দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের বিরোধী চীন

বাংলা দৈনিক ভোরের কাগজের এক খবরে বলা হয়েছে যে চার মাস ধরে বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাত করেননি। তাছাড়া ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছেভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও বাংলাদেশে ভারতীয় প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে ধীর গতি নিয়েও দুই দেশের সম্পর্কে চিড় ধরেছে।
বাংলাদেশ ও চীন খুবই বন্ধুপ্রতীম। ৪০ বছর আগে বাংলাদেশে দুই বছর অবস্থানের অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। চীনা জনগণের প্রতি বাংলাদেশীদের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব আমি দেখেছি। কঠিন সময়ে এই দুই দেশ পরস্পরকে সাহায্য করেছে। বাংলাদেশ যখনই আঞ্চলিক শক্তির উৎপীড়নের শিকার হয়েছে তখনই দেশটির জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষায় চীন সাহায্য করেছে।
ছোট বড় সব দেশ সমান - চীনের এই মনোভাব বাংলাদেশীদের কাছে সমাদৃত। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা ৯৭ ভাগ পণ্য শুল্কমুক্ত ঘোষণা করেছে চীন। বস্ত্রপণ্যে বাংলাদেশ বেশ সমৃদ্ধ। চীন ছাড় দেয়ায় তার বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের প্রবাহ বাড়বে। এটা বাংলাদেশের উপর আঞ্চলিক শক্তির চাপ প্রতিহত করতে পারে।
ভূখণ্ড নিয়ে বিরোধে ভারত-নেপাল সম্পর্কও উত্তেজনাপূর্ণ। গত মে মাসে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক উদ্বোধন করেন, যা ভারতের দখল করা নেপালি ভূখণ্ড কালাপানির মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এতে নেপালে প্রবল বিক্ষোভ দেখা দেয়। নেপাল সরকারও কোন দুর্বলতা দেখাতে রাজি নয়। তারাও পাল্টা আঘাত হানে। ২০ মে নেপাল নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে, যাতে কালাপানিসহ ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ অন্যান্য ভূখণ্ড নেপালের অঞ্চল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
গত দুই বছর ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় সংঘাত লেগেই আছে। পাকিস্তান আইএসপিআর জানায়, চলতি বছর ২১ জুলাই পর্যন্ত ভারতীয় সেনারা নিয়ন্ত্রণ রেখায় ১,৭৩২ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে।
গত জুনে চীন-ভারত সীমান্তের পশ্চিম অংশে গালওয়ান উপত্যকায় গুরুতর সামরিক সংঘর্ষ হয়। এতে অনেক হতাহতও হয়। ভারতের সংবিধান পরিবর্তন করে কাশ্মির অঞ্চলের স্থিতাবস্থা বদলে ফেলা এই সংঘাতের মূল কারণ। গত বছর অক্টোবরে ভারত লাদাখ অঞ্চলকে কেন্দ্র শাসিত ভূখণ্ড হিসেবে ঘোষণা করে। চলতি বছরের মে মাসে ভারতীয় সেনারা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) পার হয়ে চীনা ভূখণ্ডে ঢুকে অবৈধ তৎপরতা শুরু করে। তারা তথাকথিত ‘ফরোয়ার্ড পলিসি’ বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবেশি প্রায় সবগুলো দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এতে অঞ্চলটির শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের উপর প্রভাব পড়ছে।
প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রক্ষাকে চীন সবসময় গুরুত্ব দিয়ে আসছে এবং তার কূটনীতিতেও এটি প্রাধান্য পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম মেয়াদে ভারতের অর্থনীতি দ্রুত বাড়ছিলো। ভারতের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে এসে মনে হচ্ছে মোদি রাজনীতি করতেই বেশি উৎসাহী। ২৯ জুলাই পর্যন্ত দেশটিতে নিশ্চিতভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সংখ্যা ছিলো ১,৫৩৫,৩৩৫ জন। আর মৃত্যু সংখ্যা ৩৪,২৫২। বিশ্বের অন্যতম বড় করোনাআক্রান্ত দেশ হিসেবে এই মহামারী মোকাবেলার দিকেই ভারতের মনযোগ দেয়ার কথা ছিলো। ভারত কেন এটা করা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দিকে মনযোগী হচ্ছে না সেটা আমার বুঝে আসে না। বদলে তারা সারা দেশে জাতীয়তাবাদী ধুয়া তুলে সবাইকে আক্রমণ করছে এবং প্রতিদেশী দেশগুলোর সঙ্গে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে। ভারতের কিছু এলিট ও সামরিক ব্যক্তি হাস্যকরভাবে চীন-বিরোধী ও পাকিস্তান-বিরোধী জাতীয়তাবাদ উষ্কে দিয়ে একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করছে।
চীন-মার্কিন সম্পর্কে সমস্যা দেখে এ থেকে ফায়দা হাসিল করতে চায় ভারত। তারা মনে করে চীনের সঙ্গে সমস্যা তৈরি হলে সে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সুবিধা পাবে। যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া হয়ে চীনকে চারদিকে থেকে ঘিরে ফিলতে চাচ্ছে কারণ চীনারা মার্কিনীদের কল্পনার চেয়েও দ্রুত অগ্রগতি করছে। শক্তিকে শক্তি দিয়ে মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীন। ভারত কি জানে যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তার কোন মূল্য নেই এবং তারাই যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা ক্ষতির শিকার হচ্ছে? চীন থেকে ভারতে বিনিয়োগ সরিয়ে নিতে মোদি বার বার মার্কিনি ও পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে কোলাকুলি করছেন। কিন্তু যে দেশটির বিনিয়োগ পরিবেশ দুর্বল, সমাজ বিশৃঙ্খল ও মহামারীতে বিপর্যস্ত সেখানে মার্কিন ও পশ্চিমারা বিনিয়োগ নিয়ে যাবে এটা কি কোন ‘স্মার্ট’ নেতা বিশ্বাস করেন?
ভারতের সাম্প্রতিক তৎপরতা সীমান্তে সংঘাত এবং অর্থনীতি ও বাণিজ্যে বহু ধরনের টানাপোড়ন তৈরি করেছে। এরপরও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক সঠিক পথে নিয়ে যেতে চায় চীন। বেইজিং কঠোরভাবে এলএসি মেনে চলে। তারা মনে করে বহু দশকের কষ্টকর প্রচেষ্টায় সীমান্ত এলাকায় যৌথ প্রচেষ্টার কারণেই শান্তি ও প্রশান্তি অর্জিত হয়েছে। সম্প্রতি সীমান্তে ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে যতগুলো সংঘাত হয়েছে সেগুলোর কারণ ভারতীয় সেনাদের এলএসি পার হয়ে আসা। উভয়পক্ষ এলএসি মেনে চললে এমনটি হবে না।
উত্তেজনা হ্রাসের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও চীন সমরিক ও কূটনৈতিক চ্যানেলে ব্যাপক আলোচনায় নিয়োজিত হয়। সামরিক কমান্ডারদের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। বিরোধপূর্ণ বেশিরভাগ এলাকা থেকে দুই পক্ষের সেনারা সরে গেছে। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসছে। বাকি সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য আবারো বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছেন সামরিক কমান্ডাররা।
আমি মনে করি ডিজএনগেজমেন্ট মানে হলো গালোয়ান উপত্যকা থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার এবং তারা এলএসি লঙ্ঘন করে সংঘাত উষ্কে দেবে না। চীনা ভূখণ্ডে ঢুকে ভারতের ‘ইউনিয়ন টেরিটরি অব লাদাখ’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও বাদ দিতে হবে। এ চেষ্টা করলে চীন আবারো তাদের তাড়িয়ে দেবে। আরো ভারতীয় সেনা প্রাণ হারাক এটা কেউ চায় না।
দক্ষিণ এশিয়াকে ভারত নিজের প্রভাববলয় মনে করে। এখানকার কোন দেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে চাইলেই তারা সেখানে নাক গলায়। অথচ চীন যেমন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয় তেমনি ভারতের সঙ্গে সহযোগিতাও তার কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে সেটাও কামনা করে দিল্লীর উত্তরের প্রতিবেশী।
চীন বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরোধী। চীন ও পাকিস্তানের সম্পর্ক কোন তৃতীয় দেশকে লক্ষ্য করে নয়। দুটিই উন্নয়নশীল দেশ। পাকিস্তান ও চীনের নিরাপত্তা স্বার্থ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। চীনের পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তা রক্ষায় পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সন্ত্রাসদমন সামর্থ্য ও নিরাপত্তা-দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করেছে চীন। যৌথভাবে অপ্রচলিত হুমকি মোকাবেলার জন্য চীন পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতা জোরদার করেছে।
(লেখক, ভিজিটিং প্রফেসর, সাউথওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি অব পলিটিক্যাল সাইন্স অ্যান্ড ল)