নেপালি আফগানিস্তান ও ইরাক ভিক্টিমরা ক্ষতিপূরণ ও বিচার চায়

গোর্খা জেলার বাকরঙের কমলা থাপা বিয়ে ও মা হওয়া হয়ে গেছেন ১৯ বছরের মধ্যেই। তার শিশু মেয়েটি যখন তাদের গ্রামের বাড়িতে হাঁটি হাঁটি পা পা করছে, প্রথম কথাটি বলছে, তখন প্রায় অর্ধ পৃথিবী দূরে মর্মান্তিক একটি ঘটনা মা আর মেয়ে উভয়ের দুনিয়া সারা জীবনের জন্য বদলে দিলো। ২০০৪ সালের আগস্টের শেষ দিকে আনসার আল সুন্নার জঙ্গিরা ইরাকে ১২ নেপালি শ্রমিককে অপহরণ করে হত্যা করে। তাদের মধ্যে কমলার স্বামী জিত বাহাদুরও ছিলেন।
বাবাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন কমলার মেয়ের বয়স ছিল ২২ মাস। এখন সে কাঠমান্ডুতে একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। স্বামীকে হারানোর ১৬ বছর পর কমলা বলছেন, আমি যখন আজো শুনি যে নেপালিরা কাজের জন্য ইরাকের মতো সঙ্ঘাতময় এলাকায় যাচ্ছে, সেখানে হামলায় হতাহত হচ্ছে, তখন আমার আগের দিনের কথা মনে পড়ে। আমি এ ধরনের খবর পড়তে চাই না। আমি কেবল শিরোনাম পড়েই শেষ করি।
২০০৪ সালের হত্যাকারীরা একটি ভিডিওর মাধ্যমে নেপালের জাতীয় স্মৃতিতে প্রবল আঘাত হানে ভিসিডি, মেমোরি কার্ডের মাধ্যমে (ওই সময় ইউটিউব ছিল না) তা ভাইরাল হয়। সরকার সাথে সাথে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তাতে দেখা যায়, কাঠমান্ডুভিত্তিক মুনলাইন ম্যানপাওয়ার কোম্পানি ওই লোকদের ভালো চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে জর্ডানের বদলে ইরাক নিয়ে যাচ্ছে।
এতে কাঠমান্ডুতে হাজার হাজার লোক বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা ওই জনশক্তি সংস্থাসহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠান ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করে। অনেকে মুসজিদ, মধ্যপ্রাচ্যের দূতাবাস এবং এমনকি গালফ এয়ারলাইন্সের অফিসে পর্যন্ত হামলা করে ইসলামের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগটি গ্রহণ করে।
কিন্তু অল্প কিছু নেপালিই জানত যে নেপালিদের ওই মৃত্যুর পেছনে আমেরিকান সামরিক বাহিনী ও একটি বিশাল আমেরিকান করপোরেশনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কয়েক মাস পরে জানা যায়, ওই লোকগুলো সামরিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কেলগ ব্রাউন অ্যান্ড রুট বা কেবিআর তথা ইরাকের একটি মার্কিন ঘাঁটিতে কাজ করার জন্য গিয়েছিল। এক বছর পর নিহত লোকদের পরিবারবর্গ কেবিআরের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করে। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর তারা ২০০৮ সালে ক্ষতিপূরণ মামলায় জয়ী হয়।
ওই ঘটনার পর নেপালি সরকার তাদের নাগরিকদের ইরাকে কাজ করা নিষিদ্ধ করে। অবশ্য, লাখ লাখ ইরাকি নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে ২০০৪ সাল থেকেই আমেরিকান ঠিকাদারদের হয়ে ইরাক ও আফগানিস্তানে যাচ্ছে কাজের জন্য। এসব শ্রমিক যখন আহত বা নিহত হয়, তখন তাদের বেশির ভাগই জানে না যে তারা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী। তাদের নিয়োগকর্তারা প্রায়ই তাদের পর্যাপ্ত সুবিধা দেয় না।
বর্তমানে আইনজীবীরা আমেরিকান যুদ্ধ জোনে হতাহত নেপালিদের ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

সামরিক বাহিনী-ঠিকাদার আঁতাতের বিরুদ্ধে লড়াই
২০০৪ সালে লোকজন ভাবত, নেপালি লোকেরা ইরাকে গিয়ে কী করছে?
এর জবাব পাওয়া যাচ্ছে শিকাগো ট্রিবিউন পত্রিকার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ক্যাম সিম্পসনের কাছে।
তিনি ব্যাপক অনুসন্ধান করে দেখেছেন যে ওই লোকগুলোকে কেবিআরের একটি উপ-ঠিকাদারের হয়ে কাজ করতে পাঠানো হয়েছিল। আর এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে আমেরিকান সামরিক বাহিনী ও রাজনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি একসময় ছিলেন কেবিআরের প্যারেন্ট কোম্পানি হালিবারটনের সিইও। তারা সারা দুনিয়া থেকে পাচক, প্রহরী, গাড়িচালক, মেকানিক্স, দারোয়ান ও অন্যান্য পদে লোক সংগ্রহ করে ইরাকজুড়ে মার্কিন ঘাঁটিগুলোকে সহায়তা করে। নেপালের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কেবিআরই নেপাল থেকে লোকজন সংগ্রহ করে থাকে। এই লোকগুলো জর্ডান থেকে নতুন কর্মস্থলে যাওয়ার সময়ই আনসার আল সুন্নার কবলে পড়েছিল।
গবেষণার অংশ হিসেবে সিম্পসন নেপাল সফর করেন। তিনি নেপাল ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের শিক্ষাবিদ গনেশ গুরুঙের সাথে সাক্ষাত করেন। গনেশই তাকে নিহত পরিবারগুলোর সাথে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন।
সেখানেই কমলার সাক্ষাত পান সিম্পসন। তিনি ২০০৫ সালে তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। গরিব নেপালিদের এভাবে মৃত্যু মেনে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অনেকেই তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। ক্ষতিপূরণের জন্য মামলা দায়েরের ব্যবস্থাও এভাবে হয়।

আমেরিকার একটি আদালত ২০০৮ সালে নেপালিদের পক্ষে রায় দেয়। ১২টি পরিবারের মধ্যে ৯টি ক্ষতিপূরণ পায়। তবে তিনটি পায়নি, কারণ তারা বিবাহিত ছিলেন না এবং তাদের মা-বাবাও ছিল না। আমেরিকার আইনে ভাই-বোনেরা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী নন।
অনেক ঘটনা
এই জয় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। ক্ষতিপূরণ পেয়ে অনেকেই জীবন সংগ্রামে লড়াই করার একটি হাতিয়ার পেয়ে যায়।
বর্তমান অভিবাসন
ইরাকে ১২ নেপালি অপহৃত ও খুন হওয়ার পর নেপাল সরকার তাদের নাগরিকদের ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইরাক ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তবে ২০১০ সালে তা প্রত্যাহার করা হয় সামান্য কিছু সময়ের জন্য। এরপর আবার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় এবং তা এখন পর্যন্ত বহাল আছে। আর আফগানিস্তানে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয় ২০১৬ সালে। ওই সময় বাসবোঝাই নেপালি নিরাপত্তা রক্ষীরা কাবুলে এক আত্মঘাতী হামলায় নিহত হয়।
তবে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নেপালিরা অবৈধভাবে ইরাক ও আফগানিস্তানে যাওয়া অব্যাহত রেখেছে। তারা সেখানে প্রধানত আমেরিকান সামরিক সংশ্লিষ্ট কাজেই অংশ নেয়। ইরাকে নেপালি অভিবাসীরা বেশ কিছু সংগঠন গড়ে তুলেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে নেপাল মাইগ্রেন্টস সোসাইটি, নেপাল তামাঙ চেদং কুর্দিস্তান, নেপালি ওম্যান সোসাইটি কুর্দিস্তান, কুর্দিস্তান মাইগ্রেন্টস নেপালি সোসাইটি, নন-রেসিডেন্ট নেপালি এসোসিয়েশন অব ইরাক।
শেষোক্ত সংগঠনের সভাপতি লালকাজি গুরংয়ের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ইরাকে প্রায় ১৫ হাজার নেপালি আছে। তাদের মধ্যে প্রায় ৫ হাজার কাজ করে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোতে। ইরাক ও আফগানস্তানে প্রায় ৫০ হাজার নেপালি কাজ করে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।

গুরং বলেন, অবৈধ অভিবাসন ঠেকানো যাচ্ছে না। আর এতে করে নাজুকতার মাত্রা বাড়ছে।
মার্কিন শ্রম দফতরের তথ্যে দেখা যায়, মাত্র শ’ তিনেক নেপালি ডিবিএ-র আওতায় ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে। কিন্তু প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি।