কাশ্মীরে সেনা বৃদ্ধি ছাড়া কোন পরিবর্তন হয়নি: অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ

সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলুপ্তির মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন বিলোপ করে অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরকে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ৫ আগস্ট এই স্বায়ত্তশাসন হরণের এক বছর পূর্ণ হলো। গত এক বছরে সেখান সেনাদের উপস্থিতি বৃদ্ধি, হত্যা, নির্যাতন এবং কাশ্মীরীদের অবরুদ্ধ জীবনসহ কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির নানা দিক নিয়ে সাউথ এশিয়ান মনিটরের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। সাক্ষাতকার নিয়েছেন শফিক রহমান।
সাউথ এশিয়ান মনিটর (স্যাম): ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ৩৭০ ধারা বিলোপের পক্ষে যুক্তি তুলে বলেছিল: ৭০ বছরের জঞ্জাল মুক্ত হলো। এবার কাশ্মীরের উন্নতি হবে। গত এক বছরে সেখানে আদৌ কোন পরিবর্তন চোখে পরেছে কি?
ইমতিয়াজ আহমেদ (ইআ): সেখানে সৈন্য বাড়ানো ছাড়া আর কোন পরিবর্তন আমরা দেখছি না। জনজীবন অবরুদ্ধ। এখনও ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত। আমার মনে হয় সেখানকার পরিস্থিতি আরও জটিল করে ফেলা হয়েছে এবং ওই জটিলতার প্রভাব ইতোমধ্যে পড়েছে। সেটা হলো, ওখানে বেশ কয়েকটি স্টেকহোল্ডার রয়েছে। একটাতো কাশ্মীরী জনগণ এবং সেটা মুসলিম-হিন্দু এবং বুদ্ধিস্ট, যদিও সংখ্যায় তারা কম। মুলত মুসলিম ও হিন্দুরাই বড় স্টেকহোল্ডার। কোন সন্দেহ নেই তাদের মধ্যে মুসলিম কাশ্মীরীদের আরও এব্রোগেট করে দেয়া হলো। ফলে যারা এতদিন আন্দোলন করছিলো, বিশেষ করে যারা রেডিক্যাল তারা মডারেটদেরকে সহজেই বুঝাতে পারছে যে ভারত সরকার তাদের ব্যাপারে কখনোই সৎ ছিল না। বিশেষ মর্যাদা ছিল অনেকটা ‘ধোকাবাজি’।
আরেকটি হলো পাকিস্তানের সঙ্গে জটিলতা। এছাড়াও যে জটিলতাটি না আসার কোন কারণ ছিলনা, সেটা হলো চীনের সঙ্গে জটিলতা। যেহেতু কাশ্মীরের সঙ্গে, বিশেষ করে গালওয়ান উপত্যকার সঙ্গে চীনের সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে। এই এব্রোগেশনের ফলে কাশ্মীরের বর্ডার ইস্যুটা চলে আসে। তখন চীনের সঙ্গে ‘লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোল’ (এলএসি) হয়ে গেল ‘লাইন অব এ্যকচুয়াল বর্ডার’। আমরা দেখলাম, ২০ ভারতীয় সেনা মারা গেল শুধু হাতাহাতিতেই। কোন আগ্নেঅস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। অস্ত্রের ব্যবহার হলে হতাহত আরও বেশি হতো।
তাছাড়া, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বেড়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। সেটা খুবই স্পষ্ট হয়েছে নেপালের ব্যাপারে। দেখা যাচ্ছে, নেপাল সেই আগের নেপাল নেই। এখনকার নেপাল স্পষ্টতই বলে দিচ্ছে তার জাতীয় স্বার্থ কোথায় রক্ষা হবে। শ্রীলঙ্কাতেও সেটাই দেখেছি। আবার রাজাপাকসা ক্ষমতা চলে এসেছে। মালদ্বীপও তাই। পাকিস্তানও তো আগে থেকেই চীনের পক্ষে। চীনের সাথে বাংলাদেশেরও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যদিও এই সম্পর্ক ভারতকে আলাদা করে না। এরপরও ভারত চিন্তিত যে- বাংলাদেশও বুঝি চীনের হয়ে গেছে। সবমিলিয়ে নয়া দিল্লীর ফরেন পলিসির একটা দুর্বলতা সমানে চলে এসেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
স্যাম: কাশ্মীরীদের সঙ্গে যা ঘটছে বিশ্বের আর কোন অঞ্চল বা জনগোষ্ঠির সঙ্গে এর তুলনা করা যায় কিনা?
ইআ: অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে লাভ নেই। মূল কথা হচ্ছে, কাশ্মীরে এরকম একটা অবস্থা তৈরি করে ভারতের সরকার পার পাবে কিনা এবং সমস্যার সমাধান হবে কিনা? স্পট বলা যাচ্ছে সমস্যার সমাধান হবে না। এখন কথা হচ্ছে সমাধান কিভাবে হবে। একটা হতে পারে সুপ্রিম কোর্ট। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত আদালত নাচক করবে কিনা সেই রায় এখনো আসেনি। অনেকে মনে করেন যেটা করা হয়েছে সেটা ভারতের সংবিধানের পরিপন্থী। তারপরও সবকিছু আবার সংবিধানের মধ্যে সীমিত থাকে না।
তবে আদালত কীভাবে রায় দেবে সেটা আমারা জানি না। কিন্তু কোন জায়গার মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধেতো কিছু করা সম্ভব না। আদালতের সেটা না বোঝার কারণ নেই।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, দ্বিজাতি তত্ত্ব। যেটা বিজেপি করছে সেটা নতুন কিছু না। অনেকে ভুলে গেছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ১৮ বছর আগে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ যেটা আরএসএস হলো তারাই এর ক্যাম্পেইন করেছিল। বাংলাদেশ এটা থেকে ১৯৭১ সালে বেড়িয়ে গেছে কিন্তু এখন এটা করে বিজেপি পুরো ইতিহাসকে পেছনের দিকে নিতে চাচ্ছে। আমরা দেখছি তাদের এনঅরসি, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পুরো ভারতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সেখানকার জনগণই জেগে উঠেছে। দিল্লী থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজ্যে বড় ধরনের আন্দোলন চলছে এর বিরুদ্ধে। অনেক রাজ্য বলে দিয়েছে তারা এনআরসি বা এধরনের কোন জরিপের সঙ্গে থাকবে না। আসলে করোনা মহামারী কিছুটা বাঁচিয়ে দিয়েছে সরকারকে। তাই কথা হচ্ছে এই দ্বিজাতি তত্ত্ব দিয়ে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করা যাবে? উত্তর হলো, না।
স্যাম: একটা ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীকে অবরুদ্ধ রেখে ভারত কি অর্জন করতে চায় বলে মনে হয়?
ইআ: মনে রাখতে হবে নির্বাচনের পুরো বিষয়টি পরিবর্তন হয়ে গেছে। যেটাকে আমরা গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলি সেই নির্বাচন দিয়ে হিটলার নির্বাচিত হয়েছিলেন, মুসোলিনিও। নির্বাচনের একটা বিরাট খারাপ দিক আছে। সেটা হলো, ক্ষমতায় আসতে ৫০ শতাংশ ভোটও দরকার হয় না। নরেন্দ্র মোদির ভোটের হার ৩৪ শতাংশ। আর, এই ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েই সে টু/থার্ড মেজরিটি পেয়ে গেছে। তার ৪০ শতাংশও দরকার নেই। ফলে সে ভালো করেই জানে এই ৩৪ শতাংশ কি চায়। তারা এই ধরনের কাশ্মীরই চায়।
এই জন্যই গান্ধী নির্বাচনের বিরোধী ছিলেন। তারতো বিখ্যাত কথাই আছে ‘ইট ইস এ হার্টলেস ডকট্রিন’। তিনি বলেছিলেন এটা কিভাবে সম্ভব, যে ৫১ শতাংশ ভোট পাবে সেই সব ক্ষমতা পেয়ে যাবে, তাহলে ৪৯ শতাংশের কি হবে? এখনতো ৫১ শতাংশেও দরকার হয়না ৩৪ শতাংশ ডিকটেট করছে ৬৬ শতাংশকে।
আমি মনেকরি কাশ্মীরী জনগণ যেভাবে লড়াই করেছে তারা আর লড়াই ছাড়বে না। ভারতের জনগণও জেগে উঠবে। তারা জেগেতো উঠেছিল মহামারীর আগে। এখন দেখা দরকার ভারতের জনগণ কখন আবার জেগে উঠে। না হলে ভারতের ভোগান্তি বাড়বে।
স্যাম: ভারত বলতে চাচ্ছে কাশ্মীর ইস্যুটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আসলেই কি তাই? একে আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক বলা যায় না?
ইআ: কাশ্মীর তো আজকের ইস্যু না। মনে রাখতে হবে পুরোটা জাতিসংঘের বিষয়। জাতিসংঘের যে ধরনের সেটেলমেন্টগুলো পাস হয়েছে সবগুলোই কিন্তু নাকোচ করে এই এব্রোগেশন। ভারত কোন কিছু তোয়াক্কাই করছে না। কারণ সে ভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প হলো তার বন্ধু। সে যদি জাতিসংঘকে তোয়াক্কা না করে পার পেতে পারে তাহলে তার পার না পাওয়ার কোন কারণ নেই।
সে হিসেবে মূল দায়িত্বটা এখনও ভারতের জনগণের এবং কোন সন্দেহ নেই কাশ্মীরের জনগণের। তারা যেহেতু লড়াই করে আসছে সেই কবে থেকে। আমার মনে হয়না লড়াই ছাড়া তাদের আর কোন উপায় আছে। ভারতের জনগণ কত তাড়াতাড়ি কাশ্মীরের জনগণের পাশে দাঁড়াবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
স্যাম: বাংলাদেশের মুখ থেকেও ভারত শুনতে চাচ্ছে ইস্যুটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশ এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। এতে কি কোন নীতিগত পরিবর্তন আসছে বলে মনে হয়?
ইআ: আমরা এমন কোন কথা আগেও বলিনি যেটা বাংলাদেশের মূলনীতি- ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরীতা নয়’ সেটাকে নাকচ করে। আমাদের ডেভলপমেন্ট মূলত উইদাউট এনিমি। মিয়ানমার যথা সাধ্য চেষ্টা করেছে এনিমি বানাতে কিন্তু সেখানেও আমরা সম্পর্ক রাখছি। এখনও দ্বিপাক্ষিক কথাবার্তা বলছি। রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো এত বড় একটি ইস্যু হওয়ার পরেও মিয়ানমারকে এনিমি হিসেবে দেখতে চাই না।
আমি সব সময় মনে করি, কাশ্মীরী জনগণ এবং ভারতের জনগণ ইস্যুটির সমাধান করবে। সেখানে বাংলাদেশ যদি কোন স্টেটমেন্ট না দিয়ে থাকে সেটাই সঠিক। সে এর মধ্যে কোনভাবেই ঢুকতে চাচ্ছে না।
পাকিস্তানের বিষয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে এবং চীনের প্রসঙ্গেও একটা আলোচনা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের কিছু সাংবাদিক আছেন তাদের দুর্বলতা বোঝার একটা বিষয় আছে। অনেকে মনে করেন, পত্র-পত্রিকা পড়ে নিলেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বোঝা যাবে এবং কিছু লিখে ফেলালাম। কিন্তু আরও ভাবনা চিন্তা করা দরকার।
আমাদের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অর্থনৈতিক। কোনভাবেই আমরা বলিনি- চীনের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে বলে যারা চীনের শত্রু তাদের সঙ্গে আমারও শত্রুতা। কখনও এটা বলিনি। যারা চীনের শত্রু, তারা চীনেরই শত্রু আমাদের নয়।
পাকিস্তানে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। সেখানে ইমরান খান ক্ষমতায় এসেছেন। বলতে গেলে বহুদিন পরে একজন প্রধানমন্ত্রী যার কোন ব্যাগেজ নেই। মুসলিম লীগেরও ব্যাগেজ নেই, আবার পিপিপি’রও ব্যাগেজ নেই। আবার মিলিটারিরও ব্যাগেজ নেই। আগের যে কোন প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির এই ব্যাগেজটা থাকতো এবং ঐতিহাসিকভাবে তিনটারই বাংলাদেশের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক রয়েছে। ইমরান খানতো স্পষ্টভাবে একাধিকবার বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, বাংলাদেশের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। এখানেই আমি বলতে চাচ্ছি- সত্তুরের দশকের বাংলাদেশ আর ২০২০ সালের বাংলাদেশ এক নয়। যেটা আমেরিকা বুঝতে চায়না যে, চল্লিশের দশকের চীন ও এখনকার চীন এক না। এটা ভারতীয়রাও বুঝতে চাচ্ছেনা।
পাকিস্তান এখন যেহেতু বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে উৎসাহী। আমাদের দেখা দরকার ১৯৭১-এর ব্যাপারে তাদের পরিবর্তন এসেছে কিনা। আমি মনে করি তাদের দিক থেকে পরিবর্তন আসা দরকার এবং শুধু আমি না পাকিস্তানে প্রচুর বুদ্ধিজীবী আছেন তারাও মনে করেন, এই ব্যপারটা সুরাহা হওয়া দরকার।
সার্ককে আবার রিভিজিট করা দরকার এবং সেখানে যেহেতু নেপালের হাত থেকে পাকিস্তানের কাছে প্রেসিডেন্সি যাবে, সেই জায়গায় পাকিস্তানের একটা ভূমিকা হয়তো থাকবে। সার্ক কতখানি কার্যকর হবে জানিনা তবে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যে বিরোধ সেটার মধ্যে আমরা ঢুকতে চাচ্ছি না। ভারতের সঙ্গে চীনের যে বিরোধ তাতেও আমরা ঢুকতে চাচ্ছিনা। আমরা কোন বিরোধের মধ্যে নেই এটা স্পষ্ট। কিন্তু একটা দেশ মনে করে আমাকে একটা পক্ষে থাকতেই হবে। একজন একাডেমিশিয়ান হিসেবে আমি মনে করিনা বাংলাদেশের সেটা প্রয়োজন আছে।
স্যাম: কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বিলোপে ভারত কি অর্জন করলো, আর কাশ্মীর কি হারালো?
ইআ: ভারতের জনগণের জন্য জটিলতা কমালো না, বরং বাড়ালো। সেই জায়গায় ভারতের জনগণ এখন কি করবে, সুপ্রিম কোর্ট কি ডিসিশন নিবেন সেটাই দেখা দরকার।