আমরা লাইভে English বুধবার, মার্চ ২২, ২০২৩

শের বাহাদুরের নেপাল যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকছে?

Capture fgnfghjn

অনেকদিন ধরেই নেপালের রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা চলছিল। নানা নাটকীয়তা আর জল্পনাকল্পনার পর গত বছরের জুলাই মাসে আদালতের আদেশে শের বাহাদুর দেউবাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারি। এর মধ্যদিয়ে নেপালি কংগ্রেস দলের প্রেসিডেন্ট দেউবা পঞ্চমবারের মতো দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৯৫ সালে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করা দেউবা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের দ্বিতীয় মেয়াদে (২৬শে জুলাই ২০০১-৪ঠা অক্টোবর ২০০২) যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন সফর করেছিলেন। এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ দুই দশক। এই সময়ে হিমালয়ে বহু বরফ গলেছে। ভূ-রাজনীতিতে ঘটে গেছে নানা পরিবর্তন। কিন্তু, বিস্ময়কর হলেও সত্য, এই ২০ বছরে নেপালের কোনো প্রধানমন্ত্রী ওয়াশিংটন সফর করেননি! পঞ্চমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেউবা ফের ওয়াশিংটন সফরে যাচ্ছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে আসছে জুলাইয়ের যেকোনো সময় এ সফর অনুষ্ঠিত হবে।   নেপালের ইংরেজি দৈনিক ‘কাঠমান্ডু পোস্ট’ খবরটি নিশ্চিত করে বলেছে, নেপালের রাজনীতিবিদদের মধ্যে দেউবাকে সবসময়ই যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সামপ্রতিক সময়ের অন্য প্রধানমন্ত্রীদের বেশির ভাগই কমিউনিস্ট দলগুলো থেকে নির্বাচিত, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চীনের প্রতি নিজেদের ঝোঁক দেখিয়েছেন।

সে তুলনায় দেউবার গণতান্ত্রিক পরিচয়ের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তার সঙ্গে কাজ করতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। পরিসংখ্যানও বলছে, সামপ্রতিক সময়ে দেশটির কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের নেপাল সফরের হার বৃদ্ধি পেয়েছে।  ক’দিন আগেই (২০শে মে) যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি এবং তিব্বত বিষয়ক বিশেষ সমন্বয়কারী উজরা জিয়া কাঠমাণ্ডু সফরে আসেন। নেপাল সফরের সময় তিব্বতীয় শরণার্থীদের সঙ্গে তার বৈঠক নিয়ে আপত্তিও জানিয়েছিল চীন। এর মাসখানেক আগে নিউ ইয়র্কের সিনেটর কার্স্টেন গিলিব্র্যান্ডের নেতৃত্বে মার্কিন কংগ্রেসের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল (২২শে এপ্রিল) তিন দিনের সফরে নেপাল পৌঁছে। ওই সফরে তারা প্রধানমন্ত্রী দেউবা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির সঙ্গেও বৈঠক করেন। উল্লেখ্য, প্রতিনিধিদলের সব সদস্যই ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্রেটিক পার্টির। পর্যবেক্ষকরা তাই বলছিলেন, রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোরদার করাই ওই সফরের উদ্দেশ্য।

মার্কিন দূতাবাসও জানিয়েছিল, কোনোরূপ প্ররোচনা ছাড়াই রাশিয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে ইউক্রেন ও ন্যাটো মিত্রদের সহযোগিতা করতে পারে তা জানতেই এই সফর।  যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ওই প্রতিনিধিদের নেপাল সফর অবশ্য সামপ্রতিক সময় বিবেচনায় চমকপ্রদ বা নতুন কিছু নয়। শের বাহাদুর দেউবা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই মার্কিন কর্মকর্তাদের ঘন ঘন নেপাল সফর লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। গত বছরের জুলাইতে তিনি দায়িত্ব নেয়ার দু’মাস পর সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিসি)-এর কমপ্যাক্ট অপারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফাতেমা জেড সুমারের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল কাঠমাণ্ডু আসে। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, যেসব দেশ গণতান্ত্রিক অধিকারের নির্দিষ্ট মান মেনে চলে এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা নেয় তাদের উন্নয়নে এমসিসি সহায়তা করে।  যাই হোক, সুমারের সফরের দু’মাস পর নভেম্বরের শেষের দিকে ‘রেটিফাই এমসিসি’ বার্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু নেপাল সফর করেন।

তিনি অবশ্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেউবার পাশাপাশি দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি এবং পুষ্প কমল দহলের সঙ্গেও ফোনে কথা বলেন।  প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে তৎকালীন নেপাল সরকারের আগ্রহের প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে এমসিসি নেপালের অবকাঠামো উন্নয়নে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অনুদান দিতে দেশটির সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল। এমসিসি’র সঙ্গে চুক্তি করা দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় নেপালই ছিল প্রথম। দীর্ঘদিন ধরেই চুক্তিটি স্বীকৃতির অভাবে ঝুলেছিল। চুক্তিটির পক্ষের লোকজন বলছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ওই অনুদান সহায়তা পরিশোধ করতে হবে না এবং এর সঙ্গে কোনো ধরনের শর্তও যুক্ত নেই। কিন্তু, চুক্তিটির বিরোধিতাকারীরা বলছিলেন, এটা নেপালের আইন এবং সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র তার ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস)-এর অংশ হিসেবে এই চুক্তি করেছে এবং এ কারণে নেপালে দেশটির সেনা পাঠানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। নেপালি রাজনীতিকরাও চুক্তিটি অনুমোদন নিয়ে দরকষাকষি শুরু করেন। 

কাঠমাণ্ডু পোস্টের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়: নভেম্বরে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু তার নেপাল সফরের সময় দেশটির প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে এই বার্তা দিয়েছিলেন যে, নেপাল এমসিসি চুক্তি অনুমোদনে ব্যর্থ হলে, দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি নতুন করে ভেবে দেখতে পারে ওয়াশিংটন। এমসিসি অনুমোদনের শেষ তারিখ ছিল ২৮শে ফেব্রুয়ারি। নানা জল্পনার পর একেবারে শেষ সময়ে এসে ২৭শে ফেব্রুয়ারি এমসিসি চুক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় নেপালের সংসদ। পর্যবেক্ষকদের মতে, এতে শের বাহাদুর দেউবার সরকার নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয় ওয়াশিংটন। এমসিসি অনুমোদনের মাত্র কয়েকদিন পরই (২রা মার্চ) প্রধানমন্ত্রী দেউবার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেন। এ ছাড়া, জাতিসংঘে ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দেয় নেপাল। এতে ওয়াশিংটনের মধ্যে এমন অনুভূতি সৃষ্টি হয় যে, কাঠমাণ্ডু তাদের স্বার্থের পক্ষে রয়েছে। তাছাড়া, নেপাল আগের চেয়ে আরও পরিষ্কার করেছে যে, তারা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) মোটেও আগ্রহী নয়।  নেপাল এবং যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৭৫তম বার্ষিকী উদ্যাপনে (পহেলা মে) একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে কাঠমাণ্ডুতে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী দেউবা।

ওইদিন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেন এক টুইটে লিখেন: শাসন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন দেখছে নেপাল। আমরা তাদের অংশীদার হতে পেরে গর্বিত এবং সামনের দশকগুলোতে এই বন্ধুত্বকে আরও এগিয়ে নিতে চাই।

অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী দেউবা তার টুইটে লিখেন: সামনের দিনগুলোতে (দুই দেশের মধ্যে) আরও উচ্চপর্যায়ের সম্পৃক্ততা এবং অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের জন্য আমরা উন্মুখ।  ওদিকে, কাঠমাণ্ডু এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার পাশাপাশি সামরিক সম্পৃক্ততাও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার ওয়াশিংটন সফরের ঠিক আগে যুক্তরাষ্ট্রে সফরে যাচ্ছেন নেপালের সেনাপ্রধান জেনারেল প্রভু রাম শর্মা। জেনারেল শর্মা ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে আমন্ত্রণপত্র পেয়েছেন এবং তার সফরের প্রস্তাবিত তারিখ ২৭শে জুন থেকে ১লা জুলাই বলে সেনাসূত্রে জানিয়েছে নেপালের গণমাধ্যম।

গত ২৫শে মে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত নেপালের রাষ্ট্রদূত শ্রীধর খাত্রি পেন্টাগনে গিয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপ-সহকারী সচিব লিন্ডসে ফোর্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে তারা দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতার পাশাপাশি দুই সেনাবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা এবং সম্পৃক্ততা নিয়েও আলোচনা করেন।  নেপালে বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে কৌশলগত প্রতিযোগিতা দীর্ঘদিন ধরে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন ভাস্কর কৈরালা। দেশটির বিশিষ্ট এই ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক মানবজমিনকে বলেন, ‘ঐতিহাসিক দিক থেকে দেখলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নেপালের সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই ভালো। এটা নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে উদার গণতান্ত্রিক পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে নেপালের সুসম্পর্কের সূচনা, যেটা আজও রয়ে গেছে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে এবং ছোট দেশ হওয়ায় সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে নেপাল গণচীন প্রতিষ্ঠার পর তার সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলে। সামপ্রতিক সময় বিবেচনায় নিলে বলতে হয়, গত বছর যদিও অনেকে বলছিলেন নেপাল চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যেন একটা ইউ-টার্নের দিকে যাচ্ছে।’

তবে, আসছে দিনগুলোতে পরিস্থিতি হয়তো নেপালের হাতেও থাকবে না বলে মনে করেন ভাস্কর। ‘তিব্বত, তাইওয়ান, দক্ষিণ চীন সাগর, ইন্দো-প্যাসিফিক এসব ইস্যুগুলো এবং চীন এসব নিয়ে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায় তার উপর অনেককিছুই নির্ভর করবে।’ প্রধানমন্ত্রী দেউবার আসন্ন যুক্তরাষ্ট্র সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দিক থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে ভাস্কর বলেন, ‘সামপ্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন স্তরে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান মজবুত সম্পর্কের প্রতিই ইঙ্গিত দিচ্ছে।’  করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন সহ নানা বিধিনিষেধ আরোপের কারণে আন্তর্জাতিক পর্যটন বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পর্যটন শিল্প বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় উৎস হওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ শ্রীলঙ্কার মতো ভুগছে নেপালও। তাছাড়া, নেপাল আমদানিনির্ভর হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমতে শুরু করেছে।

 নেপালের অর্থনীতি এখনো যথেষ্ট ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে সরকার এবং অনেক বিশ্লেষকরা দাবি করলেও দেশটিতে সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় সাধারণ নাগরিকদের জন্য জীবনযাপন খুব ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।  তবে, ইতিবাচক দিক হলো, শ্রীলঙ্কার মতো বৈদেশিক ঋণের বোঝা নেপালের কাঁধে নেই। তাছাড়া, নেপালের সরকার পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। চলতি বছরের শেষের দিকে নেপালে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমতাবস্থায়, শের বাহাদুর দেউবার সরকার দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ঠিক করতে এবং ঠিক রাখতে কী ধরনের বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেন তার দিকে নিশ্চয়ই তাকিয়ে থাকবেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।