আমরা লাইভে English শনিবার, এপ্রিল ০১, ২০২৩

ভারতে মহামারী-আক্রান্ত বন্দী বাবার জন্য আমি উদ্বিগ্ন

HUMAN RIGHTS-ENG-29-06-2020

হাজার হাজার তরুণের মতো আমিও মহামারীর মধ্যে আমার বয়স্ক বাবার জন্য উদ্বিগ্ন। বাবার জন্য আমি বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন, যাকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় কারাগার– ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীর তিহার জেলের একটি ছোট সেলে বন্দী করে রাখা হয়েছে। 

আমার বাবা ৬৩ বছর বয়সী আলতাফ আহমেদ শাহ, যাকে আমি আবু বলে ডাকি, তার ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশানের সমস্যা রয়েছে। সে কারণে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে যারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েন, তাদের মধ্যে পড়ে যাবেন বাবা। 

আবুকে গ্রেফতার করা হয় ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। কোন অপরাধের জন্য তাকে আটক করা হয়নি। তার রাজনৈতিক তৎপরতা এবং ভারত-শাসিত কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসনের জন্য তার বিশ্বাসের কারণে তাকে আটক করা হয়েছে। আবুর রাজনৈতিক চিন্তাধারার কারণে তাকে বন্দী করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা ও দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগ আনা হয়েছে। 

আবুর বন্দী হওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। কাশ্মীরের প্রতিরোধ আন্দোলনকে সমর্থন দেয়ার কারণে এবং প্রতিরোধপন্থী রাজনৈতিক গ্রুপ হুররিয়াত কনফারেন্সের সদস্য হওয়ার কারণে তাকে এর আগেও বিভিন্ন কারাগারে বেশ কয়েক বছর কাটাতে হয়েছে। এই দলের প্রধান হলেন আমার দাদা সাইয়েদ আলি শাহ গিলানি। 

তিহার কারাগারে প্রায় ১৬টি কারা ভবন রয়েছে এবং বন্দী রয়েছে ১৭ হাজারের বেশি। আবু এবং কাশ্মীরের আরও অনেক রাজনৈতিক বন্দীদেরকে তথাকথিত ‘উচ্চ ঝুঁকির নিরাপত্তা ওয়ার্ডে’ রাখা হয়েছে। 

এই সব উচ্চ ঝুঁকির ওয়ার্ডগুলোতে পরিবারের সদস্যদের দেখা করতে যাওয়াটা সাধারণ ওয়ার্ডের মতো নয়। এখানকার সেলগুলো ছোট এবং তাদের দেখা করতে দেয়া হয় দিনের শেষ দিকে, অন্যান্য সব ওয়ার্ডের দেখাসাক্ষাৎ শেষ হওয়ার পরে। 

২০১৭-১৮ সালে তিহার জেলে আবুর সাথে বিভিন্ন সময়ে দেখা করতে গিয়ে আবুর সাথে আমার আরও গভীর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তিহার দেখতে যাওয়াটা সব বিবেচনাতেই চ্যালেঞ্জিংয়ের চেয়েও বেশি কিছু। প্রতি শুক্রবার সেখানে যাওয়ার জন্য আমি নিজেকে তৈরি করতাম, যেখানে যেতেই ভয় লাগে। আবার একই সাথে সেখানে যাওয়া মানে আমার আর আবুর জন্য আধা ঘন্টার আনন্দের সময় কাটানো। এই সফরগুলো সবসময়ই ছিল মানসিক ট্রমা, অবসাদ, হয়রানি, উদ্বেগ আর আতঙ্কে ভর্তি। 

আবুর সাথে দেখা করতে গিয়ে ওয়েটিং রুমে আমাকে তিন ঘন্টার বেশি অপেক্ষা করতে হতো। আতঙ্কে জড়োসড়ো হয়ে ভাঙ্গা বেঞ্চে এই তিন ঘন্টা কাটাতে হতো আমাকে। ওয়েটিংয়ের জায়গায় ঢোকার আগে আমাকে কোন কিছুই বহন করতে দেয়া হতো না। শুধুমাত্র সামান্য সাহস আর আবুকে দেখার বেপরোয়া মনোভাব সাথে করে সেখানে ঢুকতাম।

যখনই আবুকে সেলে তার থাকার জায়গা নিয়ে জিজ্ঞাসা করতাম, বাবা প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতো, কিন্তু তার শারীরিক অবস্থা দেখেই আমি আন্দাজ করে নিতাম। প্রত্যেক সফরে আগের বারের চেয়ে দুর্বল আর বয়স্ক লাগতো তাকে। তার চুল আর দাঁড়ি সাদা হয়ে যাচ্ছিল। 

একবার রেগে গিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন তিনি এ রকম একটা জীবন বেছে নিলেন, যেটা তাকে আর আমাদের পরিবারকে এ রকম ভয়াবহ কষ্টের মধ্যে ফেলে রেখেছে। আবু বলেছিলেন, “তুমি সৌভাগ্যবান যে আমাকে দেখতে পাচ্ছো এবং সাক্ষাত করতে পারছো। আমি সেই একই কারাগারে থাকি যেখানে আফজাল গুরু আর মোহাম্মদ মকবুল ভাটকে ফাঁসি দিয়ে কবর দেয়া হয়েছে। তাদের পরিবারের সদস্যরা মৃতদেহ পর্যন্ত দেখতে পারেনি। তাদেরকে এমনকি মৃত্যুর পরও বন্দী করে রাখা হয়েছে”। ভাট ও গুরুও ছিল কাশ্মীরী যাদেরকে ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দায়ে’ অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৮৪ ও ২০১৩ সালে তাদেরকে ফাঁসি দেয়া হয়। 

আবু সবসময় আমার স্পিরিট ঠিক রাখার চেষ্টা করতো। আমাকে তার মুক্তির আশা রাখতে বলতো এবং দোয়া করতে বলতো। সবশেষ তার সাথে আমার দেখা হয় চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি। এই সফরটা ছিল খুবই আবেগপ্রবণ, কারণ এর আগে এক বছর তার সাথে দেখা করতে পারিনি। ফ্যাকাশে আলোর কক্ষের জানালা দিয়ে আমাকে দেখে প্রথম কথাটি তিনি বলেছিলেন, “আহ! কত বড় হয়ে গেছো তুমি”। তাকে অনেক বয়স্ক দেখাচ্ছিল। কিন্তু সেটা বলতে পারিনি আমি। 

এর এক মাস পরে করোনাভাইরাসের কারণে ভারতজুড়ে লকডাউন জারি করা হয়। কারাগারে দেখতে যাওয়ায় নিষিদ্ধ করা হয়। 

বাবাকে নিয়ে আমার উদ্বেগের কারণ হলো ভারতের কারাগারগুলোতে বন্দীরা ঠিক মতো স্বাস্থ্য সেবা পান না। এরই মধ্যে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে বেশ কিছু কাশ্মীরী কারাগারে গেলেও তাদের ব্যাপারে মারাত্মক অবজ্ঞা করা হয়েছে। 

মে মাসের শেষ দিকে তিহার জেলে প্রথম করোনাভাইরাসের খবর জানা যায়। সেখানে ব্যাপকভাবে এই রোগ ছড়ানোর গুজবও শোনা গেছে। 

এখন পর্যন্ত আমার বাবা আর তার সাথীদেরকে মুক্তি দেয়া হয়নি। যদিও এখন পর্যন্ত ভারতের কোন আদালতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। 

আবুর গ্রেফতারের পর থেকে আমার মা-ও অসুস্থ হয়ে আছে। প্রতিদিন মা আমাকে জিজ্ঞাসা করেন কোন খবর আছে কি না। গত মাসে আমাদের জামিন আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়েছে, তবে হাসপাতালে বাবাকে পরীক্ষা করার আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। ১ জুন আদালত আদেশ ইস্যু করার পরও এখন পর্যন্ত জেল কর্তৃপক্ষ সেটা কার্যকর করেনি।