আমরা লাইভে English মঙ্গলবার, জুন ০৬, ২০২৩

বৈশ্বিক নীরবতার নিন্দায় পাকিস্তানের রোহিঙ্গা মুসলিমরা

ISSUE-2-ENG-24-08-2020-Rohingya

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নিধন অভিযানের তৃতীয় বছর পূর্তির জন্য বিশ্ব যখন প্রস্তুত হচ্ছে, পাকিস্তানে বসবাসরত বহু রোহিঙ্গা তখন তাদের হারানো স্বজনদের খোঁজ করছে।

৫৬ বছর বয়সী ইব্রাহিম হোসেন এখন পাকিস্তানের করাচিতে বাস করছেন। শিশুসহ পরিবারের প্রায় এক ডজন সদস্যের মৃত্যুর শোক এখনও টেনে বেড়াচ্ছেন তিনি। 

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নিধন অভিযানে তারা নিহত হয়েছিল, যে অভিযানকে গণহত্যার আদর্শ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ। ওই অভিযানের ফলে ৮৬০,০০০ মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। 

ওই ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ তরুণ ভাতিজি আর চাচাতো ভাইয়ের খোঁজ এখনও পাননি তিনি। 

করাচির পূর্বপ্রান্তের বার্মা কলোনিতে ছোট একটি মুদির দোকান চালাচ্ছেন হোসেন। আনাদোলু এজেন্সিকে তিনি বলেন, “তাদের খোঁজার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমরা করেছি। রেডক্রসসহ বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠনের সাথে গত তিন বছরে আমরা যোগাযোগ করেছি, কিন্তু কোন হদিস পাওয়া যায়নি”।

তাদের ব্যাপারে ভিন্ন রকম তথ্য পেয়ে দুর্ভোগ আরও বেড়ে গেছে। 

তিনি বলেন, “একসাথেই পালাচ্ছিলেন তারা, কিন্তু চাপাচাপির মধ্যে তারা আলাদা হয়ে যায়। বেশ কযেকজন মারাও গেছে, কেউ কেউ বাংলাদেশে চলে গেছে। কিন্তু ওদের দুজনের খবর নেই”।

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

বাংলাদেশের কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইন্টারনেট ও ফোন সংযোগ না থাকায় হোসেনের অনুসন্ধান ব্যাহত হচ্ছে। ১.২ মিলিয়ন রোহিঙ্গা এই ক্যাম্পে বাস করছে। 

চোখের পানি কোন রকমে সামলে তিনি বললেন, “তাদের খোঁজে আমরা সম্ভাব্য সব জায়গায় চেষ্টা করেছি। আল্লাহই জানেন তারা বেঁচে আছে না মরে গেছে”।

করাচিতে জন্ম নেয়া আরেক রোহিঙ্গা মোহাম্মদ তাহারও রয়েছে একই রকম কাহিনী। 

নিধন অভিযানের পর থেকে তার দুই মামাতো ভাইসহ পরিবারের পাঁচ সদস্য নিখোঁজ রয়েছে। 

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে আমাদের যে আত্মীয়রা আছেন, তারাও ওদের খোঁজার চেষ্টা করছেন, কিন্তু কোন খোঁজ মেলেনি এখনও”।

তিনি বলেন টেলিফোনে বিধিনিষেধের কারণে বাংলাদেশে থাকা আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করা খুবই কঠিন হয়ে গেছে। 

তাহা আরও বলেন, “তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে খুবই সামান্য। তারাও আমাদেরকে কল করার সুযোগ পান খুবই কম”।

করাচি শহরে চার লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিম রয়েছে। মিয়ানমার আর বাংলাদেশের পর এটাই রোহিঙ্গাদের বৃহৎ বসতি।

চল্লিশের দশকের আগেই পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকেই তারা ওখানে যাওয়া শুরু করে। 

প্রথম সেনা অভিযানের আগে ১৯৪২ সালে প্রথম দেশান্তরিত হয় তারা। ওই অভিযানে এক লাখের বেশি মুসলিম রোহিঙ্গা নিহত হয়েছিল। 

তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটা বড় অংশ ১৯৭০-৮০ সালের দিকে পাকিস্তানকে তাদের ঘর বানায়। বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্য দিয়ে কঠিন সফর করে তারা পাকিস্তানে যায়। 

এর পর থেকে আর সেখানে যেতে পারেনি রোহিঙ্গারা, কারণ ভারত তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয় এবং তাদের সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানে যাওয়া বন্থ হয়ে যায়। 

বৈশ্বিক নীরবতা বেদনাদায়ক

তবে রোহিঙ্গারা সবচেয়ে কষ্ট পাচ্ছে আন্তর্জারিক নীরবতা নিয়ে। যদিও জাতিসংঘ তাদেরকে সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠি হিসেবে উল্লেখ করেছে। 

রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা নুর হোসেন আরাকানি বলেন, “তিন বছর চলে গেছে। মিয়ানমার সরকারের বিচার এবং রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার কিছুই হয়নি। উল্টা মিয়ানমার সরকার আরও দাপটের সাথে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে”।

২০১৯ সালের নভেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধের তদন্ত শুরু করে। মিয়ারমার এই প্রক্রিয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ তারা রোম ঘোষণার অংশ নয়। 

রোম ঘোষণার মাধ্যমেই আইসিসি গঠিত হয় যেটার উদ্দেশ্য হলো গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ, এবং আগ্রাসনকে প্রতিহত করা। 

তিনি বলেন, “তুরস্ক, গাম্বিয়াসহ হাতে গোনা কিছু মুসলিম দেশ শুধু আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে আমাদের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এমনিতে মিয়ানমারের চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে তথাকথিত পরাশক্তিগুলো নিশ্চুপ হয়ে আছে”।

তিনি আরও বলেন যে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের মতো আর কোন নেতা নেই, যিনি রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। 

তিনি বলেন, “পুরো রোহিঙ্গা কমিউনিটি তার জন্য দোয়া করে”।

মিয়ানমারের ষাঁড়াশি অভিযান

আন্তর্জাতিক অধিকার গ্রুপগুলোর মতে, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নিধন অভিযানের পর এক মিলিয়নের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। 

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সরকারী বাহিনী প্রায় ২৪,০০০ রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা করেছে। অন্টারিও ইন্টারন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট এজেন্সির (ওআইডিএ) এক রিপোর্টে এ তথ্য জানানো হয়েছে। 

ওআইডিএ রিপোর্টে বলা হয়েছে, আরও ৩৪ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছে, ১১৪,০০০ এর বেশিকে পেটানো হয়েছে। ‘ফোর্সড মাইগ্রেশান অব রোহিঙ্গা: দ্য আনটোল্ড এক্সপেরিয়েন্স’ শীর্ষক রিপোর্টে এ সব জানানো হয়েছে। 

১৮ হাজারের মতো রোহিঙ্গা নারী ও মেয়েদের ধর্ষণ করেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আর পুলিশ। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ১১৫,০০০ রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি, ভাংচুর করা হয়েছে ১১৩,০০০। 

জাতিসংঘ একইসাথে শিশুসহ নারীদের গণধর্ষণ ও হত্যার তথ্যও জানিয়েছে। মিয়ানমারের সরকারী বাহিনী বর্বরভাবে পিটিয়ে বহু মানুষকে গুমও করেছে। 

মিয়ানমার সরকার যদিও তাদের কোন নাগরিক অধিকার বা নিরাপত্তা দেয়নি, এর পরও বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে জোর করে প্রত্যাবাসনের হুমকি দিচ্ছে।