে বসা দরকার পাকিস্তানের

২০০১ সালে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আফগানিস্তানে মোট সামরিক ব্যয় হয়েছে ৮২২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর, পররাষ্ট্র দফতর, ইউএসএআইডি এবং অন্যান্য সরকারী সংস্থাগুলোর ব্যয় রয়েছে। তবে প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। মানবিক ক্ষতির মধ্যে ২,৩০০ মার্কিন সেনা নিহত এবং ২০,৬৬০ জন আহত হয়েছে। মানসিক আঘাত পেয়ে যারা সমাজবিচ্যুত হয়ে পড়েছেন, তাদের হিসেব এখানে ধরাই হয়নি।
প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির হিসাবে ২০১৪ সালে তার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ৪৫,০০০ সদস্য নিহত ও ১০০,০০০ বেসামরিক মানুষ মারা গেছে। তালেবান পক্ষে হতাহতের হিসাব এখানে নেয়া হয়নি।
১৯৭৩ সালে দাউদ শাহ তার কাজিন রাজা জহির শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেকে আফগান প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট ঘোষণার পর থেকেই পাকিস্তানের সাথে দেশটির সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পশ্চিম সীমান্তের এই ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবেলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল কমান্ডার আইজিএফসি ব্রিগেডিয়ার (পরে তিনি মেজর জেনারেল হন) এন কে বাবরকে। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের দুটো ক্যাম্পে বেশ কিছু আফগান শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল আমার ছেলেবেলার বন্ধু এসএসজি’র মেজর (পরে লে. কর্নেল) সালমান আহমেদ। এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন আহমেদ শাহ মাসুদ। আফগান যুদ্ধের সময় কান্দাহার অঞ্চলে সালমানের সাথে ছিলেন শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানিকজাই, এখন যিনি তালেবানদের রাজনৈতিক প্রধান হিসেবে দোহাতে আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্তানিকজাই আফগান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। আশির দশকে মুজাহিদিনদের সাথে যোগ দেয়ার পর তিনি সালমানের গঠন করা সামরিক কমিটিতে ছিলেন। পাকিস্তানের অধিকাংশ সেনাদের তুলনায় আমাদের ইতিহাসে সালমান অনেকগুলো যুদ্ধে লড়েছেন। তিনি বলেছেন, আফগানদের মধ্যে স্তানিকজাই সোভিয়েতের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সামরিক অভিযানে তার সাথে ছিলেন। এক সময় বিবিসি ডকুমেন্টারি তৈরির জন্য স্যান্ডি গালকে সাহায্য করেছিলেন সালমান। ডকুমেন্টারির নাম ছিল ‘আল্লাহ এগেইন্সট দ্য গানশিপস’।
বহু বছর ধরে যেটা স্বপ্নে ছিল, সেই শান্তি এখন আওতার মধ্যে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তালেবানদের সাথে বাস্তবমুখী চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র। আফগান অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়ার জন্য পরে আফগান সরকারের সাথেও ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে তারা।
শান্তি চু্ক্তির কাঠামো এবং এতে ত্রুটি-বিচ্যুতি যা-ই থাক, পাকিস্তানের ভূমিকা ছাড়া চুক্তিটা সম্ভব হতো না। আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধে পাকিস্তানের স্বার্থ রয়েছে এবং পাকিস্তানকে তাই এখানে শিক্ষা নিতে হয়েছে। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য পশতুনদের পেছনে অর্থ আর শ্রম দিয়ে এসেছে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ আর সামরিক পেশাদাররা। কিন্তু পাকিস্তানকে এ জন্য মূল্য দিতে হয়েছে। পাকিস্তানে আফগান শরণার্থীদের ঢল নামার পর সেটা দেশের অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সেই সাথে আফগানিস্তানের জন্যে যে সব মার্কিন অস্ত্র এসেছিল, সেগুলো চুরি করে সমাজের মধ্যে যে সামরিকায়ন ঘটানো হয়েছে, সেটাও বিপজ্জনক বাঁক নিয়েছে। পাকিস্তানী ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাইরের অর্থে ‘জিহাদি’ মানসিকতা শেখানো হয়েছে, যার ফলে আফগান আন্দোলনের উত্তরসূরি হিসেবে পাকিস্তানি তালেবানের জন্ম হয়েছে।
অনুন্নত ও আধা শাসিত উপজাতীয় এলাকাগুলোতে যে বিপদ সৃষ্টি হচ্ছিল, সেটা না বুঝে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দারা তালেবান আন্দোলনের পশতুন অংশের পেছনে অর্থ আর আস্থা রেখেছিল, আর এভাবেই আফগান সমাজ থেকে তাজিক আর উজবেকদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়।
এই জটিলতা বাড়ে, যখন নব্বইয়ের দশকে নিষ্ঠুর ও স্বার্থপর নবাগত গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারকে যুদ্ধে পাঠায় পাকিস্তানের গোয়েন্দারা। পাকতিয়া প্রদেশের কারুতি হেকমতিয়ার বিভিন্ন সময়ে আহমেদ শাহ মাসুদ আর অন্যদেরকে দূরে ঠেলে দেয়, এবং আফগানিস্তানের অন্যান্য গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে একই সাথে যুদ্ধ আবার তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। সোভিয়েত-পরবর্তীকালের ক্ষমতার শূণ্যতা পূরণের জন্য নিজের অবস্থানকে সংহত করতে তিনি প্রায়ই প্রতিপক্ষ গ্রুপগুলোর উপর হামলার নির্দেশ দিতেন। এই শত্রুতা থেকেই তিনি ১৯৭৬ সালে পাকিস্তানে আহমেদ শাহ মাসুদের গ্রেফতারের ব্যবস্থা করেন। পানশির উপত্যকায় মাসুদ আর হেকমতিয়ার একবার অভিযান চালানোর ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন, কিন্তু হেকমতিয়ার শেষ মুহূর্তে অংশ নেয়া থেকে সরে আসেন এবং মাসুদকে অসহায় অবস্থায় ফেলে দেন। মাসুদের বাহিনী সে বার কোনরকমে প্রাণ নিয়ে বেঁচেছিল।
নব্বইয়ের দশকে আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে আমাদের বন্দর, সড়ক, বিমান ঘাঁটি ও অন্যান্য সুবিধাদি ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে আফগানিস্তানের ব্যাপারে আমরা যে অদূরদর্শী নীতি গ্রহণ করেছিলাম, সেটা আমাদের মানবিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়িয়েছিল এবং পাকিস্তানের ভেতরেও তালেবানদেরকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। পাকিস্তান এখনও এই ব্যর্থ নীতির খেসারত দিচ্ছে।
এরপরও পাকিস্তানের যেটুকু প্রভাব বাকি ছিল, সেটা দিয়েই তারা তালেবানদের আলোচনার টেবিলে আনতে পেরেছে। তালেবান আর ঘানি সরকারের মধ্যে শান্তি আলোচনার এক সপ্তাহ পরেই মনে হচ্ছে যে, আলোচনার যেন কোন গন্তব্য নেই। প্রথম বৈঠকের পরে সেটা স্পষ্ট হয়েছে।
আফগান সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপর তালেবানদের কঠিন হামলা দিয়ে বোঝা যাচ্ছে দুই পক্ষের মধ্যে বিভাজন রয়েই গেছে। বারতি সমস্যা হলো তালেবান-বিরোধী পক্ষ আবার নিজেদের মধ্যে বিভক্ত। প্রথম ও দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুটোই বিতর্কিত হয়েছে এবং নির্বাচনের পরে ক্ষমতা পরিচালনা নিয়ে আশরাফ ঘানি আর ড. আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহর মধ্যে টানাপড়েন হয়েছে।
২৪ বছর বিদেশে থাকার পর জাতিসংঘের পদ ছেড়ে ২০০১ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফেরেন আশরাফ ঘানি। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সরকারে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন তিনি। অন্যদিকে আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ ছিলেন নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের সিনিয়র সদস্য এবং আহমেদ শাহ মাসুদের ঘনিষ্ট উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। পরে তিনি আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রায় পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন এবং প্রেসিডেন্ট কারজাই এবং আশরাফ ঘানির বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তিনি এবং সরকারী হিসেব অনুযায়ী প্রত্যেকবারই দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন তিনি। নির্বাচনে কারচুপি এবং ভোট গণনায় ত্রুটির অভিযোগ থেকে তিনি সরকারী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন এবং আলাদাভাবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন তিনি।
২০০৭-২০১২ সালে মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইস্ট-ওয়েস্ট ইন্সটিটিউট যে ধারাবাহিক ‘আফগানিস্তান রি-কানেকটেড’ সংলাপের আয়োজন করেছিল, সেখানে ব্রাসেলস আর বার্লিনের জন্য আমাকে ইডাব্লিউআই ডিরেক্টর করা হয়েছিল। ঘানি এবং ড. আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ উভয়ের সাথেই তখন দীর্ঘ কথা বলার সুযোগ হয়েছে আমার। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ইস্যুর ব্যাপারে দুজনেরই ব্যাপক জ্ঞান রয়েছে। ঘানিকে যদিও মাঝে মাঝে অন্যের ব্যাপারে বেপরোয়া মনে হয়েছে, কিন্তু ড. আব্দুল্লাহ সবসময়ই ছিলেন স্থিত, ভদ্র ও অন্যকে অন্তর্ভুক্ত করার মানসিকতা সম্পন্ন।
বার্লিন থেকে দুবাই ফেরার পথে এক ফ্লাইটে ঘটনাক্রমে ড. আব্দুল্লাহ আমার পাশে বসেছিলেন। পাকিস্তানের সাথে গঠনমূলক আলোচনায় কেন বসছেন না তিনি, এমন প্রশ্নে তার জবাব আমাকে স্তম্ভিত করেছিল: “আমরা চাইলেও, পাকিস্তান কি আমাদের সাথে কথা বলবে?” পাকিস্তানের তৎকালিন ক্ষমতাধরদের যখন আমি বলেছিলাম যে, ড. আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ অন্যান্য আফগানদের চেয়ে বাস্তবমুখী এবং পাকিস্তানের ব্যাপারে তার বাস্তব কিছু ক্ষোভ রয়েছে, যেগুলোর নিরসন হওয়া দরকার, তখন আমাকে ‘মুখ বন্ধ করতে’ বলা হয়েছিল।
চলমান শান্তি আলোচনার ফলশ্রুতিতে ড. আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ এখন পাকিস্তান সফর করছেন। তরুণ ডাক্তার হিসেবে ১৯৮৫-৮৬ সালে স্বল্প সময়ের জন্য তিনি পাকিস্তানে কাজ করেছিলেন। তার এই বিলম্বিত সফর পাকিস্তানকে একটা অনন্য সুযোগ দেবে এবং সম্ভবত আফগান নীতি শুধরে নেয়ার একটা সুযোগ পাবে পাকিস্তান।
পাকিস্তানের একটা শান্তিপূর্ণ আফগানিস্তান দরকার। তারা আমাদের প্রতিবেশী এবং এই বাস্তবতাটা ভবিষ্যতেও কখনও বদলাবে না। মধ্য এশিয়া ও রাশিয়ার সাথে সংযোগ স্থাপনকারী দেশ হিসেবে আফগানিস্তান এ অঞ্চলের পানি ও জ্বালানি নীতির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শান্তি ছাড়া, এই ক্ষেত্রগুলোতে কোন অগ্রগতি সম্ভব হবে না।
আফগানিস্তানে সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের জন্য পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতর (এবং আইএসআইকে) অবশ্যই সাধুবাদ দিতে হবে। শান্তির সম্ভাব্য দূত হিসেবে ড. আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহকে পাকিস্তানে স্বাগতম!
লেখক একজন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক