আমরা লাইভে English শনিবার, জুন ০৩, ২০২৩

নেপাল-ভারত সীমান্ত বিরোধ: সুগাউলি চুক্তি অস্বীকার করা হলে বাংলাদেশের কিছু অংশও বিতর্কিত হয়ে পড়তে পারে

ভারত সম্প্রতি দেশের ভেতরে ও বাইরে প্রবল বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিতর্কিত জম্মু-কাশ্মীর অঞ্চলকে দুটি কেন্দ্রশাসিত ভূখণ্ডে পরিণত করে নিজের সঙ্গে একীভূত করেছে। গত ৫ আগস্ট অধিকৃত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর নভেম্বরে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় দেশের নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র প্রকাশ করে। এই মানচিত্র শুধু পাকিস্তান নয়, চীন ও নেপালের সঙ্গেও উত্তেজনা তৈরি করেছে।

ভারতের নতুন মানচিত্র নিয়ে নেপালে প্রবল বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কালাপানি নামক ৩৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের একটি অঞ্চলের উপর ভারত ও নেপাল দুই দেশই মালিকানা দাবি করছে। ভারতের ঝারখান্ড রাজ্য লাগোয়া কালাপানি অঞ্চলটি নেপালের সরকারি মানচিত্রে নেপালের ভূখণ্ড হিসেবে দেখানো হয়েছে। উত্তরখণ্ডের সঙ্গে নেপালের ৮০.৫ কিলোমিটার এবং চীনের সঙ্গে ৩৪৪ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।

ভারতের আগ্রাসী মানচিত্রের প্রতিবাদে কাঠমান্ডুতে আরো অনেক দলসহ নেপাল কংগ্রেসের ছাত্র শাখা বিক্ষোভ করেছে। তাদের হাতের প্লাকার্ডে লেখা ছিলো: ভারত ফিরে যাও। ভারতের এই মানচিত্র নেপালে ২০১৫ সালের অবরোধের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। টুইটারে প্রতিবাদ হিসেবে হ্যাশট্যাগ#ব্যাকঅফইন্ডিয়া ও #কালাপানি আন্দোলন চলছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে এই ইস্যু নেপালের অভ্যন্তরিণ রাজনীতিকে উত্তপ্ত করে রেখেছে। তবে শুরু থেকেই ইস্যুটি গুরুত্বহীন করারও চেষ্টা করছে ভারত।

নেপালের ভূখণ্ড ভারত দখল করেছে – এ ব্যাপারে নেপালে সর্বদলীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রাভিশ কুমার দাবি করেন যে তাদের মানচিত্রে সঠিকভাবেই ভারতের সার্বভৌম এলাকা দেখানো হয়েছে এবং নেপালের সঙ্গে সীমান্ত পরিবর্তন করা হয়নি। কিন্তু নেপাল সার্ভে বিভাগের সাবেক ডিজি বুধি নারায়ন সেরেস্থা নিশ্চিত করে বলেছেন যে, কৌশলগত এলাকাটি একসময় ভারত ও দক্ষিণপশ্চিম চীনের মধ্যে বাণিজ্য রুট হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে ভারতীয় সেনারা পিছু হটার সময় সেখানে অবস্থান নেয় এবং তখন থেকে তারা জায়গাটি দখল করে আছে।

নেপালের তিন দিকে ভারতের সীমান্ত। সীমান্তের বিভিন্ন অংশে ভারতীয়দের দ্বারা ভূমি দখলের বিষয় নিয়ে নেপালের মিডিয়াগুলো অনেক রিপোর্ট করেছে। নেপালের ২৭টি জেলার সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে ২৩টি জেলার ৭২টি স্থানে ভারতীয়রা নেপালি ভূখণ্ড দখল করেছে বলে নেপাল দাবি করে। ভারতীয়দের ভূখণ্ড দখল ও নেপাল সরকারের উদাসীনতা সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী লোকজনের উপর প্রভাব ফেলছে। অনেক জায়গায় ভারতীয়রা নেপালিদের চাষাবাদের জমি দখল করে নেয় বা সড়কে সেতু নির্মাণে বাধা দিয়েছে বলে খরব প্রকাশিত হয়েছে।

চীন ও ভারতের মধ্যে অবস্থিত হিমালয়ান রাজ্য নেপাল ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের সময়ও ‘বাফার স্টেট’ হিসেবে কাজ করেছে। দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে নেপালের সীমান্ত ইস্যুগুলো অনেক দিন ধরেই সমস্যা তৈরি করে রেখেছে।

কিন্তু চীনের পরলোকগত নেতা মাও সেতুং নেপালের মানচিত্রের প্রতি সম্মান দেখিয়ে হিমালয় পর্বতের প্রায় অর্ধেক নেপালকে ছেড়ে দিতে রাজি হওয়ায় চীনের সঙ্গে নেপালের সীমান্ত বিরোধ প্রায় মিটে গেছে। পরে ১৯৮৩ সালে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই সীমান্ত চিহ্নিত করা হয়। চীনের সরঞ্জাম ও নেপালের জনবল দিয়ে এই সীমান্ত চিহ্নিত করার কাজ চলে। কিন্তু উত্তরপশ্চিম ও উত্তরপূর্ব এলাকায় তিন দেশের সংযোগস্থালে এই চিহ্নিতকরণের কাজ আটকে থাকে।

সূত্র জানায়, নেপাল ভারতকে বলেছে যে কালাপানি সীমান্ত নিয়ে সংলাপে চীনকেও রাখতে হবে কারণ তাদের সঙ্গেও সেখানে কিছু অমিমাংসিত এলাকা রয়েছে। সেখানে নেপাল ও তিব্বতের সীমান্ত মিলেছে।

কালাপানিকে ভারত নিজ মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত করায় মনে হচ্ছে ১৮১৬ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নেপালের মধ্যে স্বাক্ষরিত সুগাউলি চুক্তিকে ভারত আমলে নিচ্ছে না। এই চুক্তি মূলত নেপালে সঙ্গে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার পুরো উত্তর সীমান্তই চিহ্নিত করেছে। ওই চুক্তিতে বলা হয়েছে ভারতের সঙ্গে নেপালের পশ্চিম সীমান্ত চিহ্নিত হবে কালি নদী দ্বারা। তবে ব্রিটিশ জরিপকারীরা বিভিন্ন সময় কালি নদীর উৎস বিভিন্ন স্থানে চিহ্নিত করেছে। এই অমিলের কারণে ভারতের সঙ্গে নেপালের সীমান্ত বিরোধ তৈরি হয়। ফলে দুই দেশই কালাপানি ভূখণ্ড নিজেদের দাবি করে মানচিত্র তৈরি করে। আবার কালাপানির সঠিক আয়তন নিয়েও মতভেদ রয়েছে।

নেপালের বিশেষজ্ঞরা বলছেন ১৯৫২ সালের ভারত-নেপাল মৈত্রী চু্ক্তির ধারা ৮ অনুযায়ী কালাপানি দাবি করার অধিকার রয়েছে নেপালের। সুগাউলি চুক্তি উপেক্ষা করে ভুটানের পুরো অংশ এবং বাংলাদেশের কিছু অংশও বিতর্তিক হয়ে পড়বে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তারা। ১৮১৬ সালের চুক্তি উপেক্ষা করা হলে ভারতের বর্তমান উত্তর প্রদেশের প্রায় অর্ধেক স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেপালের আইনি এখতিয়ারের মধ্যে চলে যাবে। বিহার রাজ্যের কিছু অংশও স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেপালের অধিকারে আসবে। ঐতিহাসিকদের দাবি পশ্চিমে সুতলেজ ও পূর্বে তিস্তা নদী পর্যন্ত ভূখণ্ড অধিকার করেছিলো নেপাল।

প্রতিটি দেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত বিরোধ রয়েছে। বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশ কিছু না বললেও চীন ও পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সমানতালে লড়াই করে যাচ্ছে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও দরিদ্র দেশ নেপালকে প্রায়ই ভারতের গায়ের জোরের মুখোমুখি হতে হয়। নেপালের ভৌগলিক অখণ্ডতা আমলে না নিয়ে ভারত অনেক কিছু করছে। তাই নেপালের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত কাঠমান্ডুর পক্ষে দিল্লির উপর চাপ সৃষ্টি করা। তাছাড়া কাশ্মীরের মতো বিরোধগুলো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের উত্তরাধিকার। ফলে এগুলো নিরসনের দায়িত্ব ব্রিটিশ রাজের উপরও বর্তায়।