‘পরিবেশের নোবেল’: টাইলার পুরস্কার জিতলেন ভারতের পাভান সুখদেব
.jpg)
ব্যাংকার থেকে পরিবেশবিদ বনে যাওয়া ভারতীয় পাভান সুখদেব ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বকে সেই ধরনের জলবায়ু বিপর্যয়ের ব্যাপারে সতর্ক করে আসছেন, সাম্প্রতিককালে যেগুলো ব্রাজিল আর অস্ট্রেলিয়ায় দেখা গেছে।
সোমবার ৫৯ বছর বয়সী সুখদেব পরিবেশগত অর্জনের জন্য এ বছরের টাইলার প্রাইজ পেয়েছেন, যেটাকে প্রায়ই ‘পরিবেশের নোবেল’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা প্রাকৃতিক বিশ্বকে কি দৃষ্টিতে দেখতে পারেন, সে বিষয়ে বৈপ্লবিক অর্জনের জন্য তাকে এই পুরস্কার দেয়া হয়।
সুখদেবের সাথে যৌথভাবে এ পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী গ্রেচেন ডেইলি। সুখদেব গত এক দশকের মধ্যে তৃতীয় ভারতীয় হিসেবে এ পুরস্কার পেলেন।
গত বছরের আগস্টে পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত অ্যামাজন রেইনফরেস্টের নয় লক্ষ হেক্টরের বেশি বনাঞ্চল পুড়ে যায়। গত এক দশকের মধ্যে এ ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েনি কখনও এই বনাঞ্চল।
এক মাস পরেই অস্ট্রেলিয়াতে ১০ মিলিয়ন হেক্টরের বেশি এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতে এক বিলিয়নের বেশি প্রাণী ক্ষতির মুখে পড়ে। অস্ট্রেলিয়ার দাবানল ছিল অ্যামাজনের আগুনের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বড়।
অস্ট্রেলিয়াতে প্রায় দুই হাজারের মতো ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে, এবং হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মার্কিন-ভিত্তিক মিডিয়া ফার্ম আকুওয়েদারের মতে, সেখানে পুরো ক্ষয়ক্ষতি এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
বিশ্বের অন্য একটা অঞ্চলে এ সময় একটা ভিন্ন ধরনের বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ভারতের মুম্বাইয়ে সরকার বন কেটে মেট্রো রেলওয়ে শেড নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামে সাধারণ মানুষ।
আল জাজিরাকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাতকারে সুখদেব বলেন, “স্থানীয় এনজিওগুলো সফলভাবে এটা দেখিয়েছে যে, মেট্রো রেলস্টেশানটি অন্য জায়গায় হতে পারে, এজন্য অ্যারে এলাকার পরিবেশ নষ্ট করার দরকার নেই। কিন্তু মনে হয়েছে যে, প্রাকৃতিক অঞ্চল দখলের আকাঙ্ক্ষাটা যেন আরও বেশি জোরালো। ভারত এবং অন্যান্য জায়গাতেও এই ধরনের ঘটনা সবসময় ঘটছে”।
প্রভাবশালী গবেষণা
২০১১ সালের টেড টক সম্পর্ক সুখদেব আল জাজিরাকে বলেন, এতে ভবিষ্যদ্বানী ধরনের কিছু ছিল না।
তিনি বলেন, “বিজ্ঞান কোন ভবিষ্যদ্বানী নয়, এটা প্রাকৃতিক বিশ্বকে জানার বিষয় এবং আমি প্রাকৃতিক বিশ্বকে বুঝতে পারি; প্রকৃতিতে কিভাবে বিভিন্ন জিনিস কাজ করে, সেটা জানার বিষয়। আসলে এটা ব্রাজিলের মানুষের বিষয় যে, তারা রেইনফরেস্টকে মূল্য দেন কি না”।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অ্যামাজনে আগুন লাগার একটা বড় কারণ হলো বন উজার করা। এই আগুনের সূচনা হয়েছিল মানুষের দ্বারাই, যখন তারা জমি খালি করার চেষ্টা করেছিল।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “তারা যদি এটা না বুঝে, তারা যদি এ বিষয়টা স্বীকার না করে যে, বনে সামান্য পরিবর্তন হলে সেটা সার্বিকভাবে বড় ধরনের নাটকীয় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে, তাহলে তারা তাদের পুরো কৃষি অর্থনীতিকে বিনষ্ট করে ফেলবে”।
সুখদেবের কাজের মধ্যে রয়েছে ইউনাইটেড নেশান্স এনভায়রনমেন্ট প্রগ্রামকে (ইউএনইপি) ২০০৯ সালে গ্রিন ইকোনমি ইনিশিয়েটিভ গ্রহণে সাহায্য করা থেকে নিয়ে ভারতের কিছু রাজ্যে বিগত দশকে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা। আর এই সবকিছুরই চালিকাশক্তি হলো তার এই বিশ্বাস যে, প্রকৃতিকে যদি আমরা গুরুত্বহীনভাবে গ্রহণ করি, তাহলে বিশ্বকে এর জন্য মূল্য দিতে হবে।
কিন্তু জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন ইকোনমিক্স অব ইকোসিস্টেমস অ্যান্ড বায়োডায়ভার্সিটি (টিইইবি) গবেষণাতে যখন তাকে প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, তখনই কেবল তার কাজ বিশ্বের সামনে গুরুত্ব পায়।
২০০৮ সালে প্রথম টিইইবি গবেষণা প্রকাশিত হয়, যেখানে দেখানো হয়েছে যে, বিশ্ব প্রাকৃতিক পুঁজি হারাচ্ছে এবং এর পরিমাণ প্রতি বছর দুই থেকে চার ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ। এতে উল্লেখ করা হয় যে, বিশ্বের উন্নয়নের জন্য বিপুল পরিবেশগত ও মানবিক মূল্য দিতে হচ্ছে, এবং এখানে প্রধান ভুক্তভোগী হলো বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠি।
টাইলার প্রাইজ কমিটির চেয়ারপার্সন জুলিয়া মার্টোন-লেফেভরে এক বিবৃতিতে বলেছেন, “তার কাজ বিশেষ করে ইউএনইপি’র টিইইবি এবং গ্রিন ইকোনমি ইনিশিয়েটিভে তার কাজ থেকে ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্রের অর্থনীতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেক এগিয়ে গেছে”।
অনুপ্রেরণার উৎস
সুখদেব প্রথমে ডয়চে ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন। ২৫ বছরের আর্থিক খাতের অভিজ্ঞতাকে তিনি পরিবেশের অবনতি ও এর পরিণতি হিসেবের কাজে ব্যবহার করেন।
তিনি রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতাদেরকে তাদের নীতি ও ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তের পরিণতি বোঝানোর ব্যাপারে সাহায্য করেছেন, এবং তারা যেভাবে প্রাকৃতিক বিশ্ব ও প্রবৃদ্ধিকে দেখে থাকেন, সেটা বদলে দিয়েছেন।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “যে সব মানুষ দাবি করেন যে, পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বিষয়টিতে ছাড় দিতে হয়, তারা ভুল তথ্য দিচ্ছেন। এই মানুষগুলো হয় ‘সবুজ উন্নয়ন’ মডেল সম্পর্কে অজ্ঞ, অথবা তারা বিশেষ কোন বাণিজ্যিক স্বার্থ নিয়ে কাজ করছে”।
২২ জানুয়ারি দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈঠকে সুখদেব দুটো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করেন, যেখান থেকে পরিবেশের উপর প্রভাবের বিষয়টি মাথায় রেখে ব্যবসায়ীদেরকে সহায়তা করা হবে।
ধারণা বাস্তবে রূপ নেয় গ্রামীণ ভারতে
২০১৭ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড ওয়াই ফান্ড ফর নেচারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুখদেবের টেকসই উন্নয়নের যে আগ্রহ ছিল, সেটা বাস্তব রূপ পায় গ্রামীন ভারতে।
তিনি বলেন, “দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য প্রকৃতির কি গুরুত্ব, সে ব্যাপারে আমার ধারণার জন্ম হয় ভারতে আমার জীবনের শুরুর দিকে। সেখানে দরিদ্র মানুষের কাছাকাছি বাস করতাম আমরা, গ্রামীণ এলাকায় মাঝে মাঝেই ঘুরতে যেতাম এবং রাজস্থানে আমার চাচার খামার দেখতে যেতাম”।
“বেড়ে ওঠার এই সব উপাদান এবং এরপর ভারতের এনজিওগুলোর সাথে কাজ করতে গিয়ে আমার এই ধারণা বিকাশ লাভ করেছে যে, দরিদ্রদের জন্য প্রকৃতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ”।
টিইইবিতে এই নির্ভরতার বিষয়টিকে ‘গরিবের জিডিপি’ বা ‘গ্রামীন অঞ্চলের জিডিপি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
গ্রামীণ জনগণ আয়ের দিক থেকে দরিদ্র হলেও ‘মানবিক মঙ্গল হারের’ দিক থেকে তারা গরিব নয়।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “তাদের গভীর গোষ্ঠিগত বন্ধন ও পারিবারিক সহায়তা সিস্টেম রয়েছে। তাদের যেটা নেই, সেটা হলো ন্যায্য মজুরি এবং সেখানেই প্রকৃতির গুরুত্বটা উঠে আসে। এটা তাদেরকে একটা নিরাপত্তা আর টিকে থাকার শক্তি দেয়, ভারতের গ্রামীন অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ”।