মিয়ানমারের চিন রাজ্যে গুমের ছড়াছড়ি

মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের পালেটওয়া টাউনশিপে পাঁচ বছর ধরে তাতমাদাও আর আরাকান আর্মির লড়াই চলছে। দুই পক্ষই এখানে অপহরণ আর গুম চালিয়ে যাচ্ছে।
২০১৫ সালের ২৮ মার্চ বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পালেতওয়া টাউনশিপের পাইন সো গ্রামে প্রথম আরাকান আর্মি আর তাতমাদাও হিসেবে পরিচিত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সঙ্ঘর্ষ শুরু হয়। সঙ্ঘর্ষে বহু বাড়িঘর ধ্বংস হয় এবং গ্রামবাসীরা পালিয়ে যায়। সে দিন ৩০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি তার স্ত্রী ও দুই মেয়েকে রেখে নিখোঁজ হয়। ছয় মাস ধরে তার কোন খবর ছিল না।
পালেতওয়া এখনও যুদ্ধাঞ্চলই রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের তোয়াক্কা না করে তাতমাদাও আর আরাকান আর্মি উভয়েই যুদ্ধে বেসামরিক মানুষদেরকে জড়াচ্ছে।
চিন হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশান (সিএইচআরও) এ অঞ্চলে হত্যা, বলপ্রয়োগে শ্রমিক নিয়োগ, ইচ্ছেমতো ভূমি মাইন স্থাপন, গুম ও অপহরণের ঘটনার কথা জানিয়েছে।
২০১৯ সালে আরাকান আর্মি অপহরণ আর গুমের কৌশল গ্রহণ করে, যেটা সবাইকে আতঙ্কে ঠেলে দেয়। বর্তমানে ২০ জন সেখানে নিখোঁজ রয়েছে।
পালেতওয়ার ইয়াত চাউং গ্রামের কাছে যে তিনজন ক্রসফায়ারের মাঝখানে পড়েছিল, তাদের অবস্থা এখনও অজানা রয়ে গেছে। ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই পালেতওয়া টাউনশিপের বাউং ওয়া কিয়াউ গ্রামের চার শ্রমিক নিখোঁজ হয়। এর আগে ১৪ জুন আরাকান আর্মির হাতে ধরা পড়ার পর একই গ্রামের আরেক ব্যক্তি নিখোঁজ হয়।
১৪ সেপ্টেম্বর উন চাউং ওয়া গ্রাম থেকে আরও তিনজন নিখোঁজ হয়। রাখাইন থেকে চাল আর রান্নার তেল কিনে ফিরছিল তারা।
সে এলাকাগুলো থেকে তারা নিখোঁজ হচ্ছে, সেটা আরাকান আর্মি আর তাতমাদাওয়ের লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। দুই গ্রুপই এই সব নিখোঁজের ঘটনায় নিজেদের দায় অস্বীকার করেছে।
২৭ অক্টোবর, এক স্কুল কর্মী – যে পালেতওয়া টাউনশিপের পুই ভুম গ্রামে একটা রেস্তোরাঁও চালাতো – তাকে আরাকান আর্মি তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়।
এই পরিবারগুলোর বাকি ১৫ সদস্য পরে নিরাপত্তার জন্য পালেতওয়া শহরে পালিয়ে যায়।
পুরো গ্রাম ধরে অপহরণ
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি আর জুলাইয়ের মাঝামাঝি একটি গ্রামের ৫৪ জন সদস্যের সবাইকে অপহরণ করে আরাকান আর্মি। ২ ফেব্রুয়ারি আরাকান আর্মি সেনারা পালেতওয়া টাউনশিপের কিন তা লিন গ্রামে ঢুকে সবাইকে তাদের অনুসরণ করতে বলে। তাদেরকে বলা হয় যে, তাতমাদাও ওই গ্রামে বোমা হামলার পরিকল্পনা করছে।
গ্রামবাসীরা আদেশ মানতে অস্বীকার করলে এএ সেনারা বেশ কয়েকজনকে পেটানো শুরু করে। ছয় মাস পরে নারী শিশুসহ ৫২ জন বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে এএ ক্যাম্পে ছিল। সেখানে গ্রামবাসীদের দিয়ে ক্যাম্প দেখাশোনার কাজ করানো হতো, তাদেরকে পর্যাপ্ত খাবার দেয়া হতো না। ৬০ বছর বয়সী এক মহিলা সেখানে মারাও যায়। ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই অবশেষে তাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়।
গ্রামবাসীরা পরে পালেতওয়ার মিজা গ্রামে চলে যায়, যেখানে ঘরবাড়িহারা মানুষদের আশ্রয় দেয়া হচ্ছে। গ্রামবাসীদের মধ্যে একজন চার্চ মিনিস্টার ছিলেন, যিনি জানান যে, গ্রামের কেউই স্বেচ্ছায় এএ’র সাথে যায়নি।
লড়াই যতই তীব্র হচ্ছে, উভয় পক্ষই বেসামরিক মানুষদের আরও বেশি করে এতে জড়াচ্ছে এবং বেপরোয়াভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে যাচ্ছে।
এই সঙ্ঘাতে জড়িত পক্ষগুলোকে মনে রাখতে হবে যে, সবাইকেই এখানে আন্তর্জাতিক আইনগুলো মেনে চলতে হবে, তা তারা রাষ্ট্রের পক্ষে বা বিপক্ষে যেখানেই লড়াই করুক না কেন।
আরাকান আর্মি যদি সন্ত্রাসী এবং নির্যাতনকারী হিসেবে পরিচিত হতে না চায়, তাহলে তাদেরকে গুম এবং অপহরণের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।