আমরা লাইভে English বুধবার, জুন ০৭, ২০২৩

পুরান ঢাকার কাজী বাড়ি: ঐতিহ্যের সঙ্গে খাবার আর খাবারের ঐতিহ্যের সম্মিলন যেখানে

‘পুরান ঢাকার খাবারের ঐতিহ্য এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে খাবার’ এই ধারনায় এবার যুক্ত হয়েছে রোকনপুরের কাজী বাড়ি। স্থাপত্য নিদর্শন আর ইতিহাসের সম্মিলনে ১৯৯ বছরের পুরনো ওই বাড়িটিতে শুরু হয়েছে ‘হেরিটেজ লাঞ্চ এন্ড ব্রেকফাস্ট’। ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিক, কয়েকটি কূটনৈতিক মিশনের কর্মকর্তাসহ তাদের পরিবারের সদস্যরা ইতোমধ্যে ভ্রমন করেছেন বাড়িটি। জেনেছেন মোঘল-ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান-বাংলাদেশ সময়ের রাজনীতি এবং ক্রীড়ায় বাক বদলের ইতিহাসের সঙ্গে কাজী বাড়ির সম্পৃক্ততার গল্প। গ্রহণ করেছেন ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ আর্ট, এন্টিক আর আসবাব পত্রের সঙ্গে খাবার।

যাকে পুরান ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ আন্দোলনের সাফল্যের মাইল ফলক হিসেবে দেখছে আরবান স্টাডি গ্রুপ (ইউএসজি)। যারা গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে এ আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। পাশাপাশি ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংশ্লিষ্ঠ দেশি-বিদেশী পেশাজীবীসহ নানা পেশার পর্যটকদের নিয়ে সপ্তাহে দুই দিন নিয়মিত আয়োজোন করছেন ‘হেরিটেজ ওয়াক’। যার সুবাধে নতুন করে অনেকের কাছে পরিচিত হয়ে উঠছে পুরান ঢাকা।

গত প্রায় ষাট বছেরের ইতিহাসে বাড়িটির সঙ্গে ক্রীড়া সংগঠক-লেখক, ক্রীড়ায় নারীর অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জনের ঘটনাবলী জড়িত থাকলেও আদি ইতিহাস জড়িত মোঘল শাসন, বিচার এবং ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম প্রতিরোধ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সঙ্গে।

আরও পড়ুন: পুরান ঢাকায় ‘লাঞ্চ এট হেরিটেজ হোম’

সিপাহী বিদ্রোহ দমন এবং দমন পরবর্তী ব্রিটিশদের নির্মম নির্য়াতনের বাস্তব সাক্ষী পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক। পার্কটি থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে প্রায় ২০০ মিটার দূরত্বে কাজী বাড়ি। হাটা পথে বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে প্রথমে কবি কাজী নজরুল সরকারি কলেজ, কলেজের পেছনের কাজী আবদুর রউফ সড়ক ধরে একটু এগুলে কাঁঠাল আর হাস্নাহেনা গাছে ঘেরা লোহার গেট। তা পার হলে বাম পাশে টার্কি স্থাপত্য রীতিতে এবং চিনি টুকরা অলংকরণে নির্মিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ। মসজিদটির সামনের উঠান বা খোলা জায়গাটি পার হলেই কারুকারর্য খচিত সাদা দোতলা বাড়ি। ভবনের বাইরের টানা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে পেয়ারা গাছ ঘেরা ছোট একটি কোর্টইয়ার্ড। যার সঙ্গে সংযোগ সেগুন কাঠের খড়খড়ি দরজা-জানালা আর ভেতরের পুরনো যুগের সব আর্ট, এন্টিক আর ফার্নিচারের।

ঐতিহ্যপ্রিয় দেশি-বিদেশিদের জন্য এখানেই শুরু হয়েছে ‘হেরিটেজ লাঞ্চ এন্ড ব্রেকফাস্ট সার্ভিস’। বাঙ্গালীর পারিবারিক আপ্যায়নের আবহ ও পুরান ঢাকার বাহারি খাবারের ঘরোয়া স্বাদ নিয়ে এ আয়োজনে গত কয়েক সপ্তাহে অংশ নিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফরাসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতসহ মিশনগুলোর কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা। লাঞ্চে জনপ্রতি খরচ ৬০০ টাকা, ব্রেকফাস্টে ২৫০টাকা।

পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণ সহায়ক এ উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করছেন কাজী এহসান উল আলীম এবং কাজী সাদ উল্লাহ হিল আলীম। যারা প্রতিনিধিত্ব করছেন স্থাপনাটির প্রতিষ্ঠাতা মির্জা এলাহী বকসের ৫ম প্রজন্মের। তারা জানান, বর্তমানের এই স্থাপনাটি ১৮২০ সালে তৈরি করেন কাজী মির্জা এলাহী বকস। যাঁর তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলে জড়িত ছিলেন সিপাহী বিদ্রোহে। যাদের একজনকে শাস্তি স্বরূপ কামানের গোলার সঙ্গে বেধে উড়িয়ে দেয়া হয়। আরেক জনকে কালাপানি কারাগারে নির্বাসিত করা হয়। আরেক ছেলে মাওলানা রহীম বকস প্রতিবাদী ছিলেন- ‘শত্রু শাসিত বা পরাধীন রাজ্যে জুমার নামাজ পড়া যাবেনা’ এমন ফতোয়ার বিরুদ্ধে। কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিজ যুক্তির পক্ষে পাল্টা ফতোয়া এনে নিজ বাড়িতেই প্রথম শুরু করেন জুমার নামাজ। যা এখনও জারি রয়েছে।

এদিকে কাজী এহসান এবং কাজী সাদ উল্লাহ ছেলে হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছেন কাজী আব্দুল আলীমেরও। যিনি একাধারে ছিলেন ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক এবং লেখক। নারিদের ক্রীড়াঙ্গনে পদচারণার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন পথিকৃৎ । তার বোন কাজী জাহেদা, কাজী নাসিমা ও কাজী শামীমাকে তিনিই ক্রীড়াঙ্গণে নিয়ে আসেন। যারা ১৯৬৩, ৬৪, ৬৫ এবং ৬৭ সালে সোনা, রূপা ও ব্রোঞ্জ মেডেল জয় করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ উজ্জল করেছিলেন।

কাজী আব্দুল আলীমও ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত টানা নয় বছর প্রাদেশিক অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেন। এছাড়া দায়িত্ব পালন করেছেন ক্রীড়াঙ্গণের নানা পদে। ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র ক্রীড়া শিক্ষাকেন্দ্র বিকেএসপি’র (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। এসব অবদানের জন্য ১৯৭৭ সালে ‘জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার’; ১৯৯৩ সালে ‘স্বাধীনতা পদক’ এবং ২০০৪ সালে ‘ইউনেস্কো এ্যায়ার্ড’এ ভূষিত হন কাজী আব্দুল আলীম।

এসব অর্জনের গল্পই এখন নতুন করে দেশি-বিদেশিদের সামনে তুলে ধরছেন কাজী এহসান এবং কাজী সাদ। সাদ বলেন, ‘আমাদের পরিবারটি প্রায় পাঁচশ বছরের একটা ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। এই পরিবারের ব্যপারে কথা বলতে অবশ্যই আমার ভালো লাগছে। তাছাড়া দুটো কমিউনিটি এক সঙ্গে হওয়া, নিজের কালচারটাকে তাদের সামনে তুলে ধারা বিশেষ করে ঢাকার ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলতে পারা আমার জন্যে গর্বের।’

পুরান ঢাকাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার তাগিদ নিয়ে ইউএসজি’র টিম লিডার স্থপতি তাইমুর ইসলাম বলেন, কেবল সংরক্ষণের কথা বললে হবে না। এর একটা আর্থিক উপযোগীতাও বের করতে হবে। আজকে যে কাজী বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছি ওনারও রাজি হয়েছেন হেরিজেট লাঞ্চ-ডিনার কমার্শিয়ালি অফার করতে। সেটা একটা বিশাল ব্যাপার। এর পাশাপাশি বলবো এরকম চমৎকার একটি বাসার নিচে গ্যালারি থাকতে পারে। সন্ধ্যার পর একটা কালচারাল ইভেন্ট হতে পারে। এই সবটা মিলিয়ে যদি কিছু একটা করা যায় তাহলে কাজী বাড়িটা নিজেই চমৎকার একটা এক্ট্রাকশন হবে।

‘হেরিটেজ লীড আরবান রিডেভলপমেন্ট’ এর প্রসঙ্গ টেনে তাইমুর বলেন, ‘এ ধরনের আরো কিছু পুরনো স্থাপনা এই এলাকায় আছে, সবটাকে মিলেই কিন্তু আমরা বেশ চমৎকার একটা ঐতিহ্যবাহী এলাকা তৈরি করে ফেলতে পারি।’

প্রসঙ্গত, একই ধারনায় এর আগে পুরান ঢাকার নূর বকস রোডের দুই শতাধিক বছরের পুরনো ‘জমিদার সাহেব বাড়িতে’ চালু হয়েছে ‘লাঞ্চ এট হেরিটেজ হোম’

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের ঢাকা ও সোনারগাঁয়ের সাবেক জমিদার মৌলভী আবুল খায়রাত মোহাম্মদের তৈরি করা বাসভবনে ওই আয়োজন আবু মোহাম্মদ ইমরানের । যিনি প্রতিনিধিত্ব করছেন আবুল খায়রাতের ষষ্ট প্রজন্মের।