নোবেল মনোনয়ন হলো আফগান নারীদের লড়াইয়ের স্বীকৃতি: ফৌজিয়া কুফি

ফৌজিয়া কুফি
আফগান পার্লামেন্টের প্রথম নারী ডেপুটি স্পিকার ফৌজিয়া কুফি নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন, দোহায় তালেবানের সাথে আলোচনা, এবং অতি সাম্প্রতিক যে হামলার শিকার হয়েছিলেন, তা নিয়ে কথা বলেছেন।
আফগান রাজনীতিবিদ ও দোহায় তালেবানের সাথে চলমান শান্তিপ্রক্রিয়ায় আলোচক ফৌজিয়া কুফি বলেছেন, নোবেল পুরস্কারের জন্য তাকে মনোনয়ন (গত সপ্তাহে নরওয়ের পিস কাউন্সিল জানায়, তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারের অন্যতম দাবিদার) করা হলো সমন্বয় প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হতে ও আলোচনার টেবিলে স্থান পেতে আফগান নারীদের প্রতি স্বীকৃতি প্রদান।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় নাম থাকা ও সম্ভাব্য প্রাপক হিসেবে নাম থাকায় কেমন লাগছে?
আমি মনে করি এটি হলো আফগানিস্তানের জনগণ যে প্রয়াস চালিয়েছে এবং যুদ্ধের সময় তারা যে সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ করেছে, তার সম্মিলিত ফলাফল। কারণ আফগানিস্তানের সবাই যুদ্ধের ভিক্টিম হয়েছে। নারীরা বিশেষ করে অবিচারের শিকার হয়েছে, বৈষম্যের মুখে পড়েছে, প্রিয়জনকে হারিয়েছে। তাছাড়া তাদের শিক্ষার অধিকার কাজ করার সুযোগ কেড়ে নেয়া হয়েছিল। ফলে তাদেরও শান্তিপ্রক্রিয়ার অংশ হওয়া উচিত। তাদের অধিকারের সাথে যাতে আপস করা না হয়, তা নিশ্চিত করা উচিত।
আর আমি মনে করি, এই মনোনয়ন হলো শান্তিপ্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হতে ও তাদের কথা শুনতে যে লড়াই করেছিল, তার স্বীকৃতি। আমি মনে করি, এটি হবে আফগান নারীদের প্রয়াসের প্রতি বিপুল স্বীকৃতি। এটি আমাকে দিচ্ছে ব্যক্তিত্ব, অনেক ক্ষমতা এবং ২১ সদস্যের প্রতিনিধিদলের তিন নারী সদস্যকে স্বীকৃতি।
আপনি কি জয়ের প্রত্যাশা করছেন?
আসলে আমরা এখানে এসেছি আফগান নারীদের জন্য বড় কিছু অর্জনের জন্য। এটি ইঙ্গিত দেয় যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বিশ্ব শান্তিপ্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করছে এবং নারীদের অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব বুঝতে পারছে। এমনকি আমি যদি নাও জয়ী হই, তবুও আমি জানব যে তাদের কঠিন লড়াই করতে হবে। আর নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় আসতে পারাটাও কেবল নারীদের জন্য নয়, আফগানিস্তানের জন্যও একটি বড় সাফল্য।
দোহা আলোচনা কেমন চলছে?
আমাদেরকে যা মনে রাখতে হচ্ছে তা হলো এই যে আফগানিস্তানে চার দশক ধরে যুদ্ধ চলছে। দেশে বিপুল প্রত্যাশা সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টিও মনে রাখতে হচ্ছে। লোকজন দ্রুত তাদের জীবনে শান্তিপ্রক্রিয়ার প্রভাব দেখতে চায়। কিন্তু প্রক্রিয়াটিই একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। আমরা একটি ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এখানে ভিত্তি প্রতিষ্ঠার কাজই শুরু হয়েছে।
তালেবান অতীতে বলেছিল যে নারীরা শান্তিপ্রক্রিয়ার অংশ হতে পারবে না। তালেবান নেতৃত্ব আপনাদের এখানে উপস্থিতি নিয়ে কিভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে?
এই পর্যায়ে আমি কেবল নারী হিসেবে বিবেচিত হতে চাই না। আমি দেশের প্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদ হিসেবে বিবেচিত হতে চাই। আলোচনার টেবিলে আমরা চাই সমান অধিকার। আমরা কেবল নারীদের ভবিষ্যত নয়, দেশের সবার ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলতে চাই। আমি মনে করি না যে তালেবান সমাজের ৫৫ ভাগ প্রতিনিধির ব্যাপারে নেতিবাচকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। তাদেরকে বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে, তাদেরকে বুঝতে হবে, আমরা নতুন আফগানিস্তানের অংশ।
তালেবান যদি মূলধারায় ফিরে আসে, তবে নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে ‘নতুন’ আফগানিস্তানে যে অগ্রগতি হয়েছে, তার কী হবে?
আমি জানি যে আফগানিস্তানের জনগণ উদ্বিগ্ন এবং এ নিয়ে নারীদের উদ্বেগ যুক্তিসম্মত। গৃহযুদ্ধের সময় এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
আমার ধারণা, আমরা একটি সমঝোতায় উপনীত হতে পারব। আমরা আশা করি, আফগান সমাজের বৈচিত্র্যের সাথে আমরা খাপ খাওয়াতে পারব।
শেষ কোনো কথা আছে?
আমরা এর মধ্যেই অনেক ভুগেছি। সামাজিক সূচকগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক সম্পদে প্রবেশাধিকার ইত্যাদি দিক দিয়ে গত ২০ বছরে আমরা এগিয়েছি। এটি তালেবান শাসনের আমলের সাথে কোনোভাবেই তুলনা করা যায় না। অবশ্য, অনেক খারাপ সূচকও আছে। এখানে সবচেয়ে বেশি মাতৃমৃত্যু ঘটে, নিরক্ষরতার হারেও সর্বোচ্চ। ফলে শান্তির জন্য আমাদেরকে আর কত মূল্য দিতে হবে?
স্থিতিশীলতা আনার জন্য শান্তির পাশাপাশি অখণ্ডতা, মর্যাদা, অন্তর্ভুক্তিও দরকার। আমাদের দেশে হিন্দু ও শিখও আছে। তারা যদি মনে করে যে তাদের কথা শোনা হবে না, তবে দেশে কোনো শান্তি আসবে না।
আপনি অতি সাম্প্রতিক যে হামলার মু্খে পড়েছিলেন, সে সম্পর্কে কিছু বলুন।
মাস দেড়েক আগে, আমি কোনো এক প্রদেশ থেকে ফিরছিলাম। আমি যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন দেয়া এক সেনা অফিসারের পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় দুটি গাড়ি আমাদের ধাওয়া করতে শুরু করে। তাপর জঙ্গিদের একটি গাড়ি আমাদের থামায়, অন্যটি গুলি করতে থাকে। আমার ডান হাত ভেঙে গিয়েছিল। আমাকে এখনো প্রতিদিন হাসপাতালে যেতে হয় ক্ষত পরিষ্কার করার জন্য। হামলার সময় আমার সাথে আমার মেয়েও ছিল। আমি সৌভাগ্যবান, গুলিটি আমার বুক থেকে তিন থেকে চার সেন্টিমিটার দূর দিয়ে গেছে।
আফগানিস্তানে সহিংসতার জন্য তালেবান দায়ী, এটি মনে রেখে তাদের সাথে আলোচনায় অংশ নেয়াটা কেমন লাগে?
আমি কিছু আবেগময় মুহূর্তের মধ্য দিয়ে যাই। আমরা বুঝতে পেরেছি, সহিংসতার মাধ্যমে আমাদের এজেন্ডা এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। প্রতিদিন আফগান জনগণ জীবন হারাচ্ছে, রক্তপাত হচ্ছে।
আফগানিস্তান ইতিহাসের এই পর্যায়ে ভারতের কাছ থেকে আপনার প্রত্যাশা কী?
আমাদের সরকারের রাজনীতি যাই হোক না কেন, ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক সবসময়ই বন্ধুপ্রতীম ছিল। আমার প্রত্যাশা হলো, শান্তিপূর্ণ সমাধানে আঞ্চলিক দেশগুলো চেষ্টা চালাবে। আমি আশা করি, আমাদের সর্বোত্তম বন্ধু হিসেবে ভারত এতে সম্পৃক্ত হবে। আমি আরো আশা করি, ভারত শিক্ষাব্যবস্থায় সমর্থন প্রদান অব্যাহত রাখবে।