আমরা লাইভে English মঙ্গলবার, মার্চ ২৮, ২০২৩

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে কতটা কার্যকর হবে বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য চুক্তি?

cargo_plane_at_cambodia_airport
ছবি: সিনহুয়া নিউজ এজেন্সি

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৫টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি শনিবার থেকে কার্যকর হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মহামারি পরবর্তী পুনরুদ্ধারে এ অঞ্চল তথা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে চুক্তিটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।

অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) ভুক্ত ১০টি দেশের পাশাপাশি চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে 'রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ' বা আরসিইপি নামের এই মুক্তবাণিজ্য চুক্তি। বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ও দেশীয় উৎপাদনের প্রায় এক তৃতীয়াংশই এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।

তাই আকার ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় আরসিইপি আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রবাহকে ব্যাপকভাবে শক্তিশালী করে তুলবে বলে ধারণা করছেন অনেকে। এছাড়া, এই অঞ্চলের বাইরে বিশ্ব অর্থনীতিকেও এই চুক্তি সমৃদ্ধ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি

আরসিইপির মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে রপ্তানি ৫০ হতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশা করছেন মালয়েশিয়া ইন্টারন্যাশনাল ডুরিয়ান ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল এডউইন চিয়াং। তিনি বলেন, "ডুরিয়ান বাণিজ্যের স্বর্ণযুগ আসছে সামনে।"

চিয়াংয়ের মতে, এই চুক্তি মালয়েশিয়ার কৃষি খাতের জন্য একটি বৃহত্তর বাজার ও উন্নয়নের জায়গা উন্মুক্ত করবে।  দেশের কৃষি পণ্য বাণিজ্যকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে বিনিয়োগ ও সহযোগিতাকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব বলেন, "আরসিইপি কেবল মালয়েশিয়ার ব্যবসার জন্যই নয়, বরং এটি সকল আঞ্চলিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর জন্য মালয়েশিয়া ও আসিয়ানের বাজারকে আরও বিস্তৃতভাবে উন্মুক্ত করবে।"

বিশেষজ্ঞদের মতে, মুক্ত বাণিজ্য ব্লক কমপক্ষে ৯০ শতাংশ বা তারও বেশি পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক দূর করবে, বিনিয়োগের জন্য বাজারে প্রবেশাধিকারকে আরও প্রসারিত করবে, নিয়ম নীতিগুলোকে আর বেশি ব্যবসায়বান্ধব ও সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলবে। সেইসঙ্গে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি ধরনের ব্যবসা উন্নয়ন সম্পর্কিত সাধারণ নিয়ম নীতিগুলোকে নির্দিষ্ট ও সহজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আসিয়ান মহাসচিব দাতো লিম জক হোই বলেছেন, "চুক্তিটি সুযোগ উন্মুক্ত করবে, যা আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।"

তিনি আরও বলেন, "আরসিইপি চুক্তির অধীনে অঞ্চলটি 'একক উৎপাদন ভিত্তির' পাশাপাশি, এর নিজস্ব পণ্যের জন্যও একটি অনন্য বাজার হয়ে উঠবে।"

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলন সংস্থা ইউএনসিটিএডি বলেছে, "আরসিইপি বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এক 'মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র' তৈরি করবে।"

সংস্থাটি আশা করছে, চুক্তি অনুযায়ী শুল্ক ছাড়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলের রপ্তানি আয় বাড়বে কমপক্ষে ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

তবে, গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন ব্যবসাগুলো মুক্ত বাণিজ্য এলাকার (এফটিএ) মধ্যেও শুল্কের সম্মুখীন হতে পারে, যদি তাদের পণ্যগুলোতে অন্য কোথাও তৈরি উপাদানের উপস্থিতি থাকে।

থাইল্যান্ডের টায়ার মোল্ড সাপ্লাইয়ার প্রতিষ্ঠান হিমিল কোং-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কিউ জিনলিয়াং বলেন, "আরসিইপির শুল্ক ছাড়,  রুলস অফ অরিজিনের একীভূতকরণ ও সহজ শুল্ক পদ্ধতি আমাদের কোম্পানিকে কাঁচামাল এবং সরঞ্জাম ক্রয়ের পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যগুলো আরও দক্ষতার সঙ্গে ও কম খরচে বিতরণের সুযোগ করে দেবে।"

দক্ষিণ চীনের গুয়াংজি ঝুয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের বেইবু গলফ পোর্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান লি ইয়ানকিয়াং জানিয়েছেন, বিদেশি বন্দরের সঙ্গে সংযুক্তকারী ৪৪টি শিপিং রুটের মধ্যে ২৮টি রুট আরসিইপিভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের এক সমীক্ষা অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে আরসিইপির অন্তর্ভুক্ত সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক আয় বাড়বে প্রায় ০.৬ শতাংশ, যা বার্ষিক ২৪৫ বিলিয়ন ডলারের সমান। সেইসঙ্গে, আঞ্চলিক অর্থনীতিতে যোগ হবে ২.৮ মিলিয়ন চাকরির সুযোগ।

বিশ্ব অর্থনীতিতে আশার আলো

আসিয়ান সচিবালয়ে আনুমোদন দেওয়া ১০ টি দেশে আরসিইপি চুক্তি প্রাথমিকভাবে কার্যকর হয়েছে।

গুয়াংসি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অফ আসিয়ান স্টাডিজের ডেপুটি ডিরেক্টর জি হংলিয়াং বলেন, "বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের এই মুহূর্তে, আরসিইপির উত্থান নিঃসন্দেহে বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্য উন্নয়নে এক আশার আলো।"

জি আরও বলেন, "এটি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বজায় রাখতে ও মহামারির প্রতিকূল প্রভাব কমাতে সহায়তা করবে।"

সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে, ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) তার ২০২১ সালের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসকে ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫.৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছিল। তবে ২০২২ সালের ৪.৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস অপরিবর্তিত রেখেছে সংস্থাটি।

আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "পূর্বাভাসে এই পরিমিত সংশোধন, কিছু দেশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অবনতি নির্দেশ করছে।" 

ইউএস পাবলিকেশন এক্সিকিউটিভ ইন্টেলিজেন্স রিভিউ-এর ওয়াশিংটন ব্যুরো প্রধান উইলিয়াম জোনস বলেন, মাহামারির কারণে আঞ্চলিক বাণিজ্যে যেই ধীর গতি এসেছিল, তা অনেকটাই কেটে যেতে পারে আরসিইপি চুক্তির মাধ্যমে।

জোনস আরও বলেন, "ডিজিটাল অর্থনীতির মাধ্যমে সক্রিয় পণ্য ও পরিষেবার 'প্রবাহ' বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বাড়বে।" আর এর মাধ্যমে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সমৃদ্ধি আশা করছেন তিনি।

সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক লরেন্স লোহ বলেন,  আরসিইপি চুক্তি বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনকে গভীরভাবে সমন্বিত করবে। এর মাধ্যমে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পণ্য ও পরিষেবা প্রবাহে আসবে নমনীয়তা ও গতিশীলতা। ফলে মহামারির কারণে এ অঞ্চলে পণ্য ও সেবা সরবরাহে যেই ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছিল, তা কাটিয়ে ওঠাও সম্ভব হবে।

মুক্ত বাণিজ্য ও বহুপাক্ষিকতার বিজয়

'বহুপাক্ষিকতা ও মুক্ত বাণিজ্যের বিজয়' নিশান নিয়ে আরসিইপি চুক্তি এমন সময়ে কার্যকর হলো, যখন মুক্ত বাণিজ্য ও বিশ্বায়নের সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।

আসিয়ান সচিবালয় শনিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আরসিইপি চুক্তি গঠন একটি মুক্ত, ন্যায়, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও নিয়মতান্ত্রিক বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে সমর্থন করে, যার মাধ্যমে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সংকল্পের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

আরসিইপি-কে অন্যান্য এফটিএ বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির জন্য একটি মডেল হিসেবে বিবেচনা করে লোহ বলেন, আরসিইপি অনেকটা অঞ্চল নিরপেক্ষ চুক্তির মতই; এখানে আমেরিকা ও ইউরোপের অন্যান্য এফটিএর সঙ্গে সহযোগিতা তৈরিরও সুযোগ রয়েছে।

লোহ আরও বলেন, "বাণিজ্য ও বিনিয়োগে আরসিইপির যোগসূত্র বিশ্বায়নকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে, যা বর্তমানে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে হুমকির সম্মুখীন।"

দক্ষিণ কোরিয়ার কিয়ংগি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিউ জিয়াং বলেন, আরসিইপি বাস্তবায়ন চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনাকে ত্বরান্বিত করবে; পাশাপাশি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এফটিএ গঠনে গতি বাড়াবে।

এদিকে জাপানের ফুজিৎসু রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো জিন জিয়ানমিন আশা করছেন,  অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রভাব ছাড়াও, আরসিইপি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শাসন ক্ষমতারও উন্নতি ঘটাবে। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক খাতে মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।