মিয়ানমারের নির্বাচনে প্রাধান্য পাবে গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবি

রোববার মিয়ানমারে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যেটা দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। ভোটারদের সামনে প্রধান দুটো ইস্যু হলো: (১) বেসামরিক সরকার আর এখনও ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর মধ্যে নড়বড়ে ভারসাম্য; (২) অর্থনীতি ও সংবিধান সংস্কারের জন্য ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) সরকারের প্রচেষ্টায় শক্তি যোগানো।
এই নির্বাচন ভোটারদের একটা সুযোগ দিয়েছে এবং তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে যে, ক্যারিশম্যাটিক নেতা অং সান সু কির নেতৃত্বাধীন এনএলডি সরকারকে তারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করার জন্য আরেকটি সুযোগ দেবে কি না।
এনএলডি যদিও ২০১৫ সালের নির্বাচনে জিতেছিল, কিন্তু দেশের উন্নয়নের বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী তাদের জোরালো ভূমিকা জারি রাখে, এবং ‘লেডি’ হিসেবে পরিচিত সু কির জন্য শাসনকার্য চালানোটা কঠিন হয়ে পড়ে। সামরিক বাহিনী এখনও ব্যাপক রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চা করে, যেটা কার্যত একটা ‘জোট’ সরকার। ২০০৮ সালের সামরিকপন্থী সংবিধান অনুসারে, জাতীয় ও আঞ্চলিক পার্লামেন্টগুলোতে সামরিক বাহিনীর ২৫% আসন রয়েছে। সেনাপ্রধান সীমান্ত, প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রীদের নিয়োগ দেন; এবং প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ইস্যুতে তাদের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন রয়েছে।
২০১০ সালে সাবেক জেনারেলরা বহুদলীয় গণতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে ক্ষমতার পালাবদলে সম্মত হওয়ার পর থেকে এটি তৃতীয় নির্বাচন। সামরিক বাহিনী এটাকে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ বলতে পছন্দ করে।
যদিও নব্বইটির বেশি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, কিন্তু আসলে দুইটি দলই এখানে গুরুত্বপূর্ণ: এনএলডি আর সামরিক বাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। মিয়ানমারের নির্বাচনী ব্যবস্থা হলো ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ সিস্টেমের, যার অর্থ হলো ছোট দলগুলো বিশেষ করে নতুনগুলো এখানে খুবই অসুবিধার মধ্যে থাকে।
“ক্ষমতাসীন এনএলডি’র বিকল্প খুবই সীমিত। ইউএসডিপি তাদের সামরিক প্রক্সির পরিচয় মুছে ফেলার কোন চেষ্টাই করেনি। সামান্য কিছু মানুষ চায় তারা ক্ষমতায় ফিরে আসুক,” বললেন ইয়াঙ্গুন ভিত্তিক স্বাধীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কনসাল্টেন্ট নিয়ানথা মাউ লিন।
সাউথ এশিয়ান মনিটরকে তিনি বলেন, “যে সব জায়গায় জাতিগত দলগুলোর উত্থান হয়েছে এবং তাদের ব্যাপারে আগ্রহ বেড়েছে, এই দলগুলোর কেউ কেউ এনএলডির বিপরীতে তরুণ প্রার্থীদের দাঁড় করিয়েছে, কিন্তু তাদের সমর্থন ভৌগলিকভাবে সীমিত। সব দলকেই মিয়ানমারের নির্বাচনী ব্যবস্থার ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট সিস্টেমের বড় বাধা অতিক্রম করতে হবে।
ইয়াঙ্গুনে কোভিড-কেন্দ্রিক বিধিনিষেধের কারণে ৪১ বছর বয়সী নারী হকার ইয়াদারনা খাইনের ব্যবসার ভালোই ক্ষতি হচ্ছে। তিনি বললেন: “সবগুলো দলের মধ্যে আমি শুধু এনএলডি আর ইউএসডিপিকেই চিনি। আমি এনএলডিকে ভোট দেবো। আমি আশা করছি পরের সরকার আমাদের সব সমস্যার সমাধান করবে”।
মাঠে ময়দানে মহামারির কারণে প্রচারণা কার্যত থেমে আছে। কিন্তু মান্দালে ও ইয়াঙ্গুনের মতো শহর এলাকাগুলো এনএলডির লাল পতাকা আর পোস্টারে ছেয়ে গেছে। ‘গ্রিন’ পার্টি হিসেবে পরিচিত ইউএসডিপির সমর্থন প্রকাশ্যে তেমন নজরে আসছে না।
নির্বাচনে যদিও অনেক দল অংশ নিচ্ছে, কিন্তু অধিকাংশ ভোটারই ভালোভাবেই বোঝেন যে আসল বিকল্প হলো দুটো – গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা ও অর্থনৈতিক সংস্কার, অথবা অতীতের দমন আর দুর্নীতির মধ্যে ফিরে যাওয়া।
“প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর নীতির মধ্যে পার্থক্যটা এর চেয়ে বড় হতে পারে না। ভোটারদেরকে হয় এনএলডির অর্থনৈতিক উদারিকরণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির প্রচেষ্টাকে সমর্থন দিতে হবে, অথবা ইউএসডিপির সাবেক প্রেসিডেন্ট থিন সিনের প্রশাসনের অধীনে মিয়ানমারের অর্থনীতি যেভাবে রক্ষণশীলভাবে উন্মুক্ত হয়েছে, সেটাকে সমর্থন দিতে হবে,” বললেন সরকারী ও প্রাইভেট খাতের কনসালটেন্ট এবং ইয়াঙ্গুনের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা ফেলিক্স হ্যাস।
তিনি আরও বলেন, “মোটের উপর সবগুলো রাজনৈতিক দলই দুর্বলভাবে তৈরি ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেছে। এগুলো কম বেশি শ্লোগানের মতো,” মন্তব্য করলেন ইয়াঙ্গুন ভিত্তিক স্বাধীন বিজনেস কনসালটেন্ট ও আর্থিত সেবা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম মাউং।
তিনি আরও বলেন, “তাদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও অগ্রাধিকারের ব্যাপারে বিশদ বিবরণের অভাব রয়েছে”।
কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য এটা ‘জীবন জীবিকা’ ইস্যু যেটা তাদের কাছে প্রধান বিষয়। মান্দালের একটি চায়ের দোকানের ২০ বছর বয়সী ওয়েটার অং থু এসএএমকে বলেন, “আমি এনএলডিকে সমর্থন করি কারণ ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তারা ভালো কাজ করেছে। গ্রামগুলোতে এখন বিদ্যুৎ আছে এবং ভালো রাস্তাঘাট আছে, যেটা ২০ বছর আগের অবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। আশা করি তারা আবার নির্বাচিত হলে দেশের আরও উন্নতি করবে”।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় ত্রিশজনেরও বেশি ভোটারের সাথে কথা বলে, যদিও তাদের অধিকাংশই শহর এলাকার, এসএএম দেখতে পেয়েছে যে, ষাট শতাংশ ভোটার এনএলডির সমর্থক।
ইয়াঙ্গুনভিত্তিক ৩১ বছর বয়সী নারী যোগাযোগ কনসালটেন্ট শোয়ে ই স মাইন্ত সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, “আমি এনএলডিকে ভোট দিবো কারণ আমি ইউএসডিপি বা অন্য কোন দলকে পছন্দ করি না”। তবে নির্বাচন আদৌ অবাধ ও সুষ্ঠু হবে কি না, সে ব্যাপারে তার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
তিনি আরও বললেন, “বর্তমান এনএলডি সরকার দুর্নীতি কিছুটা কমিয়েছে, যেটা আগের সরকারগুলোর তুলনায় কিছুটা বেশি। কিন্তু নির্বাচিত হলে পরবর্তী এনএলডি সরকারকে তাদের সংস্কার এজেন্ডা নিয়ে আরও তৎপর হতে হবে”। তিনি বললেন, এর মধ্যে অবশ্যই শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা, বিশেষ করে শহর এলাকাতে দারিদ্র বিমোচন, এবং জাতীয় সমঝোতা ও শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার বিষয়গুলো থাকতে হবে।
অধিকাংশ ভোটার সাউথ এশিয়ান মনিটরকে এই বার্তাটাই দিয়েছেন: “আমরা এনএলডিকে সমর্থন করি এবং সেটা করে যাবো, কারণ তারা এখনও সক্রিয়ভাবে সংস্কার ও দেশের উন্নয়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে”।
মান্দালের ৫৯ বছর বয়সী কর্পোরেট আইনজীবী থিন নাইং বলেন, “আমি চরমভাবে আশা করি যাতে পরবর্তী সরকার একটা নতুন ফেডারেল গণতান্ত্রিক সংবিধান চালু করে। পরবর্তী সরকারকে অবশ্যই এই প্রধান ইস্যুটি বিবেচনায় নিতে হবে”।
সাক্ষাতকার নেয়া আরও অনেক ভোটারই একই ধরনের মনোভাব প্রকাশ করেছেন। “আমি এনএলডিকে সমর্থন করি, তারাই একমাত্র দল যারা প্রকৃত গণতন্ত্র ও উন্নত অর্থনীতি নিয়ে আসতে পারবে,” বললেন মান্দালের ৩৩ বছর বয়সী ট্যুর গাইড থু।
অন্যরাও তার মতের প্রতিধ্বনি করলেন। “এনএলডিই একমাত্র দল যারা দেশকে সত্যিকার অর্থে মুক্ত করতে পারবে,” বললেন মান্দালে বাজারের ৩০ বছর বয়সী নুডলস বিক্রেতা।
অনেক ভোটার আশা করছেন যে, ব্যবসায়িক পরিবেশে সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন করা হবে। “পরবর্তী সরকারকে অবশ্যই উন্নত দেশগুলো থেকে বিনিয়োগ নিয়ে আসতে হবে যাতে আমাদের নাগরিকদের কর্মসংস্থার ও ভালো বেতনের ব্যবস্থা হয়,” বললেন পেগু অঞ্চলের নাট্টালিন টাউনশিপের ৩৩ বছর বয়সী স্বর্ণ ব্যবসায়ী ইয়ান নাইং তুন।
“এনএনডি ঘুষের মাত্রা কমিয়ে এনেছে যেটা ব্যবসার জন্য ইতিবাচক,” বললেন মান্দালের ২৭ বছর বয়সী স্ট্রিট সেলার। ৩০ বছর বয়সী গায়ক সিন লিনের কাছে মিয়ানমারের মুদ্রার মান বাড়ানোটাই প্রধান ইস্যু।
কিন্তু যারা এনএলডিকে ভোট দিবে না, কিন্তু ইউএসডিপি বা ড. থেত থেত খাইনের নেতৃত্বাধীন ব্যবসায়-বান্ধব দল পিপলস প্রসপারিটি পার্টিকে (পিপিপি) ভোট দেবে, বা এখনও যারা সিদ্ধান্ত নেয়নি, তাদের কাছেও অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে অর্থনীতির ইস্যুগুলো।
মান্দালের একজন নারী নির্বাহী কর্মকর্তা পরিচয় না প্রকাশের শর্তে বলেন, পরবর্তী সরকারকে অবশ্যই যে প্রধান ইস্যুটিকে গুরুত্ব দিতে হবে, সেটা হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা খাতে উন্নয়ন।
এসব ভোটারকে যদি দেশের কয়েক মিলিয়ন ভোটারের প্রতিনিধি হিসেবে দেখা হয়, তাহলে এনএলডি বড় ধরনের বিজয় পেতে চলেছে, যদিও জাতিগত দলগুলোও বেশ কিছু আসনে জিততে পারে। তাই, পরবর্তী সরকারকে তাদের কাজের গতিপ্রকৃতি ঠিক করে নিতে হবে। আর সামরিক বাহিনী সেখানেও দীর্ঘ ছায়া বিস্তার অব্যাহত রাখবে, এবং সরকারের স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতাকে সীমিত করে দেবে।
“এই নির্বাচনে ভোট গণনার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটা হবে, সেটা হলো বেসামরিক সরকার-সামরিক বাহিনী- জাতিগত গোষ্ঠিগুলোর সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়,” সতর্ক করলেন মি. হ্যাস।
তিনি আরও বললেন, “এই নির্বাচনের ভূরাজনৈতিক তাৎপর্যটাকেও খাটো করে দেখা যাবে না। বিশেষ করে যে সময়টাতে মিয়ানমার ও সার্বিকভাবে আসিয়ানকে দুটো বিকল্পের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে – একটি হলো চীনের বেল্ট অ্যাণ্ড রোড ইনিশিয়েটিভ আর দ্বিতীয়টি হলো যুক্তরাষ্ট্রের অবাধ ও মুক্ত ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চল”।