জো বাইডেনের বিশ্ব ব্যবস্থা

চার বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেটা অর্জন করেছেন, ঐতিহাসিকভাবে কেবল যুদ্ধের ভেতর দিয়েই সেটা অর্জিত হয়েছে: বিশ্ব ব্যবস্থাকে বদলে দিয়েছিলেন তিনি। ট্রাম্পের পূর্বসুরীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তুপ থেকে যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বহুপাক্ষিক সংগঠনগুলো গড়ে তুলেছিলেন এবং সেগুলোর কার্যকারিতা বজায় রেখেছিলেন, ট্রাম্প তার বিচ্ছিন্নতাবাদ, স্বৈরাচারী হওয়ার ইচ্ছা, এবং নিছক কৌতুহলের কারণে হাসিমুখে সেগুলোকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এখন কি হবে?
অনেকেই আশা করছেন, নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্ব নেয়ার পর উদার আন্তর্জাতিক বিশ্ব ব্যবস্থা রক্ষা পাবে, এমনকি পুনর্বহাল হবে। সেটাই কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু, এই আশাটা অবাস্তব। ট্রাম্প-উত্তর ব্যবস্থাটা মনে হচ্ছে ১৯৪৫ সালের আন্ত-ব্লক প্রতিযোগিতার মতো হতে যাচ্ছে, শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী উদার ব্যবস্থার মতো নয়।
প্রথমত, ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকার অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার যে ক্ষতি করেছেন, সেটা ঠিক করতে এবং মহামারীর মাধ্যমে দেশের সিস্টেমের যে দুর্বলতা বেরিয়ে এসেছে, সেগুলো মেরামতেই অনেক সময় চলে যাবে বাইডেন প্রশাসনের। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে বিভক্ত প্রেসিডেন্সি থেকে উদ্ধারের বিষয়টি দ্রুতও হবে না, বা বেদনামুক্তও হবে না। বৈশ্বিক নেতৃত্বের জন্য আমেরিকাকে পুনর্গঠন করাটা হলো অন্যতম পূর্বশর্ত।
বাইডেনের প্রশাসনের সীমাহীন দক্ষতা থাকলেও ঘড়ির কাঁটি উল্টো দিকে ঘোরানোর সাধ্য তাদের নেই। শীতল যুদ্ধোত্তর উচ্ছ্বাসের সাথে পশ্চিমা উদারতান্ত্রিক গণতন্ত্র সারা বিশ্বের উপর জয়ী হয়ে গেছে – এই ধারণা যুক্ত হয়েছে।
নব্বই ও বিশের দশকে যুক্তরাষ্ট্র যখন বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক শক্তি, তখন উদারতন্ত্রের আধিপত্যকে জোরালো মনে হয়েছিল। কিন্তু এখনকার দ্রুত পরিবর্তনশীল বহুমেরুর বিশ্বে সেই অবস্থাটা আর নেই। এক দশকের বেশি সময় ধরে এটা চলছে। তাই ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগেই আসলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব নেতৃত্বের আসন হারিয়েছিল।
ট্রাম্পের বিচ্ছিন্নতাবাদকে যদিও মার্কিন ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুতি হিসেবে দেখানো হচ্ছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে যে চিন্তাধারা চলে এসেছে, তারই একটা ধারা আসলে এখানে ফুটে উঠেছে। ১৯১৭ সালে জার্মান সাবমেরিন যদি মার্কিন বাণিজ্য জাহাজে হামলা না করতো, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়াতোই না।
একইভাবে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপান পার্ল হারবারে হামলা করার পরেই কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র শান্তি বজায় রাখার এবং ইউরোপে সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়েছে, সেটার কারণ হলো সোভিয়েত সম্প্রসারণের ভয়, কোন নৈতিক দায়িত্ব নয়।
আমেরিকার স্বার্থেই ট্রাম্পের পূর্বসুরী বারাক ওবামা, এমনকি জর্জ ডাব্লিউ বুশ পর্যন্ত মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির আধিপত্যবাদী আচরণ সংযত করার চেষ্টা করেছেন। ন্যাটো মিত্র দেশগুলো পর্যাপ্ত বোঝা বহন না করায় ট্রাম্পের মতো ওবামা আর বুশও হতাশা জানিয়েছিলেন।
আধিপত্যবাদী অবস্থান থেকে পিছু হটে আসার একটা ইতিহাস রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, বাইডেন যেটা বদলাতে পারবেন না। মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘ, ব্যায়বহুল, ও সমাধানহীন যুদ্ধের কারণে আমেরিকা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় বিশ্বায়নের নেতিবাচক দিক এবং নব্যউদার রক্ষণশীলতার সীমাবদ্ধতা প্রকাশিত হয়েছে। সমৃদ্ধির মোটা মোটা প্রতিশ্রুতি পূরণ না হয়ে, এটা বরং স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, গত কয়েক দশকের মুক্তবাজার নীতি সম্পদের অসাম্য বাড়িয়েছে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ধ্বংস করেছে।
অন্তহীন যুদ্ধ আর ক্রমবর্ধমান অসমতা জাতীয়তাবাদী মানসিকতা উসকে দিয়েছিল এবং সেটার জোরেই ২০১৬ সালের নভেম্বরে জয়ী হয়েছিলেন ট্রাম্প। একই ধরণের হতাশা জুন মানে ব্রিটেনের ব্রেক্সিট ভোট, ২০১৮ সালে ফ্রান্সের ইয়েলো ভেস্ট বিক্ষোভ, এবং এমনকি কোভিড-১৯ সঙ্কটের সময়ে ভূমিকা রেখেছে।
মহামারীকে এমন একটা সুযোগ দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে, যেটা নষ্ট করা ঠিক হবে না। এরপরও সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, সরবরাহ ও ভবিষ্যতের ভ্যাকসিন নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়েছে, নাগরিক স্বাধীনতা সীমিত করে দেয়া এবং নজরদারি বাড়ানোর বিষয়টি না হয় না-ই বললাম। সংক্ষেপে বলা যায়, আমাদের যখন বৈশ্বিক সহযোগিতার সবচেয়ে বেশি দরকার, ঠিক সে সময়টাতেই আমাদের ভঙ্গুর বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা আমাদেরকে পিছনে নিয়ে জাতিরাষ্ট্রের পর্যায়ে ফেলে দিয়েছে।
বাইডেন প্রশাসনের উচিত হবে বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে স্বৈরাচারি ব্লকের সাথে প্রতিযোগিতায় নেতৃত্ব দেয়া, এবং শান্তির জন্য দরকারি বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান ও কাঠামোগুলোকে ধরে রাখা। এ জন্য তার পূর্বসুরী যেভাবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে পরোক্ষ প্রশ্রয় দিয়েছেন, সেখান থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং ইরানের সাথে যে যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখানো হয়েছে সেটা সংশোধন করে সংশোধিত, টেকসই পারমানবিক চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে। সৌভাগ্যের বিষয় হলো, মনে হচ্ছে, এই দুটাই করতে তারা প্রস্তুত আছে।
একই সাথে বাইডেন প্রশাসনকে আমেরিকার জোটগুলোকে সম্মিলিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র সেখানে স্বাভাবিকভাবেই নেতৃত্ব দেবে, কিন্তু আধিপত্য করবে না। কারণ মিত্রদের পক্ষ থেকে এই প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে গেছে। ইউরোপিয়ান নেতারা, বিশেষ করে ফরাসী প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রন ক্রমেই এটা উপলব্ধি করছেন যে, ইউরোপের নিরাপত্তা তাদের নিজেদের হাতে নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে তার ইউরোপিয় ইউনিয়নের মিত্রদের সাথে মিলেই রাশিয়ার সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।
একইভাবে, চীনের সাথে চলমান কৌশলগত সঙ্ঘাত মোকাবেলার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে তার এশিয়ান মিত্র – যেমন জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে মিলে কাজ করতে হবে।
আরও ব্যাপকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের উদার গণতন্ত্রগুলো শক্তিশালী করতে হবে, যাতে এমন একটা ব্লক গড়ে তোলা যায় যারা বিশ্বের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ইইউয়ের ভেতরের নেতিবাচক শক্তিগুলোর মোকাবেলার করার পাশাপাশি ন্যাটোকে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর বৃহত্তর নিরাপত্তা জোট হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দুই ব্লককে বাণিজ্য, অস্ত্র বিস্তার রোধ, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মতো অভিন্ন স্বার্থে কার্যকর সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। এ জন্য কূটনৈতিক দক্ষতার দরকার, ট্রাম্পের কল্পনাতেও যেটা ছিল না, সেটাতে দক্ষতা অর্জন তো দূরের কথা।