আমরা লাইভে English বুধবার, জুন ০৭, ২০২৩

পাকিস্তানে জাতীয় স্বার্থকে ছাপিয়ে গেছে কায়েমি স্বার্থ

COLUMN-ENG-09-07-2020

পাকিস্তানী সমাজের একটা ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্য হলো মানুষকে সুবিধা দেয়ার জন্য এবং বিনিময়ে সুবিধা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করা, সেই সুবিধাটা অর্থের মাধ্যমে হোক, বা অন্য কোন উপায়ে। 

পাকিস্তানে খুব সাধারণ ব্যাপারে পৃষ্ঠপোষকতা বা সুরক্ষা লাগে। যেমন, একটা অফিসে গিয়ে আবেদন করতেও এটা লাগবে। এমনকি বাচ্চাকে কোন নির্দিষ্ট স্কুলে ভর্তি করাতেও কাউকে লাগবে যে কি না সাহায্য করতে পারে। কোন বিশেষ জায়গায় কাউকে খুশি রাখতে ঘুষ দেয়া লাগবে কি না, সেটা আমরা খুঁজে বের করি। আমরা এমনকি অপরিচিত মানুষের ক্ষেত্রেও এটা করি, কারণ একদিন হয়তো তাদের জায়গা থেকে সুবিধার প্রয়োজন হবে আমার। 

আমাদের সমাজের বড় ‘ডনেরা’ অনেক বেশি শক্তিশালী এবং কারো সাহায্যের তাদের প্রয়োজন হয় না, কিন্তু তারাও নিজেদের আত্মম্ভরীতার জন্য বিভিন্ন জায়গায় জিনিসপত্র দিয়ে থাকে। 

পিআইএ’র পাইলটদের ভুয়া লাইসেন্সের সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় দেখা গেছে, পাইলটরা পিআইএ সার্ভিসে ঢোকার আগে ঘুষ দেয়া হয়েছিল। দুঃখজনক হলো যাদের পেশাগত যোগ্যতা ও মেধা রয়েছে, তাদেরকেও চাকরি পেতে অর্থ দিতে হয়েছে বা প্রভাব কাজে লাগাতে হয়েছে। 

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডাব্লিউইএফ) পার্টনারশিপ এগেইনস্ট করাপশান ইনিশিয়েটিভের (পিএসিআই) একজন সদস্য হওয়ার কারণে উদীয়মান দেশগুলোর এই অনাকাঙ্ক্ষিত সংস্কৃতির বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। দুঃখজনক হলো পাকিস্তানে পিএসিআই’র সহকর্মীদের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই চর্চাটা করা হয় না, যেটা তারা বাইরে প্রচার করে থাকেন। জেনেভাতে যখনই আমি বিষয়টি তাদের গোচরে এনেছি, তারা তাদের ‘স্থানীয়’ অবস্থানের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। 

ব্যাঙ্কাররা গ্রাহকদেরকে সুবিধা না দিলে তারা কিভাবে ভুয়া একাউন্ট খুলছে? অর্থ লুকিয়ে রাখতে বা কর ফাঁকি দিয়ে দেশের বাইরে অর্থ পাচারের জন্য ব্যাঙ্কাররা এমনকি অন্য ব্যক্তির নামে একাউন্ট খুলেছে, যারা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। অর্থের মালিকরা এই একাউন্টগুলো দেখাশোনা করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একেবারে গরিব কর্মচারীদের দিয়ে তাদের প্রভুদের একাউন্টগুলো পরিচালনা করা হয়। সে কারণে তাদের ‘সুরক্ষা’ দেয়াটা জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। 

অন্যের নামে প্লট হস্তান্তরের জন্য ভুয়া আইডি কার্ড ইস্যু করা হয়। নিয়ম অগ্রাহ্য করার জন্য এবং কর এড়ানোর জন্য আরও বহু কিছু করা হয়, যেখানে রাষ্ট্র এবং এর প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন উপায়ে অবদমন করা হয়। 

আমাদের সমাজে এই ধরনের আচরণ বিদ্যমান থাকার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। পাকিস্তানের সমাজে আজ পর্যন্ত বহু প্রাক-আধুনিক সামাজিক কাঠামো টিকে আছে – যেমন গোত্র, উপজাতি, বেরাদারি এবং বর্ধিত পরিবার ব্যবস্থা। এই ধরনের সামাজিক কাঠামোর কোন সদস্য যদি প্রভাবশালী কোন পদে অধীন হয়, তাহলে তার গোষ্ঠির অন্যদেরকে সুবিধা দেয়াটা তার ঐতিহ্যগত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যায়। যদি সে সেটা করতে অস্বীকার করে, তাহলে সামাজিক কাঠামো থেকে তাকে কোন না কোন ধরনের প্রতিশোধের মুখোমুখি হতে হবে। তাছাড়া, পরে কখনও যদি তার কোন সাহায্য লাগে, তখন গোত্রের অন্য সদস্যরা মুখ ফিরিয়ে নেবে। 

পাকিস্তানে যেহেতু সাহায্য ছাড়া বেঁচে থাকাটা প্রায় অসম্ভব বা অন্তত মারাত্মক কঠিন, সেই কারণে আগে থেকে চলে আসা এই সামাজিক কাঠামোগুলো বারবার নতুন করে শক্তি লাভ করে। অথচ একটা কার্যকর রাষ্ট্র ও শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মধ্যে এগুলো দুর্বল হয়ে যাওয়ার কথা। এর আগে সাবেক ফ্রন্টিয়ার অঞ্চলে (এফএটিএ) একটা জরিপ চালানো হয়েছিল, যেখানে সরকারের কোন কার্যকর কাঠামো ছিল না। জরিপে দেখা গেছে, গোত্রের উপাদানগুলো সেখানে অনেক বেশি শক্তিশালী। 

দীর্ঘ সামরিক শাসন এবং এর সাথে উত্তরাধিকার হিসেবে চলে আসা স্বজনপ্রীতির কারণে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ভালোভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের সেরা ও মেধাবি জনশক্তিদের আমলাতন্ত্রের জন্য বাছাই করা হয়, কিন্তু আমলারা অল্প সময়ের মধ্যেই অর্থ বা প্রতিপত্তির কাছে নতি স্বীকার করেন। 

কিছু কাল একটা জাতীয় প্রকল্পের সাথে কাজ করেছি আমি। গরিব আর অসহায়দের সহায়তার বিষয় ছিল প্রকল্পটিতে। কোন ঘুষ ছাড়াই কাজ করার এবং সৎ কর্মকর্তাদের সাথে কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। কিন্তু আমার প্রতিপক্ষরা ঘুষ দিয়ে প্রকল্পটিতে বাধা সৃষ্টি করেছে, যাতে এটা কাজ করতে না পারে। 

আমাকে যেটা উদ্বিগ্ন করেছে, সেটা হলো জাতীয় প্রকল্পে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। এটা সত্য যে, এখানে আমার ব্যক্তিগত স্বার্থ আছে, কিন্তু জাতীয় স্বার্থ তার চেয়ে অনেক বড়। শুধু দরিদ্রদের অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করা নয়, বরং অর্থনীতি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার একটা বিশাল পদক্ষেপ এটা। 

পাকিস্তানের বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য বানিয়েছে। তারা জনগণের অর্থ আত্মসাৎকারী এবং কর ফাঁকি দেয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু শিক্ষা, মিডিয়াসহ অন্যান্য খাতেও পদক্ষেপ নেয়া দরকার যাতে এই সব খাতের সাথে জড়িতরা বুঝতে পারেন যে, সব জায়গাতেই স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করার নিয়ম নীতি রয়েছে। 

পাশ কাটিয়ে যাওয়া, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের নীতিকে পাস কাটিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কিছু আছেন যারা ক্ষমতাসীন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের সাথে সম্পৃক্ত এবং দলের লক্ষ্যের ব্যাপারে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়। ‘বন্ধুত্বের’ নামে কর্মকাণ্ড চালানো, সুবিধা দেয়া বা সরাসরি ঘুষ বিনিময়ের বিষয়গুলো আমাদের সমাজের জন্য ক্ষতিকর এবং পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্যেই সেগুলো হুমকির। ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরোর (এনএবি) উচিত, এই ধরনের ব্যক্তিদের ব্যাপারে তদন্ত করা, এবং দোষি সাব্যস্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, যাতে একটা উদাহরণ তৈরি হয়। 

 

(লেখক একজন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক)