কোভিড-কেন্দ্রিক সহযোগিতার উপর মনোযোগ দিচ্ছেন তুরস্কের নোবেল জয়ী সাহিত্যিক
ওরহান পামুক বলেছেন, আমরা সবাই এখন এক নৌকায় – আর সবাই একই ভয়ে আতঙ্কিত

১৯০১ সালে অটোম্যান সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়া প্লেগ নিয়ে বই লিখছিলেন তুরস্কের নোবেল জয়ী ঔপন্যাসিক ওরহান পামুক। যখন তিনি ভেবেছিলেন যে, লেখা শেষ হয়েছে, তখনই ছড়িয়ে পড়লো করোনাভাইরাস মহামারী। নতুন চিন্তা নিয়ে আবার তিনি ফিরে গেলেন লেখায়।
তাই ‘নাইটস অব প্লেগ’ যখন মুক্তি পাবে, তখন সেখানে আধুনিক জীবনযাপনের বহি:প্রকাশ থাকবে।
৬৮ বছর বয়সী পামুক ইস্তাম্বুলের অধিবাসী। এখন তিনি নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন।
পামুকের পুরো সাহিত্য কর্মের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পশ্চিম আর পূর্বের ইসলামি বিশ্বের মধ্যে প্রতিতূলনা। তিন দশক ধরে এই দুই বিশ্বের সম্মিলনের জায়গাগুলো অবলোকনের পর চার বছর আগে ‘নাইটস অব প্লেগ’ লিখতে শুরু করেন তিনি।
তিনি বলেন, “প্লেগ অন্যতম লিটমাস টেস্ট যেটা আপনাকে পশ্চিম আর ঐতিহ্যগত পূর্বের মুসলিম সমাজের পার্থক্যটা বুঝতে শেখাবে”।
বইয়ে বর্ণিত প্লেগকালীন বিশ্ব আর আজকের বিশ্বকে কিভাবে তুলনা করবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে পামুক বলেন, “পুরো প্লেগ মহামারী আর আজকের করোনাভাইরাসের মধ্যে বিস্ময়কর মিল রয়েছে। তার কারণ এটা নয় যে, মাইক্রোবস, ভাইরাস, জীবাণু – এগুলো সবসময় এক ছিল, বরং আসল কারণ হলো মানুষ (প্রতিক্রিয়া) সবসময় একই রকম ছিল”।
এইসব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে মহামারীর অস্তিত্ব এবং এর ভয়াবহতা নিয়ে ‘সরকারের অস্বীকৃতি’। যে সরকার বাস্তবতা অস্বীকার করে, তারা প্রথম পদক্ষেপটাই নেয় ভুল। পামুক বলেন, “এই অস্বীকার করাটা অবশ্যম্ভাবী, কারণ [সরকার] মহামারীর খবর শুনতে চায় না। কেউ কোয়ারেন্টিন পছন্দ করে না”।
পামুক বলেন, যখন কোন নতুন ভাইরাস ছড়াতে শুরু করে, তখন সরকার প্রথম যেটা করে, সেটা হলো কি ঘটছে, সেটা অস্বীকার করা। “দ্বিতীয়ত, খুব অবহেলার সাথে তারা এর মোকাবেলা শুরু করে, যেটা সবাইকে ক্ষুব্ধ করে তোলে”।
তিনি বলেন, ১২০ বছর আগের সময় আর আজকের মধ্যে আরেকটি মিল হলো, ‘কে মহামারী নিয়ে এসেছে’, এটা নিয়ে মানুষের গুজব রটানো এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আওড়ানো। এখন যেমন বলা হচ্ছে করোনাভাইরাসের মাধ্যমে ‘যুক্তরাষ্ট্রকে জবাব দিয়েছে চীন’।
আজকের মহামারীর একটি দিক শুধু পামুককে বিস্মিত করেছে। সেটা হলো এখন আতঙ্কের মাত্রা অনেক বেশি।
তিনি বলেন, “আমার উপন্যাসে আতঙ্ক ছাড়া আর সব কিছুই আছে”। তিনি আরও বলেন যে, “আমি যতটা ভীত ছিলাম, আমার উপন্যাসের চরিত্ররা ততটা ছিল না। সে কারণে আমি ফিরে গিয়ে তাদেরকে আরও বেশি ভীত করে তুলেছি”।
তিনি বলেন টিভি বা অন্যান্য যোগাযোগ চ্যানেলগুলো যখন ইটালিয়ান হাসপাতালগুলোর চারপাশের ভয়াবহতা প্রচার করছে, তখন অনেক বেশি আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে। পামুক বলেন, “পুরনো সময়ে, প্লেগে মৃত্যুর আশঙ্কা এখনকার তুলনায় ১০ গুণ বেশি ছিল, কিন্তু মানুষ ভীত ছিল অনেক কম”।
তিনি বললেন, “আমরা দৃশ্য দেখে বেশি ভয় পাচ্ছি। মৃতদেহের ছবি, বিপুল সংখ্যা আর কিভাবে সেটা ছড়াচ্ছে, সেটা আমাদেরকে ভীত করছে”।
তিনি বলেন, ১২০ বছর আগের সাথে আমাদের সময়ের আরেকটা পার্থক্য হলো সরকারগুলো দায়িত্ব নেয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে, বিশেষ করে যখন বাস্তবতা প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি বলেন, “অতীতে, সরকার মানুষকে কমই নির্দেশনা দিতো যে কি করতে হবে”।
পামুক বলেন, আজ এমনকি তুরস্কের ইসলামপন্থী সরকারও ‘চরম সেক্যুলারের মতো আচরণ করছে’ এবং মসজিদ বন্ধ করে দিয়েছে। “আমার কুসংস্কার ছিল যে, এটা হবে না, কিন্তু বিস্ময়করভাবে, তুরস্কের সরকার সেটা ভালোভাবেই করেছে। [এবং] প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান যেহেতু ইসলামপন্থী, তাই কেউই জুমার নামাজের জন্য মসজিদ বন্ধের সমালোচনা করেনি”।
পামুক বলেন, এই উন্নয়নের পেছনে দুটো বিষয় রয়েছে – বিগত কয়েক দশকে পৃথিবীর বহু দেশে শিক্ষিতের হার নাটকীয়ভাবে বেড়েছে এবং প্রযুক্তির কল্যাণে তথ্যের প্রাপ্যতাও অনেক বেড়ে গেছে। “এখন ৯৮% মানুষ লিখতে পড়তে জানে। বিংশ শতকের শুরুর দিকে এই মাত্রা ছিল ৩% থেকে ৫%”।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ ‘মানবতা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি কাছাকাছি নিয়ে এসেছে’। তিনি বলেন, নিউ ইয়র্ক, অস্ট্রেলিয়া এবং সারা বিশ্বে কি ঘটছে, সেই অভিজ্ঞতাটা আমরা বিনিময় করতে পারছি। “আমরা সবাই এখন এক নৌকায়। এর আগে মানব ইতিহাসে আর কখনও এটা হয়নি”।
পামুক বলেন, বিভিন্ন দেশের মধ্যে আরও সহযোগিতা বাড়ানোটা এখন গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, ‘বিদেশভীতের প্রচারণা’ দিয়ে মানুষের বিভ্রান্ত হওয়াটা উচিত হবে না। সভ্যতার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘একই আতঙ্কে ভীত মানব সম্প্রদায়, আর এটা ঘটছে বিশ্বব্যাপী’।