বিস্ফোরন্মুখ ‘পেনশন বোমা’ কীভাবে নিষ্ক্রিয় করবে পাকিস্তান

বর্তমান পাকিস্তানের জনসাধারণ মনেই করে না যে পিএমএল (এন) সরকারই দেশের অর্থনীতিকে সঙ্কটজনক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। বাস্তবতা তুলে ধরতে পিটিআই সরকার উদ্যোগ নিতে দেরি করায় পিএমএল (এন) ও পিপিপি এর পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে। প্রকট অর্থনৈতিক ও আর্থিক সঙ্কট সমাধানের চেষ্টা করছিল এই সরকার। কিন্তু বর্তমান মহামারি সারা দুনিয়ার অর্থনীতিকেই গুঁড়িয়ে দিয়েছে। মূল্য পর্যবেক্ষণ কার্যকরভাবে না করায় নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১৭-১৮ সময়কালের ৫.৬ ভাগ ২০১৮-১৯ সময়কালে ২.৪ ভাগে নেমে আসে। বর্তমান অর্থবছরে তা ১.৫ ভাগ হবে বলে ধারণা করা হলেও তা সম্ভবত (-) ১.৫ ভাগ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। আগামী বাজেট বেশ কঠিন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক পাকিস্তানে ফিরে আসছে। রফতানির ওপর চাপ ব্যাপকভাবে এর মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। তুলা, গম ও সবজি উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়বে।
এসব সমস্যার সমাধানের উপায় খোঁজার চেষ্টা করার সময় আমাদের ব্যয় কমানোর চেষ্টাও সময়ের দাবি। ক্রমবর্ধমান পেনশন বোমা ফাটার সতর্কবার্তা দিচ্ছে। আমাদের বাজেট ব্যয়ের বড় অংশই যায় এই খাতে। ফলে এ দিকে জরুরিভিত্তিতে নজর দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আগস্টে মন্ত্রিসভার বৈঠকে যথাযথভাবেই বলেছেন যে বাড়তে থাকা পেনশন ব্যয় আমাদের বৃহত্তম বাজেটগত চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। একে দ্রুততার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে উন্নয়নের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। কেন্দ্রীয় সরকারের পেনশন খাতে বার্ষিক বরাদ্দ ৪৭০ বিলিয়ন রুপি। এটি বার্ষিক বেতনের কাছাকাছি চলে এসেছে। ফেডারেল ও প্রাদেশিক পেনশন দায়দায়িত্ব আর্থিকভাবে বহন না করার মতো অবস্থায় নেমে এসেছে।
প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত ব্যয় বেড়েছে ব্যাপকভাবে। আর তা এভাবে বেড়ে যাচ্ছে যে আগামী দশকে নিরাপত্তা খাতে ব্যয়ের সুযোগ হবে খুবই কম। ‘পেনশন কমুটেশন’ প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ খেয়ে ফেলছে। পেনশন তহবিলের স্ব-সংস্থানের একটি পরিকল্পনা নিয়ে আলাদাভাবে ও বিস্তারিত সমীক্ষা প্রয়োজন। বেসামরিক কর্মকর্তাদের তুলনায় অনেক আগে অবসরগ্রহণ করে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা জাতীয় কোষাগারের ওপর বোঝায় পরিণত না হয়েই জাতীয় জীবনে ভূমিকা রেখে চলেছে। বাস্তব সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের আগাম অবসরের সম্পূর্ণ বিপরীত ফলাফল দেখা যায়: ১. দ্বিতীয় চাকরির জন্য তাদেরকে পথে নামিয়ে দেয়ার মতো অপরাধ করা হচ্ছে, ২. জরিপ চালানো হলে দেখা যাবে যে তারা তাদের পাওয়া পেনশটের অর্থ বিয়ে আয়োজন, প্রদর্শনীমূলক আইটেম কেনার মতো কাজে ব্যয় করছে, ৩. যারা এখনো উৎপাদনমুখী কাজ করতে সক্ষম, তাদের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে, ৪. রাষ্ট্র অনর্থকভাবে প্রশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল জনশক্তির বিশাল মজুতকে হারাচ্ছে।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রশিক্ষিত জনশক্তিকে (৪০-৫০ বছরে যারা অবসর নিয়ে নিচ্ছে) ব্যবহার করা রাষ্ট্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেসামরিক কর্মকর্তাদের মতো তারাও ৬০ বছর পর অবসর গ্রহণ করে ১২ বছর পর্যন্ত তথা ৭২ বছর পর্যন্ত পূর্ণ পেনশন পাওয়ার অধিকারী হতে পারেন। অথচ এখন সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর তারা অবসর নিয়ে এমন পেশায় চাকরি খুঁজে থাকে, যেখানে তারা প্রশিক্ষণহীন। ফলে তারা তাদের জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আর্থিকভাবে কঠিন অবস্থায় থাকে। তাদের সামনে চাকরির সুযোগ থাকে খুবই কম। এটি ব্যক্তিবিশেষকে হীন ও হতাশ করে তোলে।
যেকোনো ব্যবস্থা অবশ্যই এমন হতে হবে: ১. রাষ্ট্র কমিউটেট পেনশন ব্যয়ের পরিমাণ মুলতবি করবে, ২. প্রশিক্ষণে সময় দানের আলোকে ব্যক্তির উৎপাদনশীলতার পূর্ণ ব্যবহার করতে হবে, ৩. প্রশিক্ষণ ব্যয় বাঁচাতে হবে। এসব দিক বিবেচনা করে প্রস্তাব করা যেতে পারে যে: ১. সিভিল আর্মড ফোর্সেস (সিএএফ), পুলিশ/ম্যাজিস্ট্রেসি, আইন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আর কোনো প্রমোশনের ব্যবস্থা না থাকায় ৪০/৪৫ বছর বয়সেই চাকরি শেষ করার বিষয়টি অবসান করতে হবে। যারা ৬০ বছর পর্যন্ত চাকরি করবে, কেবল তাদের পেছনেই প্রশিক্ষণের অর্থ ব্যয় করতে হবে। তাদেরকে ক. পাকিস্তান রেঞ্জার্স, খ. পাকিস্তান কোস্ট গার্ড, গ. ফ্রন্টিয়ার কনস্টাবুলারি কেপিকে. ঘ. ফ্রন্টিয়ার কোর কেপিকে, ঙ. ফ্রন্টিয়ার কোর বেলুচিস্তান, চ. এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি ফোর্স, ছ. অ্যান্টি নারকোটিক্স ফোর্স, জ. পুলিশ, ঝ. নিম্নতর আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারক পদে নিয়োগ করা যেতে পারে। তারা তাদের আগের চাকরির কারণে এসব কাজে দক্ষতার অধিকারী। ২. পূর্ণ পেনশন দেয়া হবে কেবল ৬০ বছর পর্যন্ত চাকরি করার পরই। ৩. অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ স্কুল ও ইনস্টিটিউশনগুলো বন্ধ করে দিয়ে বিশেষায়িত স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সিএএফের নেতৃত্ব দিতে হবে সেনাবাহিনীকে। কারণা তারাই তাদের পেশাগত কর্তৃব্যের কারণে মান অর্জন করতে পারে।
পুলিশকে সব সরকারই রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে। এর ফলে পুলিশ সদস্যরা যা খুশি করতে পারে। পরিবেশের অবনতি হওয়ায় আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তিই থানায় যেতে চায় না। কোনো নারীকে অভিযোগ দায়েরের জন্য থানায় যেতে বলা মানে তাকে সমস্যায় ফেলে দেয়া। থানা পুলিশের মনোভাব ও দক্ষতা জনসাধারণের ওপর সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়। গত কয়েক বছর ধরে পুলিশ নেতৃত্বের জন্য নতুন ক্যাডার সৃষ্টির আন্তরিক চেষ্টা শুরু হয়েছে। থানার সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হলে সেখানকার সদস্যদের মধ্যে পরিবর্তন আনতেই হবে। থানা এলাকায় ২৪ ঘণ্টা ম্যাজিস্ট্রেট থাকতে হবে। কিন্তু এত ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়া যাবে কোথায়? পুলিশে বদলি হওয়া সেনা কর্মকর্তাদেরকে অবশ্য ন্যূনতম ছয় মাস প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মাধ্যমে কাজটি সম্পন্ন করা যেতে পারে।
এছাড়া আগাম অবসরগ্রহণকারীদেরও নানা পদে নিয়োগ করা যেতে পারে।
এর সুফল হলো ১. পেনশন প্রদান ১৫ বছর পর্যন্ত বিলম্ব করা যেতে পারে। ২. সিএএফের সব উপাদানের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে অনেক সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। ৩. সবসময়ের জন্যই সিএএফে প্রশিক্ষত ও অভিজ্ঞ জনবল পাওয়া যাবে। ৪. সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিট্রেট/বিচারক/শিক্ষক/ থানা অফিসার হিসেবে নিয়োগ করা হলে সার্বিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি হবে। ৫. ম্যাজিস্ট্রেসি/জুনিয়র বিচারক পদে লোকবলের স্বল্পতা দ্রুত কাটানো যাবে। ৬. আমাদের দেশের স্কুল/কলেজের দুরাবস্থার কথা সবাই জানে। এসব প্রতিষ্ঠানে লোকবলের ব্যবস্থা করা যাবে।
এর ফলে যেসব সুবিধা পাওয়া যাবে তা হলো ১. চাকরি ৬০ বছর পর্যন্ত পূর্ণ করা যাবে। ২. বেসামরিক কর্মকর্তাদের মতো সামরিক কর্মকর্তারাও তাদের অবসর নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকবে না। ৩. দ্বিতীয় চাকরির জন্য রাস্তায় নামতে হবে না।
এসব পরিবর্তনের ব্যাপারে সামরিক মানসিকতা স্বাভাবিকভাবেই বিরূপ। তবে বর্তমানে অফিসারদের মান এক যুগের আগের অবস্থার চেয়ে ভালো। তারা এখন অনেক ভালো প্রশিক্ষণ পাচ্ছে। আমাদের সামরিক কর্মকর্তাদেরকে এই কঠিন তবে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।
লেখক: প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক