বাংলাদেশে বিলুপ্তির পথ থেকে মূল ধারায় উর্দু সাহিত্য চর্চা

বাংলাদেশে বিলুপ্তির পথ থেকে ধীরে ধীরে মূল ধারায় যুক্ত হচ্ছে উর্দু সাহিত্য চর্চা। একাত্তর পরবর্তী বৈরী বাস্তবতায় হাতে লিখে পত্রিকা প্রকাশ করে চর্চাটিকে যারা জারি রেখেছিলেন তারাই এখন সংগঠিত হয়েছেন ‘বাংলা-উর্দু সাহিত্য ফাউন্ডেশন’-এর ব্যানারে। যার নেতৃত্বে আছেন বাংলাদেশের প্রবীণ কবি আসাদ চৌধুরী, বাংলাদেশ বেতারের সাবেক পরিচালক কবি জাহিদুল হকসহ আরও অনেকে।
২০০৭ সালে সংগঠনটির যাত্রা শুরু। পরের বছর পায় সরকারি নিবন্ধন। সম্প্রতি কথা হচ্ছিল ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি এবং ষাটের দশকের উর্দু কবি শামীম জামানভীর সঙ্গে। তিনি বলেন, কবি আসাদ ভাই কয়েক মাস দেশের বাইরে আছেন। নিয়মিত আড্ডাটা এখন হচ্ছে না। তিনি দেশে থাকলে তো প্রতি মাসেই বসা হয়।
একই সঙ্গে তিনি জানান, বিনিময় কিংবা আদান-প্রদানের কথা। যেমন, কবি আসাদ চৌধুরী বাংলায় অনুবাদ করেছেন কবি শামীম জামানভীর কবিতা সংকলন। শামীমও অনুবাদ করেছেন কবি আসাদ চৌধুরী, কবি সৈয়দ ফাইয়াজ হোসেন ও কবি সুলতানা ফয়জুন নাহারের কবিতা।
এরও আগে শামীম জামানভী অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লী কবি জসিম উদ্দিন, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লা সিরাজী ও অসীম সাহাসহ অনেকের কবিতা।
তবে অনুবাদ সাহিত্যের প্রসঙ্গ আসলে সবাই যাঁকে স্মরণ করছেন তিনি আহমদ সাদী। যাঁর বসবাস ছিল সৈয়দপুরে। ওখানে বসেই অসংখ্য কবিতার পাশাপাশি তিনি অনুবাদ করেছেন তিন শতাধিক বাংলা ছোট গল্প। উপন্যাসের মধ্যে আলাউদ্দিন আল আজাদের একটি এবং বিমল মিত্রের বহুল পঠিত উপন্যাস ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’।
শামীম জামানভী জানান, বিমল মিত্রের হাজার পৃষ্ঠার বেশি ওই উপন্যাসটির উর্দু অনুবাদ নাম দিয়েছিলেন ‘কড়িয়োঁকে মোল’। যা পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত আহমেদ নাদিম কাসমীর পত্রিকা ‘ফনুন’-এ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল এবং বেশ সাড়া পেয়েছিলেন।
তিনি আরও জানান, কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা অনুবাদ করেছেন আহমদ সাদী, যা বই আকারে প্রকাশ করেছে নজরুল একাডেমি। এছাড়া কবি ফজল শাহাবুদ্দিনের পুরো একটি সংকলন অনুবাদ করেছেন তিনি।
আহমদ সাদী ২০০৯ সালে মারা যান। সৈয়দপুরে আরও একজন কবি ছিলেন আদীব সোহেল। তিনি মারা যান করাচিতে। বর্তমানে বাংলাদেশে যে কয়জন উর্দু সাহিত্য চর্চা করছেন তাঁদের মধ্যে প্রবীণ আহমেদ ইলিয়াস। ১৯৩৪ সালে জন্ম নেয়া এই কবি পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা প্রেস ক্লাবে। পরে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা থেকে প্রকাশিত একমাত্র উর্দু দৈনিক ‘পাসবান’ পত্রিকায়। যার সম্পাদক ও মালিক ছিলেন মুস্তাফা হাসান। এরই মধ্যে অবজারভার হাউস থেকে ‘ওয়াতান’ পত্রিকা বের হলে ১৯৬০ সালে যোগদেন সেখানে। এছাড়া পাকিস্তান থেকে কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ সম্পাদিত পত্রিকা ‘ল্যায়ল-ও-নাহার’ এর ঢাকা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন এবং সদস্য ছিলেন ওই পত্রিকার সম্পাদকীয় বোর্ডের। যা ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বজায় ছিলো। এছাড়া তিনি যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ জিওলজিক্যাল সার্ভে বিভাগের সঙ্গে। বর্তমানে তিনি ঢাকায় আটকে পরা উর্দুভাষী রিফিউজিদের শিক্ষা-পুনর্বাসন কাজে নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থা আল ফালাহ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
সম্প্রতি দেখা হলে আলোচনার শুরুতেই প্রসঙ্গ তুলেন পুরনো সাংবাদিক বন্ধু ও সহকর্মীদের। বলেন, আতাউস সামাদ ভাইয়ের সঙ্গে বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিল। দেয়ালে টাঙানো ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলেন- ওই যে আতাউস সামাদ ভাই আর আমি’। দৈনিক সংবাদের সাবেক সম্পাদক কে জি মুস্তাফার প্রসঙ্গ তুলে বলেন, স্বাধীনতার পরে তাঁর সুপারিশেই আমি প্রথম পাসপোর্ট পেয়েছিলাম।
এ যাবৎ আহমেদ ইলিয়াসের ৫টি কবিতা সংকলন বের হয়েছে। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘আয়না রেজা’ বা কাঁচের টুকরো প্রকাশ হয় ১৯৮৯ সালে এবং সর্বশেষটি ২০১৭ সালে। যার কবিতায় বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে এই বাংলাদেশেরই সমাজ-সংস্কৃতি, পরিবেশ-প্রকৃতি ও রাজনীতি।
আহমেদ ইলিয়াস ও তাঁর কবিতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ‘কালবৈশাখী’ শীর্ষক একটি কবিতার প্রসঙ্গ টানেন উর্দু ভাষা ও সাহিত্য গবেষক জাভেদ হুসেন। তিনি লিখেন, উর্দু কবিতায় প্রকৃতির বর্ণনা খুব জায়গা পায় না। এর প্রধান উপজীব্য মানুষের মনের মৌসুম। ইলিয়াসের কবিতা বাংলার মাটি আর প্রকৃতিকে ধারণ করে তৈরি হচ্ছিল। এই মাটিতে তাই সৈনিকদের তাণ্ডবকে তিনি শান্ত জনপদের বুকে কালবৈশাখীর কালো ঝড় বলে বর্ণনা করেছেন।
কবিতাটির বাংলায় অনুবাদ কয়েকটি লাইন তুলে ধরেন জাভেদ হুসেন:
আমি জানি, তবু আমি জানি
কালো ঝড়, এই কালো লস্কর
দুইয়েরই নিয়তি পরাজয়
আমি জানি, আমি জানি
প্রদীপ নিভেছে যে ঘরে
সুর্য সেখানে উঠবেই।
বাঙালীদের আন্দোলন-সংগ্রামের স্বপক্ষে উর্দু কবিদের মধ্য থেকে উঠে আসা আরেক নাম নওশাদ নুরী। ১৯৪৭-এর দেশ ভাগত্তোরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর প্রথম আমেরিকা সফরকে ব্যঙ্গ করে পাটনায় এক জনসভায় ‘দে দে রাম, দেলাদে রাম’ স্লোগান তুলে প্রশাসনের রোষানেলে পরেন। পালিয়ে আসেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গে। মেনে নিতে পারেননি বাঙালীদের ওপর পাকিস্তানি শাসকদের উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তকেও। তিনি ওই সিদ্ধান্তকে উল্লেখ করেন ‘আসন্ন বালা’ বা বিপদ হিসেবে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘মহেঞ্জোদারো’ কবিতায় তিনি এ ভবিষ্যৎবাণী উচ্চারণ করেন।
তবে পরিস্থিতি পাল্টে যায় স্বাধীনতাত্তোর কালে। বাস্তবতা বৈরী হলেও ঢাকা, খুলনা ও সৈয়দপুরে হাতে লিখে পত্রিকা বের করা শুরু করেন কয়েকজন। এঁদের মধ্যে খুলনা থেকে শামীম জামানভী বের করেন ‘পারওয়াজ’ এবং খলিলুর রহমান দাখনি বের করেন ‘সঙ্গেমিল’ পত্রিকা। ঈশ্বরদী থেকে ‘ঘানচক্কর’ বের করতেন আহমদ বদর এবং সৈয়দপুর থেকে আবিদ আলী বের করতেন ‘নেই রশনী’। এরই ধারাবাহিকতায় আজকে বাংলা-উর্দু ফাউন্ডেশন।
শামীম জামানভী বলেন, এখানে উর্দু চর্চার পরিসর বরাবরই সীমিত। বই নেই, সাময়িকী নেই। কবি সম্মেলন নেই। তারপরও চর্চা থেমে নেই। পরিসর বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।