কোভিড-১৯ লড়াই: গো-মূত্র পানের সংবাদ নয়, বিজ্ঞান প্রচার করতে হবে ভারতীয় মিডিয়াকে

ভারতের যদিও কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে মাত্র ১,২৫০টি, কিন্তু মহামারীটি ইতোমধ্যেই ভারতের বিজ্ঞান, ধর্ম ও মিডিয়ার খবর নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে বিদ্যমান ভুল বুঝাবুঝির ব্যাপ্তির ভয়াবহতা ও ঝামেলাপূর্ণ যোগাযোগ প্রকাশ করে দিয়েছে।
কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পর ক্ষমতাসীন বিজেপির এক কর্মী সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে গো-মূত্র পানের জন্য পশ্চিমবঙ্গে একটি পার্টির আয়োজন করেন। আরো অনেকে এই বলে এ উদ্যোগকে স্বাগত জানায় যে গো-মূত্র মহৌষধ হিসেবে কাজ করে। বলা হতে লাগল যে এটি কেবল কোভিড-১৯ নয়, সেইসাথে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের মতো রোগ থেকেও রক্ষা করে।
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী যোগী আদিত্যনাথ বিশ্বাস করেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণ সারিয়ে তুলতে পারে যোগ ব্যয়াম। কেউ কেউ বিশ্বাস করে, ভারতের উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় নোভেল করোনাভাইরাস টিকে থাকতে পারবে না।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদিও কোভিড-১৯-এর জন্য তিন সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করেছেন, কিন্তু এর সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করছে বিজ্ঞান ও যুক্তির প্রতি জনসাধারণের জ্ঞান ও আস্থার ওপর। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কলেজের বিজ্ঞান শিক্ষা প্রদানকারী হিসেবে বৈজ্ঞানিক ধারণা ও সঠিক তথ্য প্রচারে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।
ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের অনেকে প্রায়ই দাবি করে থাকেন যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সাম্প্রতিক যে উন্নতি হয়েছে তার ভিত্তি হলো প্রাচীন ভারতীয় লোকদের অবদান। ২০১৪ সালে চিকিৎসক ও অধ্যাপকদের এক সভায় বক্তৃতাকালে মোদি হিন্দু পুরানতত্ত্ব ও গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রচার করেন যে প্রাচীনকালেও কসমেটিক সার্জারি ও জেনেটিক বিজ্ঞানের ধারণা ছিল।
মোদির লকডাউন ঘোষণার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই যোগী আদিত্যনাথ একদল সাধুকে নিয়ে এক হিন্দু দেববতার পূজা সম্পন্ন করেন।
এটা এমন এক দেশে ঘটছে, যে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহেরলাল নেহরু দৃঢ়ভাবে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে তাদের জীবনযাত্রা পরিচালনা করতেন। কিন্তু ভারতের মিডিয়ার কারণেই এই মানসিকতা তেমনভাবে ছড়ায়নি। এই মিডিয়া বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ও নির্দেশনা বিকাশের বদলে কুসংস্কার প্রচারে নিয়োজিত থেকেছে।
প্রিন্ট মিডিয়ার যেখানে উপনিবিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে, এবং সামাজিক অপৎশক্তিগুলোর বিরুদ্ধে সফলতা পেয়েছে, সেখানে নতুন শক্তিশালী ইলেকট্রনিক মিডিয়া তার পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে।
তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন, পরমাণু শক্তি, মহাকাশ কর্মসূচি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের আবিষ্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলোর জ্ঞান বিস্তার করতে পারত। কিন্তু তারা জনসাধারণের মধ্যে থাকা বদ্ধমূল ধারণা ও বিশ্বাসের সমর্থনেই তথ্য প্রচার করছে।
গণমাধ্যমের মালিকানার ওপর বিধিনিষেধের অনুপস্থিতিতে ভারতের মিডিয়ার একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে বৃহৎ, মুনাফামুখী করপোরেশনগুলো। এ কারণে এসব কোম্পানি মিডিয়ার অন্যান্য কার্যক্রমের প্রতি আগ্রহ না দেখিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ব্যবসায়িক স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেয়।
যে অল্প কিছু লোক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সম্পর্কে জানতে চায়, তাদেরকে এজন্য অর্থ পরিশোধ করতে হয়। অথচ ক্রিকেট, রাজনীতি, বিনোদনের খবর সামাজিক মিডিয়া ও টেলিভিশনে সহজেই পাওয়া যায়। বিনোদন-চালিত খবর সাধারণ মানুষের মানসিকতা গড়ে দেয় এবং তারা অবৈজ্ঞানিক তথ্য বিশ্বাস করে এবং এমনকি বিজ্ঞানবৈরী পর্যন্ত হয়ে ওঠে।
এই কোভিড-১৯-এর বিস্তার ভারতে কয়েকটি বিষয় প্রকাশ করে দিয়েছে। প্রথমত, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ ও যৌক্তিক চিন্তা করেন, এমন লোকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা প্রকাশ করেছে। যারা স্বাস্থ্যের চেয়ে প্রতিরক্ষাতে বেশি ব্যয়ের কথা বলেন, তাদের এখন ভাবা উচিত।
গত দশকে ভারতে বেশ কয়েকজন যুক্তিবাদী লেখককে হত্যা করার ঘটনা দেখেছে। এসব লেখক তাদের লেখার মাধ্যমে কল্পকথা, কুসংস্কার, হিন্দু বৈষম্যমূলক বর্ণবাদীব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরেছিরেন। এসব যুক্তিবাদীর লক্ষ্য ছিল জ্ঞানের বিস্তার, কুসংস্কারের দমন।
আমরা সবকিছুর জন্যই মিডিয়াকে দায়ী করতে পারি না। বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, শিক্ষাবিদদেরও উচিত মিডিয়া সম্পর্কে কম ভীতিগ্রস্ত হওয়া ও যারা লিখতে পারেন, মিডিয়ার সাথে যারা জড়িত, তাদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করা।
একমাত্র বিজ্ঞান-মনস্ক বিষয়বস্তুই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন এমন রোকজনকে পার্লামেন্ট পাঠানোর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে।