‘কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না’: গুয়ানতানামোতে বন্দি সন্তানের জন্য অপেক্ষায় আফগান মা

১৩ বছর ধরে সেহার বিবি অপেক্ষা করছেন, কখন তার সন্তানকে গুয়ান্তামো বে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হবে। ওই কারাগারে যে কজন আফগান বন্দি এখনও আটকে আছেন, তাদের দিন কাটছে অনশন, জোর করে খাওয়ানো আর বিচ্ছিন্নতার ভেতর দিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই কুখ্যাত সামরিক বন্দিশালা থেকে সিনিয়র তালেবান নেতাসহ শত শত বন্দীকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
কিন্তু আসাদুল্লাহ হারুনের বিরুদ্ধে কোন ধরণের অভিযোগ না থাকার পরও তাকে এখনও মুক্তি দেয়া হয়নি।
পাকিস্তানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় পেশোয়ার শহরের শরণার্থী শিবিরে বাস করছে আসাদুল্লাহ হারুনের পরিবারের সদস্যরা। তার মা বিবি এএফপি বার্তা সংস্থাকে বলেন, “আমার ছেলে এখনও গুয়ান্তানামো বে কারাগারে আটকে আছে, তাতে কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই। অন্য সবাইকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু সে এখনও সেখানে আটক রয়েছে”।
“আমার আর ধৈর্য নেই। আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে”।
হারুন মধুর ব্যবসা করতো। ব্যবসার কারণে সে পাকিস্তানের পেশোয়ার আর পূর্ব আফগানিস্তানের জালালাবাদ শহরের মধ্যে যাতায়াত করতো। ২০০৬ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার পরিবারের দাবি তাকে আটকের বিনিময়ে পুরস্কার পাওয়ার জন্যই এটা করা হয়েছে।
মার্কিন সরকারের অভিযোগ হলো সে আল কায়েদা আর হিজবে ইসলামি গ্রুপের মধ্যে যোগাযোগের কাজ করতো। তার পরিবার, আইনজীবী আর সমর্থকরা জোর দিয়ে বলেছে যে, তার সাথে আল কায়েদার কোন যোগাযোগ ছিল না।
‘চিরকালের বন্দি’
হারুনকে যখন আটক করা হয়, তখন তার স্ত্রী মাত্র একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে। হারুন এখন ‘চিরকালেন বন্দি’ দশার মধ্যে আছে। জেলের বাকি ৪০ বন্দি বিভিন্ন ধরণের আইনি জটিলতায় আটকে আছে সেখানে।
ওয়াশিংটন যেখানে আফগানিস্তানে তাদের দীর্ঘতম যুদ্ধের ইতি টানার চেষ্টা করছে, সেখানে তার মুক্তির বিষয়টি এখনও জটিলতায় আটকে থাকার বিষয়টি তার পরিবারের সদস্যরা মেনে নিতে পারছে না।
দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র আফগান কর্তৃপক্ষের উপর চাপ দেয় যাতে তারা হাজার হাজার তালেবান যোদ্ধাদের ছেড়ে দেয়, যাদের অনেকেই বিদেশীদের উপর ভয়াবহ হামলার সাথে জড়িত।
মার্কিন সরকার “জোর দিয়ে বলে আসছে যে, আফগান সরকারের উচিত ৫০০০ তালেবানদের ছেড়ে দেয়া… কিন্তু গুয়ানতানামো থেকে মূল্যহীন একজন আফগানকে তারা মুক্তি দিচ্ছে না”, এ মন্তব্য করেন হারুনের আইনজীবী ক্লাইভ স্ট্যাফোর্ড স্মিথ। স্মিথ অলাভজনক আইনি সংগঠন রিপ্রাইভের প্রতিষ্ঠাতা।
“মানসিকভাবে যেটা মেনে নেয়া সবচেয়ে কঠিন, সেটা হলো সে আসলে কেউ না, অথচ তাকেই সেখানে আটকে রাখা হয়েছে”।
গোপন এই বন্দীশালায় একসময় ‘উচ্চ পর্যায়ের’ বন্দীদের আটকে রাখা হতো এবং তাদের উপর জিজ্ঞাসাবাদের সময় বর্বর নির্যাতন চালানো হতো। যেগুলো প্রকাশের পর এই কারাগার ও কর্তৃপক্ষ ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে।
যদিও অধিকাংশ বন্দীদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বা অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে, কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ফ্যাসিলিটি রেখে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিউবার দ্বীপে এটির অবস্থান হলেও এটি মার্কিন কর্তৃত্বের অধীনে পরিচালিত হয়।
ওই বন্দীশালায় আরেকজন যে আফগান রয়েছে, সে হলো মোহাম্মদ রহিম। হারুনের বেশ কয়েক মাস পরে তাকে ওখানে নেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে সিআইএর অভিযোগ হলো, সে আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের ঘনিষ্ট সহযোগি ছিল।
কিন্তু আফগানিস্তান অ্যানালিস্টস নেটওয়ার্কের সহ-পরিচালক কেট ক্লার্ক বলেন, হারুন কোন উল্লেখযোগ্য সন্ত্রাসী ছিল না।
হারুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রথমে গোপন রাখা হয়েছিল। পরে উইকিলিক্স সেগুলো প্রকাশ করে।
তিনি এএফপিকে বলেন, “গুয়ানতানামের ব্যাপারে আপনারা যাই ভাবুন না কেন, সেখানে রাখার মতো কেউ নন হারুন…”।
হারুনের পরিবার ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। তারা স্বীকার করেছে যে, হারুন হিজবে ইসলামির সদস্য ছিল। শরণার্থী শিবিরে এ ধরণের আরও অনেকেই আছে।
হিজবে ইসলামি ২০১৬ সালে কাবুল সরকারের সাথে শান্তি চুক্তি করে এবং এরপর তাদের সব বন্দিদের মুক্তির পথ পরিস্কার হয়।
ত্রিশোর্ধ হারুন জোর দিয়ে বলেছে যে, সে কর্তৃপক্ষের সাথে সহযোগিতার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেছে।
হারুনের আইনজীবী তার একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে, যেখানে হারুন বলেছে, “আমেরিকানদের সাথে সহযোগিতা করার জন্য আমি অনেক কিছু করেছি, কিন্তু এরপরও তারা খুশি নয়”।
রেডক্রসের মধ্যস্থতায় আয়োজিত এক ভিডিও চ্যাটে হারুনের পরিবার দেখতে পেয়েছে যে, হারুনের স্বাস্থ্য এবং কথাবার্তার ধরনে পরিবর্তন এসেছে। সম্প্রতি সে অনশনের ভেতর দিয়ে তার দিন কাটাচ্ছে।
এক বিবৃতিতে হারুণ বলেছে, “আমার ওজন ছিল ১৭৫ পাউণ্ড (৮০ কেজি), আর এখন আমার ওজন ১১০ পাউণ্ড (৫০ কেজি)। গুয়ানতানামোতে আমার ওজন অন্তত ৬৫ পাউণ্ড কমে গেছে”।