আমরা লাইভে English শুক্রবার, মার্চ ৩১, ২০২৩

আমেরিকার ইরান-কৌশল ভয়াবহ বিপর্যয়ে

EDITOR’S CHOICE-ENG-21-10-2020-1
২০১৮ সালের এপ্রিলে তেহরানে সামরিক কুচকাওয়াজে ইরানি সামরিক বাহিনীর এস-৩০০ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপনাস্ত্র প্রদর্শন 

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ তেহরানের ওপর থেকে অস্ত্র বিধিনিষেধ ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়ায় ১৮ অক্টোবরকে ‘অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিবস’ হিসেবে অভিহিত করেছে ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতি।

রোববার (১৮ অক্টোবর) থেকে কার্যকর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২২৩১ নম্বর প্রস্তাবে অস্ত্র হস্তান্তর-সম্পর্কিত সব বিধিনিষেধ এবং ইরানি নাগরিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের ভ্রমণের ওপর আরোপিত সব নিষেধাজ্ঞা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রত্যাহার হয়ে গেছে।

ইরানের কৌশল ছিল ২০১৫ সালের জয়েন্ট ‘কমপ্রেহেনসিভ প্লান অব অ্যাকশন’ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার। তারা জানত, যুক্তরাষ্ট্র তা লঙ্ঘন করবে এবং ঠিকই তা হয়েছে। ইরানকে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে সবরকম প্ররোচনা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু নাছোরবান্দার মতো তা আঁকড়ে থাকে ইরান।

তেহরানের কাছে মনে হয়েছে, জেসিপিওএর আওতায় তার দায়বদ্ধতা পূরণ করার মধ্যেই রয়েছে তার সুবিধা। তারা ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই অবস্থানে থাকতে চায়। এরপর জাতিসংঘ তার ইরান পরমাণু ফাইলটি বন্ধ করে দেবে বলে কথা রয়েছে।

একইভাবে ইরান এখন ২০২৫ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত বহাল ক্ষেপণাস্ত্র-সম্পর্কিত চুক্তিতেও অটল থাকতে চায়। ওই সময় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাদবাকি বিধিনিষেধও প্রত্যাহার হয়ে যাবে।

ইরান ওই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করলে বিপুল সুবিধা পাবে। তারা সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতার সুযোগ পাবে, এবং পরমাণু কর্মসূচি চালানোর জন্য এনপিটিভুক্ত দেশের মর্যাদাও পাবে।

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জোর দিয়ে বলে যে নিজস্ব সক্ষমতা ও সামর্থ্যের মাধ্যমে ইরান তার সব প্রতিরক্ষা প্রয়োজন পূরণ করেছে। এই মূলনীতি প্রধান চালক হিসেবে রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

ইরান তার প্রতিরক্ষা চাহিদার ৮০ ভাগ পর্যন্ত দেশীয়ভাবে মিটিয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। তবে তা এখানে আসল বিষয় নয়।

আবার ১৮ অক্টোবর অবরোধ ওঠে গেলেও ইরান সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে গেল, বিষয়টি তেমনও নয়। কারণ বিশ্ব পর্যায়ে আধিপত্য এখনো যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই।

EDITOR’S CHOICE-ENG-21-10-2020-2

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে তার ইরানি প্রতিপক্ষ জাভাদ জারিফ

তবে তেহরান বার্তা দিচ্ছে যে সে দায়িত্বশীল আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। তারা প্রতিরক্ষা খাতে সক্ষমতা বাড়াতে চায় কেবল আগ্রাসন ঠেকানোর জন্যই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেন জয়ী হবেন, এমন আশাবাদও সম্ভবত তাদের চিন্তার মধ্যে রয়েছে।

আবার পরমাণু ইস্যুতে মস্কোর সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে পরামর্শ করছে তেহরান। ইরানি অবস্থান সম্পর্কে ভালো ধারণাও আছে রাশিয়ার। রুশ উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই রিয়াবকভ তার প্রতিক্রিয়াতেও তা বলেছেন।

তিনি ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করলে রাশিয়ার ওপর মার্কিন অবরোধ আরোপ হবে বলে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের হুমকিকে পাত্তা দেননি। তিনি বলেছেন, ইরানের সাথে সব ধরনের সহযোগিতামূলক অবস্থান তৈরী করছে রাশিয়া। তিনি বলেন, সামরিক-প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সব পক্ষের প্রয়োজন মেটাবে, এ ধরনের সহযোগিতার জন্য উভয়পক্ষই প্রস্তুত।

রাশিয়ার অবস্থানে কার্যকরভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক বিকল্প আর বেশি দিন গ্রহণ করার মতো অবস্থা থাকবে না যুক্তরাষ্ট্রের। রুশ-ইরান পারস্পরিক সম্পর্ক আরো গভীর হওয়ার বিষয়টির ওপর আলোকপাত করে বলেন, ইরানের ওপর মার্কিন হামলা মস্কোর স্বার্থের অনুকূল নয়।

ইরানে মার্কিন সামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে রাশিয়া সবসময়ই আগ্রহী। কারণ সেক্ষেত্রে ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালালে তা হবে দেশটির জন্য বেশ ব্যয়বহুল।

অবশ্য অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তি রফতানি নিয়ে ইরানের কাছ থেকে শেষ কথাটি আমরা এখনো শুনিনি। তবে নিশ্চিতভাবেই বলা চলে, ইরানের সম্ভব সব রফতানি খাত থেকেই আয় সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের এক সিনিয়র কূটনীতিক নিউজউইককে বলেছেন, ইরানের অনেক বন্ধু ব্যবসায়িক অংশীদার রয়েছে। বিদেশী আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষার জন্য দেশীয় অস্ত্র শিল্পকে ইরান বিকশিত করেছে।… স্বাভাবিকভাবেই আমরা ১৮ অক্টোবরের পর আমাদের জাতীয় স্বার্থের আলোকে বাণিজ্য করব।

এখানে আমাদের জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি অবশ্যই যথাযথভাবে বুঝতে হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অর্থ উপার্জনের জন্য এফ-১৫ জঙ্গি বিমানের মতো খেলনা সামগ্রী উপসাগরীয় দেশগুলোতে (এসব বিমান আসলে এসব দেশের প্রয়োজন নেই) বিক্রি করতে পারেন, তবে তাকে অন্যত্র মূল্য পরিশোধ করতে হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে ইরান আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে বিচক্ষণতার সাথে তার অস্ত্র বিক্রি নীতি প্রণয়ন করবে। সে তার আঞ্চলিক কৌশল, পররাষ্ট্রনীতি, মধ্যপ্রাচ্য, ল্যাতিন আমেরিকা বা আফ্রিকায় তার অবস্থা বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবে।

যুক্তরাষ্ট্র যদি তার সর্বোচ্চ চাপ দেয়ার নীতি অব্যাহত রাখে, তবে তেহরান দেশটিকে যন্ত্রণাই দিয়ে যাবে। ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র অবরোধ আরোপের স্বাধীনতা শেষ হয়ে আসছে।

 

লেখক: সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক