মিয়ানমারে এ বছর গণতান্ত্রিক নির্বাচন হবে, তবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিনির্মূল অভিযান বন্ধ হবে না

সিকি শতকের মধ্যে প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ৫ বছর পর মিয়ানমারের জনগণ আগামী নভেম্বরে আবারো নির্বাচনে যাচ্ছে।
অশান্তি ও সহিংসতার ইতিহাসের দেশ মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৮ সালে, ব্রিটিশদের কাছ থেকে। অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত এবং ১৯৬২ ও ১৯৮৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে মিয়ানমার স্বৈরতান্ত্রিক পথ গ্রহণ করে, এ থেকে আর কখনো বের হতে পারেনি।
বর্তমান সহিংসতা ও সঙ্ঘাত এখনো মিয়ানমারকে পোড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুসলিম রোহিঙ্গা জনগণের বিরুদ্ধে চলা জাতিগত নির্মূল অভিযান ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়।
প্রায় ৫০ বছর ধরে সামরিক শাসনে থাকার পর মিয়ানমার ২০১০ সালের নভেম্বরে গণতান্ত্রিক সরকারের দিকে যাত্রা শুরু করে। একই বছরে সামরিক জান্তাও গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী ও নোবেল পুরস্কারজয়ী আং সান সু চিকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেয়।
তার মুক্তির পরের বছরগুলোতে তিনি পাশ্চাত্যের নেতাদের কাছে সমাদৃত হন। তিনি গণতান্ত্রিক মিয়ানমারকে নেতৃত্ব দেবেন বলে ব্যাপকভাবে আশাবাদের সৃষ্টি হয়।
আরও পড়ুনঃ মিয়ানমারের দ্বিমুখী নীতি: গেরিলাদের গ্রহণ করো, রোহিঙ্গাদের বিচ্ছিন্ন করো
কিন্তু ২০১৫ সালে তার ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) জয়ের পর থেকে ওইসব আশা বিলীন হয়ে গেছে।
গণতন্ত্রকে গ্রহণ?
বস্তুত, মিয়ানমারের গণতন্ত্রে যাত্রার রূপরেখা তৈরী হয় ২০০৩ সালে। ওই সময় জেনারেল খিন নিয়ান্ত রোডম্যাপ টু ডিসিপ্লিন ফ্লারিশিং ডেমোক্র্যাসির কথা ঘোষণা করেন। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০০৮ সালের সংবিধানের আওতায় ১৯৯০ সালের পর প্রথম বহুদলীয় নির্বাচনের পথ তৈরী হয়।
বাস্তবে নির্বাচন ছিল দুর্নীতিপূর্ণ। এতে আং সান সু চির দলকে বাদ দেয়া হয় ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে জয়ী করার জন্য। দলটি মূলত ছিল সামরিক বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের নিয়ে।
২০১১ সালে এনএলডি আবার গণতান্ত্রিক মঞ্চে প্রবেশ করে, মিয়ানমারের রাজনৈতিক জীবনে আবার সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়।
২০১২ সালের উপনির্বাচনগুলোতে তারা দারুণ সাফল্য পায়, ৪৫টি আসনের মধ্যে তারা ৪৪টিতে জয়ী হয়। অবশ্য পার্লামেন্টে ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় থাকে।
মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক শাসনের দিকে যাত্রার বিষয়টি বিবেচনা করে পাশ্চাত্যের নেতারা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন, ২০১২ সালে প্রথম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামা মিয়ানমার সফর করেন।
ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতাকালে ওবামা গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা আবার তুলে ধরেন।
ওবামা মিয়ানমারের বিভিন্ন স্থানে জাতিগত সহিংসতার কথাও উল্লেখ করেন। এর মাধ্যমে তিনি পরোক্ষভাবে মুসলিম সংখ্যালঘু গ্রুপ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিষয়টির দিকেও আলোকপাত করেন।
তিনি রোহিঙ্গাদের আইনগত মর্যাদার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করেন।
জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক ভোট
মিয়ানমারে ২০১৫ সালে ২৫ বছরের মধ্যে প্রথম অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। এটি দেশটির রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে দেয়। এনএলডির কাছে সামরিক-সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি হেরে যায়।
এতে আশা জাগে যে মিয়ানমার সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে যাত্রা করবে। রোহিঙ্গারাও আশাবাদী হয় যে তাদের উপর কয়েক দশকের নির্যাতনের সমাপ্তি ঘটবে।
আরও পড়ুনঃ ‘মিয়ানমারে ২০১৭ সালের সহিংসতায় ফেসবুকের ভূমিকা ছিলো’
আশাবাদের মধ্যেই ২০১৬ সালের আগস্টে সু চি অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট গঠন করেন। জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান এই কমিশনের নেতৃত্বে থাকেন। মিয়ানমারের নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে।
কিন্তু ২০১৭ সালের শুদ্ধি অভিযানে সব কিছু শেষ হয়ে যায়। জাতিসঙ্ঘ এই অভিযানকে জাতি নির্মূল অভিযানের বাস্তব উদাহরণ হিসেবে অভিহিত করে। তারপর থেকে জাতি ও ধর্মের ভিত্তিতে লোকজনকে বহিষ্কার করা চলছেই।
অধিকারহীন গণতন্ত্র
চলতি বছর মিয়ানমার আরেকটি নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হলো সামরিক বাহিনীর প্রভাব। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় তাদের হাতে: স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও সীমান্তবিষয়ক।
সংবিধানে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন থাকলেও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি কাউন্সিলের মাধ্যমে তার আধিপত্য ধরে রেখেছে।
এতে করে মনে হচ্ছে, আন সান সু চি জনসাধারণের নিরাপত্তা, বৈষম্যের অবসান, সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে পড়া নাগরিকদের সুরক্ষা দানের ব্যবস্থা করতে পারছেন না।
আর এর ফলে একসময় গণতন্ত্রের আইকন হিসেবে পরিচিত সু চির ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
নভেম্বরের নির্বাচন এগিয়ে আসতে থাকার প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের সরকার আরোপিত অধিকারহীন গণতন্ত্র সম্ভবত অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে, কিন্তু যত দিন পর্যন্ত রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চলতে থাকবে, এসব নির্বাচন মিয়ানমারকে গণতন্ত্রের পথে সাবলীলভাবে চালিত করবে বলে করাটা হালকা হয়ে যাবে।