কাশ্মীরে ভারতের নৃশংস শাসনের সাক্ষী ৫০০ শহিদের কবর

কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের কেন্দ্রস্থলে একটি বিশাল ময়দান। এর একটি অংশের নাম ঈদগাহ। ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে নিহত লোকদের এখানে কবর দেয়া হয়। ১৯৯০-এর দশকে কাশ্মীর উপত্যকায় সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর থেকে এই ঐতিহ্য অনুসরণ করা হয়ে থাকে। এটি বেহেশত-ই-শুধা বা শহিদি বেহেশত নামেও পরিচিত। পরে স্থানটি সাধারণ মানুষের কাছে শহিদি গোরস্থান নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৫ শ’র বেশি তরুণ ও বয়স্ক লোককে এখানে কবর দেয়া হয়েছে। সর্বকনিষ্ঠ যাকে এখানে দাফন করা হয়েছে, তার বয়স মাত্র দুই বছর। সাকিব বাশির নামের শিশুটি মায়ের দুধ পান করার সময় একটি বুলেট তার বুকে বিদ্ধ হয়। আর সবচেয়ে বয়স্ক যার কবর এখানে রয়েছে, তার নাম গোলাম মোহাম্মদ মাগরে। তার বয়স ছিল ১০২ বছর। এখানে দুটি খালি কবরও আছে। একটি জেকেএলএফের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ মকবুল ভাটের। ১৯৮৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি দিল্লির তিহার জেলে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। আরেকটি হলো আফজাল গুরুর। ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি একই কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয় পার্লামেন্ট ভবনে হামলার অভিযোগে।
কবরস্থান থেকে কয়েক গজ দূরে মোহাম্ম শফি খানের বাড়ি। তিনি বলেন, ‘শহিদের’ সংখ্যা বাড়তে থাকায় অনেকবারই কবরস্থানটির জায়গা বাড়ানো হয়েছে। অবশ্য সময়ের পরিক্রমায় এখানে লাশ নিয়ে আসা কঠিন হওয়ায় সারা কাশ্মীরেই এখন শহিদি কবরস্থান তৈরী হচ্ছে। এখন কাশ্মীরী উপত্যকাজুড়ে পাঁচ শতাধিক শহিদি কবরস্থান আছে।
১. নূর মোহাম্মদ তানতারির কবর: জৈশ-ই-মোহাম্মদের কমান্ডারকে পাকিস্তানি পতাকায় আচ্ছাদিত করা হয়। দক্ষিণ কাশ্মীরে জঙ্গিবাদের হটবেড পুলওয়ামায় অনেক শহিদ কবরস্থানের একটিতে তাকে সমাহিত করা হয়। তিনি তার দলকে চাঙ্গা করায় তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে পড়েছিলেন। ২০১৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে তিনি নিহত হন।
২. বিশ্বখ্যাত ডাল লেকের পাড়ে একটি শহিদি গোরস্থান। এখানে সমাহিত বেশির ভাগই পাকিস্তান থেকে আগত জঙ্গি। তাদের কবরের ফলকে উর্দু ভাষায় তাদের পরিচিতি লেখা হয়েছে মেহমান মুজাহিদ বা অতিথি মুজাহিদ।
৩. ভারতপন্থী আঞ্চলিক নেতা মেহবুবা মুফতি ২০১৭ সালের ১৩ জুলাই শ্রীনগরের পুরনো এলাকায় একটি শহিদি গোরস্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। ১৯৩১ সালের ১৩ জুলাই কাশ্মীরের হিন্দু রাজার সেনাবাহিনীর হাতে নিহত ২২ কাশ্মীরীকে এখানে দাফন করা হয়।
স্বাধীনতাপন্থী ও ভারতপন্থী উভয় ধরনের কাশ্মীরী নেতারা ১৩ জুলাইকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। উভয় গ্রুপই স্বৈরাচারী ডোগরা রাজত্বের অবসানের লক্ষ্যে এই বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। অবশ্য বিজেপি ১৩ জুলাই শহিদ দিবস ছুটির বিরোধিতা করে থাকে। এই দলের অনেকে ওই ২২ শহিদকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করেন। গত বছর কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করার পর ১৩ জুলাইকে শহিদ দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতা প্রত্যাহার করা হয়। চলতি বছর সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হয়নি।
৪. মোহাম্মদ আশরাফ মাত্তু শ্রীনগরের শহিদি গোরস্থানে তার ছেলে তোফায়েল আহমদ মাত্তুর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ২০১০ সালে পুলিশের টিয়ার গ্যাসের শেল মাথায় বিদ্ধ হলে ১৭ বছর বয়স্ক তোফায়েল নিহত হন। ভারতবিরোধী বিক্ষোভের সময় এ ঘটনা ঘটে।
৫. দক্ষিণ কাশ্মীরের ত্রাল এলাকায় মুজাহিদ নেতা বুরহান ওয়ানির কবর। ২০১৬ সালের ৮ জুলাই তিনি নিহত হন। তার মৃত্যুর জের ধরে বিক্ষোভকারী ও সরকারি বাহিনীর মধ্যকার সংঘর্ষে ৯০ জনের বেশি নিহত ও ১১ শ’ জন আহত হয়। ৫ মাস ধরে কারফিউ বলবত ছিল।
৬. বুরহান ওয়ানির কবরের পাশে থাকা সমাধিফলক পাঠ করছে দুই শিশু। এতে উর্দুতে পাকিস্তানি কবি মোহাম্মদ ইকবালের পংক্তি উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে:
নাজার আল্লাহ পি রাখতা হ্যায় মুসলমান-ই-ঘায়ুর;
মওত কিয়া শায় হ্যাই, ফাকত আলম-ই-মানি কা সফর
উন শাহিদুন কি দিয়াত আহলে-ই-কালিসা সি না মাঙ;
কদর-ও-কিমাত ম্যাঁ হাই খুন জিন কা হারাম সে বাথ কর।
এর মানে হলো:
মুসলিমদের পক্ষে সত্য, মৃত্যুর কোনও ভয় নেই,
আত্মার রাজ্যে, তিনি সরাসরি নেতৃত্বে
তাদের রক্ত মূল্যবান এবং স্বর্গীয়
পবিত্র প্রার্থনাগৃহের সীমানার মতো।
৭. শ্রীনগরের পুরনো এলাকার শহিদি গোরস্থানে ১৯৩১ সালের ১৩ জুলাই নিহতদের কবরস্থানে শিশুরা খেলছে। ১৯৩১ সালের ওই দিনে হিন্দু মহারাজা হরি সিংয়ের নৈরাজ্যকর শাসনের বিরুদ্ধে কাশ্মীরের নির্যাতিত লোকজন ফুঁসে ওঠেছিল। অতিরিক্ত কর, সরকারি চাকরিতে বৈষম্যসহ বিভিন্ন কারণে তারা ক্ষুব্ধ হয়েছিল। শ্রীনগরের সেন্ট্রাল জেলের ঠিক বাইরে ২২ বিক্ষোভকারী নিহত হয়। তাদের বুকে গুলি লেগেছিল।
৮. বারামুল্লার গান্তামুল্লার এক কবরস্থান। এখানে পুলিশ, সেনাবাহিনী অজ্ঞাত পরিচয় জঙ্গিদের কবর দিয়েছে। তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।
৯. কবরের দুই পাশে দুটি পাথরখণ্ড ছাড়া কবরে আর কিছুই নেই। কবরগুলোতে কারো পরিচিতি লেখা নেই। ঝিলাম নদীর তীরের এই কবরস্থানে স্বল্প পরিচিত বিদেশী বিদ্রোহীদের কবর দেয়া হয়েছে।
১০. বুরহান ওয়ানির কবরে ঘাসে পানি দিচ্ছে এক লোক। কাশ্মীরী তরুণদের কাছে ওয়ানি এখনো জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। তিনি সামাজিক মাধ্যমযোগে তরুণদের আহ্বান করতেন। কাশ্মীরের সশস্ত্র বিদ্রোহে তিনি পোস্টার বয় হিসেবে পরিচিত।