আমরা লাইভে English রবিবার, জুন ০৪, ২০২৩

তুরস্কের ইসলামী অতীতের ব্যাপারে এরদোগানের নতুন দাবি বৈধ

COLUMN-ENG-03-08-2020
ঈদের নামাজ পড়তে হায়া সোফিয়ার প্রাঙ্গনে
জমায়েত হয়েছে হাজার হাজার মুসল্লি

মারমারা সাগর আর কৃষ্ণ সাগরের সংযোগ স্থাপনকারী বসফরাসের উপকূলে অবস্থিত এবং ইউরোপ আর এশিয়ার সীমান্ত হিসেবে পরিচিত ইস্তাম্বুল ইউরেশিয়া অঞ্চলের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ শহর। খৃষ্টপূর্ব ৬৬০ সালের দিকে ‘বাইজানটাইন’ নামে এই শহরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ৩৩০ সালে রোমান সম্রাট কন্সট্যানটিন এই শহরকে রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ঘোষণা করেন এবং শহরের নাম বদলে কন্সট্যান্টিনোপল রাখেন। 

১৪৫৩ সাল পর্যন্ত কন্সট্যান্টিনোপল রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। এই বছর দ্বিতীয় সুলতান মেহমুদ এই শহর বিজয় করেন এবং একে অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী করে শহরের নাম রাখেন ইস্তাম্বুল। ১৯২২ সালের আগে প্রায় পাঁচ শতাব্দি ধরে এটা তুরস্কের রাজধানী ছিল। 

এক হাজার বছরেরও বেশি সময়ের সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক ঐতিহ্য আধুনিক ইস্তাম্বুলে অনেক নিদর্শন রেখে গেছে। আয়া সোফিয়া নির্মিত হয় ৫৩৭ সালে। নির্মাণের সময় এটা ছিল পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম বৃহৎ গির্জা। ১৯৩৫ সালে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের প্রতিষ্ঠিত সেক্যুলার তুরস্ক সেক্যুলারিজমের উদাহরণ হিসেবে এটাকে যাদুঘরে রূপান্তরিত করে। 

তুরস্কের একটি আদালত ঘোষণা দেয় যে, আয়া সোফিয়াকে যাদুঘরে রূপান্তরের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আতাতুর্ক, সেই সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করা হলো। আদালতের রায়ের পরপরই প্রেসিডেন্ট এরদোগান আয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে রূপান্তরের ঘোষণা দেন। 

আয়া সোফিয়া ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার কারণে এরদোগানের সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন এবং এমনকি বেশ কিছু পক্ষ থেকে প্রতিবাদ বিক্ষোভও হয়েছে। হতাশা প্রকাশ করে রাশিয়ান অর্থাডক্স চার্চ এটাকে পুরো খ্রিস্টান সভ্যতার জন্য হুমকি হিসেবে বর্ণনা করেছে। এই মন্তব্য হাস্যকর! কারণ এটা আগেই মসজিদ ছিল এবং কয়েক দশক এখানে নামাজ বন্ধ ছিল মাত্র। সেখানে এখন পুনরায় নামাজ শুরুর কারণে খ্রিষ্টান সভ্যতা হুমকির মুখে পড়ে যাওয়ার যুক্তি খুবই হাস্যকর। ইউরোপিয় ইউনিয়ন (ইইউ) এটাকে দুঃখজনক বললেও আর কোন মন্তব্য করেনি তারা। কিছু মার্কিন চ্যানেল তুরস্ক বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে। তুরস্কের জনগণের একটা বিরাট অংশ এই পদক্ষেপের ব্যাপারে সন্তোষ জানিয়েছে। আধুনিক তুরস্কের জনক মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক তার দেশের জনগণের জন্য যে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, লক্ষণ দেখে বোঝা যাচ্ছে, সেই সময় পেরিয়ে এসেছে তুরস্কের জনগণ। 

ইউরোপ সুযোগটা হাতছাড়া করেছে। বিভিন্ন অজুহাতে তুরস্ককে তারা ইউরোপিয় ইউনিয়নে যেতে দেয়নি। ইউরোপের একাংশে বহু শতকের তুরস্কের শাসনকে খ্রিস্টান ইউরোপ সহজে ভুলতে পারবে না। প্রায় এক শতকের হতাশা আর শীতল যুদ্ধকালিন ন্যাটোর অস্ত্র হিসেবে কাজ করার পর এরদোগানের অধীনে তুরস্ক আবার তার মূল ইসলামি শিকড়ে ফিরে আসতে শুরু করেছে। 

কিন্তু ইসলাম-বিরোধী অনুভূতিগুলো উসকে দিয়েছে স্যামুয়েল হান্টিংটনের ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশানের’ মতো কাজগুলো। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাত ধরে যে বৈশ্বিক ‘ইসলামি’ সন্ত্রাসবাদ এসেছে, সেটা একটা ইসলাম-বিরোধী মনোভাব তৈরি করেছে, সেটাকে আবার সালমান রুশদির মতো মানুষেরা অপপ্রচারের কাজে লাগিয়েছে, শার্লি এবদো এবং এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে যেটা দেখা গেছে। 

আতাতুর্ক শুধুমাত্র কলমের খোঁচায় কঠোর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ চালু করলেও ইসলামের প্রতীকগুলো তুর্কিদের চেতনার গভীরে রয়ে গেছে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলগুলোতে। নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক আর হিজাবকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আরব অক্ষর বদলে ল্যাটিন অক্ষর চালু করা হয়। ফলে পরবর্তি প্রজন্মের মুসলিমদের জন্য কুরআন পড়াটা শুধু অসম্ভব হয়ে পড়েনি, বরং অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের আগের মুদ্রিত স্ক্রিপ্ট পড়াও অসম্ভব হয়ে পড়ে। 

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে তুর্কিদের বঞ্চিত করার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হয়েছে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ইসলাম পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। রিসেপ এরদোগানের দলের মতো ইসলামি দলগুলোর উত্থান ঘটেছে। একটা লম্বা সময় চেপে রাখার পর এই ধরনের ইসলামের পুনরুত্থানের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই আশা করা যায়। 

এরদোগানের বিরুদ্ধে এক ধরনের অপপ্রচার চালানো হয়েছে কারণ যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো, ইইউ, এবং গ্রিসের সাথে তার সমস্যা রয়েছে। এগুলো এরদোগানের একার নীতির কারণে হয়নি। তুরস্কের জনগণের মনোভাব হলো প্রার্থনার স্থান হিসেবে আয়া সোফিয়ার উপর প্রথম অধিকার হলো তুরস্কের জনগণের এবং বিশ্ব ঐতিহ্যের বিষয়টি দ্বিতীয় বিবেচনা। তুরস্কের একটি আদালত রায় দিয়েছে যে, এটা পুনরায় খুলে দেয়া উচিত। তাই এখানে অন্য কোন মন্তব্যের সুযোগ নেই। 

তুরস্কে প্রতি বছর যে বহু মিলিয়ন পর্যটক সফর করে, তারা সবাই আয়া সোফিয়ার প্রশংসা করে থাকে। আয়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে খুলে দেয়া, পর্যটকরা যাতে এর ইতিহাস জানতে পারে এবং এর আকর্ষণীয় নির্মাণশৈলি দেখতে পারে, সেই ব্যবস্থা করার সুযোগ অবশ্যই থাকা উচিত। বিশ্বের বহু জায়গায় এমনটা করা হয়েছে। ফ্রান্সে বিখ্যাত নটর ডেমকে পর্যটকদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। ইস্তাম্বুলেও এটা করা যেতে পারে, যদি মসজিদে প্রবেশের নিয়ম নীতি সেখানে অনুসরণ করা হয়। 

স্পেনের কর্ডোভার দিকে দেখুন। কর্ডোভার বিখ্যাত মসজিদ সফরের সময় পঞ্চম চার্লস দেখতে পান যে, এটা পরে চার্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। তিনি নির্দেশ দেন যাতে সেখানে চ্যাপেল নির্মাণ করা হয়, যেটার অংশ মসজিদের মধ্যে ঢুকে গেছে। পরে মূল স্থাপত্যকে নষ্ট করে যেটা নির্মিত হয়েছিল, সেটা দেখে তিনি অসন্তুষ্ট হন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন: “তোমরা একটা অনন্য জিনিস নষ্ট করে একটা সাধারণ জিনিস তৈরি করেছো”।

সেখানে সফরকালে সরল মনে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম সেখানে আমি নামাজ পড়তে পারি কি না। আমাকে বলা হলো যে, ওখানে নামাজ পড়লে গ্রেফতার করা হতে পারে। সম্প্রতি সারা স্পেনের মুসলিমরা একজোট হয়ে দাবি জানিয়েছে যাতে ওই কমপ্লেক্সে তাদের নামাজ পড়তে দেয়া হয়। ইসলামিক কাউন্সিল অব স্পেন ভ্যাটিক্যানের কাছে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাঠিয়েছে। স্প্যানিশ চার্চ কর্তৃপক্ষ ও ভ্যাটিক্যান এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে। 

ইসরাইল আর ফিলিস্তিনে এখন যেটা চলছে, সেটা কি বিশ্বাস করা যায়? অতীতে ফিরে গিয়ে সেটা বদলানোর আর কোন উপায় নেই। দখলদারিত্বের অধিকারে যেটা সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটা আমরা বদলাতে পারি না। তবে, আমাদের ভবিষ্যৎ বদলানোর চেষ্টা করাও উচিত নয় এবং বর্তমানে শান্তির মধ্যে আমাদের বাস করা উচিত, যেটা স্পেনে আমরা একসময় করেছিলাম। কামাল আতাতুর্ক একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন কিন্তু কয়েকশ বছর ধরে যেটা মসজিদ ছিল সেই আয়া সোফিয়াকে ১৯৩৫ সালে যাদুঘরে রূপান্তরিত করে তিনি ভুল করেছেন। এরদোগান এখন সেটা ঠিক করলেন। 

অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমানের বাবা আরতুগ্রুলের কাহিনী শুনে পাকিস্তান এখন মুগ্ধ। যে দ্বিতীয় সুলতান মেহমুদ আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করেছিলেন, তিনি ছিলেন এদেরই বংশধর। আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করে প্রেসিডেন্ট এরদোগান আর তুরস্কের জনগণ অটোম্যান ইতিহাস আর তাদের ইসলামি ঐতিহ্যের একটা টুকরাকে শুধু ফিরিয়ে এনেছেন মাত্র। 

 

লেখক একজন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক