আমরা লাইভে English বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৩, ২০২৩

চীনপন্থি প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা, নেপালের সঙ্গে কূটনীতি জোরদার করছে ভারত

325288_Abul-10

সম্প্রতি রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতায় উত্তাল হয়ে উঠেছে শ্রীলঙ্কা ও নেপাল। এসব দেশ সহ ‘চীনপন্থি’ এমন প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনীতি জোরদার করেছে ভারত। এসব দেশে কয়েক সপ্তাহে অবকাঠামো এবং আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার। দৃশ্যত তারা এটাকে একটি সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে বহুমুখী কূটনৈতিক কৌশল। একই সঙ্গে এই কূটনৈতিক কৌশলে পশ্চিমাদের সঙ্গে এবং জাপানের সঙ্গে কোয়াড ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে নিরাপত্তা শক্তিশালী করা হচ্ছে। অনলাইন নিক্কি এশিয়াতে এসব কথা লিখেছেন সাংবাদিক ময়ূরী বাবা এবং সুকাসা হাডানো।

ওই প্রতিবেদনে তারা আরও লিখেছেনÑ এপ্রিলের শুরুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কথা বলেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা’র সঙ্গে।

এ সময় দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ককে বন্ধুত্বপূর্ণ বলে প্রশংসা করা হয়। বলা হয় এমন সম্পর্ক পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যাবে না। তবে এই সম্পর্ক সবসময় আরামদায়ক নয়। নেপাল এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যরা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের আধিপত্যবাদী মনোভাব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে আসছে।

ভারতীয় ও নেপালি দুই নেতার মধ্যে আলোচনার পর জ্বালানি সহযোগিতা বিষয়ক একটি যৌথ বিবৃতি দেয়া হয়। বলা হয়, নেপালে বিদ্যুৎ উপাদন কেন্দ্র তৈরিতে সাহায্য করবে ভারত। নেপালে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে তা ভারতে বিক্রি করা যাবে।

২০২১ সালে নেপালে রাজনৈতিক ঝড় বয়ে যায়। তারপর জুলাই মাসে পঞ্চম বারের মতো নেপালের প্রধানমন্ত্রী হন দেউবা। তার আগে নেপালে যে শাসকগোষ্ঠী ছিল তারা ছিল চীনপন্থি উদার কমিউনিস্ট কেপি শর্মা ওলিওর নেতৃত্বাধীন। কিন্তু দেউবা তার দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার দিকে ঝুঁকে পড়েন। আর এই সুযোগে নরেন্দ্র মোদি নেপালের জ্বালানি খাতে সহযোগিতা দেয়ার মাধ্যমে তাদেরকে আকৃষ্ট করার একটি সুযোগ লুফে নেন।

বিবৃতিতে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের দিক থেকে এ দুটি দেশ তাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা পানিবিদ্যুত উৎপাদন করবে। এটা হবে তাদের জ্বালানি বিষয়ক অংশীদাররিত্বের একটি মাইলফলক। তারা একে অন্যের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমতার ভিত্তিতে পরস্পরের জাতীয় প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিতে অব্যাহত সমর্থন দেয়ার বিষয়ে একমত হয়।

এ অঞ্চলে বাজির বিষয়টি উচ্চ। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী বৃহৎ শক্তিগুলোর ওপর কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে গত বছরের শেষের দিকে। এতে বিশ্লেষক থানভি মদন লিখেছেন, ভারত ও চীনের মধ্যকার বিরোধের পরিণতি এ অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য নির্ধারণে সহায়ক হবে। তবে এক্ষেত্রে কোনো দেশ অন্য দেশের সঙ্গে সহযোগিতা করবে নাকি একে অন্যের সঙ্গে তুলনা করবে তা বেছে নিতে পারে। তারা অন্য বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক একং বৈশ্বিকভাবে সহযোগিতা করবে কিনা তাও বেছে নেবে।

মোদি-দেউবা আলোচনার ঠিক কয়েকদিন আগে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপ সফরে সৌজন্য সাক্ষাত নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। শ্রীলঙ্কা বর্তমানে একটি ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত। এই সফরে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসের সঙ্গে দেখা করেন জয়শঙ্কর এবং ২০২২ সালে প্রায় ২৫০ কোটি ডলারের ভারতীয় আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীলঙ্কার পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পগুলি চালাতেও সম্মত হন। একই সঙ্গে স্কুলগুলিতে সফ্টওয়্যার সরবরাহ করবে।

 

ঋণে জর্জরিত এই প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারতের সম্পৃক্ততা প্রত্যক্ষ সহায়তার বাইরে অন্যকিছু। ১৯ এপ্রিল দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা দ্রুত আর্থিক সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাথে আলোচনা শুরু করার পর ভারত আইএমএফকে ঋণ সহায়তার জন্য অনুরোধ করে। ওয়াশিংটনে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বৈঠকের ফাঁকে আইএমএফ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সাথে এক বৈঠকে ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেছেন, শ্রীলঙ্কাকে সহায়তা করা এবং জরুরিভাবে আর্থিক সহায়তা দেওয়া উচিত আইএমএফের।

প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে এবং তার ভাই, সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসেকে চীনপন্থী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বেইজিংয়ের সাথে তাদের চুক্তিবদ্ধ থাকার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। মাহিন্দ রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ে বন্দর নগরী কলম্বোতে চীনসমর্থিত অর্থনৈতিক জোন বিষয়ক প্রকল্প এখন চলমান। এই প্রকল্প প্রথম সাজানো হয়েছিল প্রথম মাহিন্দ রাজাপাকসের সময়ে। সিএফআর রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে, চীনের আরেকটি বন্দর বিষয়ক প্রকল্প রয়েছে দক্ষিণ শ্রীলঙ্কার হাম্বানতোতায়। যুক্তরাষ্ট্র চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে অধিক প্রতিদন্দ্বিতাপূর্ণ হিসেবে দেখছে।

কিন্তু শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক রিজার্ভ যখন কমে আসছে, প্রতিদিন প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবি জোরালো হচ্ছে তখন প্রচ- চাপে রয়েছে রাজাপাকসেরা। ওদিকে ভারত পরিষ্কার করে বলেছে, এই সঙ্কটের সময়ে তার প্রতিবেশীকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করবে। রাজাপাকসের সঙ্গে মিটিং নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর টুইটে বলেছেন, আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ককে বিভিন্ন দিক থেকে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। রাজাপাকসেকে ভারতের সহযোগিতা ও অনুধাবনের বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে।

মালদ্বীপও অবকাঠামোগত সমর্থনের জন্য চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কিন্তু ঋণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে তারা। এ অবস্থায় মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সালিহ’র সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন জয়শঙ্কর এবং তাকে বলেছেন ভারত তাদের পুলিশ স্টেশন, বন্দরনগরীর নিরাপত্তায় রাডার স্থাপন, সড়ক এবং বিমানবন্দরের উন্নয়নে সহযোগিতা করবে।

এখানেই ছেড়ে যাবেন না। শেষের দিকে দক্ষিণ এশিয়ায় ঘুরছে চীন। এরই মধ্যে স্টেট কাউন্সিলর এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং নেপাল সফর করেছেন। একই সঙ্গে ২২ থেকে ২৭ শে মার্চ পর্যন্ত সফরের সময় ভারতও সফর করেছেন তিনি।

নেপাল সফরের সময় ওয়াং ই’কে দেউবা নিশ্চিত করেছেন যে, চীন বিরোধী কোনো কর্মকা- চালাতে কোনো শক্তিকে নেপালের ভূখ- ব্যবহার করতে দেবে না তার সরকার। তিব্বতিরা নেপাল দিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছেন এবং বিদেশে নির্বাসিত তিব্বত সরকারে যোগ দিচ্ছেন। এ নিয়ে চীনের নেতৃত্বের উদ্বেগ আছে। এই শরতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় কংগ্রেসের সম্মেলন। এ সময়ে নিজের তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতা নিশ্চিত করার প্রত্যাশা করতে পারেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এই সম্মেলনকে সামনে রেখে যেকোনো রকম ফ্যাক্টর, যা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে তা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে বেইজিং।

সিএফআরের রিপোর্ট বলছে, ভারতে তিব্বতীয়দের উপস্থিতি, দালাইলামার কর্মকা- এবং সেন্ট্রাল তিবেতান এডমিনিস্ট্রেশনের বিষয়ে বেইজিং অব্যাহতভাবে প্রশ্ন তুলে যাচ্ছে। একইভাবে দক্ষিণ এশিয়াকে ভারত দেখে তার ঘরের পিছনের উঠোনের মতো এবং দীর্ঘদিন ধরে তারা এখানে প্রভাবের বলয় সৃষ্টি করতে চাইছে। এ অবস্থায় এ অঞ্চলে চীনের ভূমিকা এবং এ অঞ্চলের দেশগুলোকে বড় রকম সামরিক সহযোগিতাকে সন্দেহের চোখে দেখছে ভারত। সর্বোপরি চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে। এ নিয়ে ২০২০ সালে সেখানে ভয়াবহ সংঘর্ষ ঘটে গেছে।

সিএফআর-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, দিল্লি এ নিয়ে উদ্বিগ্ন যে বেইজিং সর্বত্র একতরফা প্রভাব বিস্তার করছে। যেমন দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরে, ভুটান এবং নেপালের সঙ্গে তাদের সীমান্তে। যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো অংশীদারদের সঙ্গে ভারতের কাজ করার আগ্রহের মধ্যে এই উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে।