ইউক্রেন যুদ্ধে লাভ হচ্ছে কার?

ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ চার সপ্তাহ অতিক্রম করল। প্রথমদিকে ধারণা করা হচ্ছিল খুবই স্বল্পমেয়াদী একটি সামরিক হস্তক্ষেপ করছে পুতিন। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি দেখে সে চিন্তা যে ভুল, তা প্রমাণিত হলো। এই চার সপ্তাহের যুদ্ধের ভেতর থেকে একটা জিনিস পৃথিবীর সকলের সামনে এসেছে তা হলো বিশ্ব শান্তির ক্ষেত্রে বিশ্বের সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে জো বাইডেন তথা ইঙ্গ-মার্কিন নেতৃত্ব এমনকি পুতিনের নেতৃত্বও পুরোপুরিভাবেই ব্যর্থ হয়েছে।
ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এক সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেছে যেখানে দেখা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ৫৭ শতাংশ জো বাইডেনের ইউক্রেন নীতি কার্যক্রমকে সমর্থন করছেন না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে মার্কিনিরা উদ্বিগ্ন। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাজারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে। ফলে জীবনযাপনের সংকট নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ।
ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল পত্রিকাটি রুপার্ট মার্ডকের যাকে সবাই জো বাইডেনপন্থী হিসেবে নয় বরঞ্চ ট্রাম্পের অনুসারী হিসেবে জানেন। পত্রিকাটি যেহেতু ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক সুতরাং এই সমীক্ষা গ্রহণযোগ্য নয় বলে বিরোধিতা করছেন অনেকেই।
বুশ যখন ইরাক আক্রমণ করে তখন ইউরোপের সকল দেশ কিন্তু বুশের পক্ষে দাঁড়ায়নি। সেই সময় রাশিয়া এবং চীন বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়া এবং চীনের উচিত ছিল ইরাক দখলের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করা, কিন্তু তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
অথচ আজ রাশিয়া-ইউক্রেন অভিযানের বিপক্ষে বিশ্বের প্রায় ১৪১টি দেশ দাঁড়িয়েছে। সেই অর্থে ইঙ্গ-মার্কিন জোটের কূটনৈতিক সাফল্য লক্ষণীয়। তবে চীনকে দলভুক্ত করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে সবচেয়ে লাভবান হবে চীন। দেশটির পণ্যবাজার নতুন করে সম্প্রসারিত হচ্ছে। রাশিয়ার ১৬ কোটি মানুষের পণ্যবাজার পরিপূর্ণভাবে চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল।
চীন রাশিয়ার কাছ থেকে তেল-গ্যাস ক্রয় করে। চীনের জন্য একটা বিরাট সুবিধা হলো তারা রাশিয়ার সঙ্গে এখন নিজস্ব মুদ্রার ক্রয়-বিক্রয় শুরু করতে পেরেছে। এই যুদ্ধের ভেতর থেকে নতুন এক বিশ্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। মার্কিন ডলার নির্ভরতার বিপক্ষে একটি নতুন অর্থনৈতিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে কাজ করছে রাশিয়া ও চীন, যা বিশ্বের বহু দেশের জন্য আশা সঞ্চার করছে।
মুদ্রা বিনিময়ের সুইফট ব্যবস্থাকে মার্কিনিরা নিজস্ব রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করেছে। যখন যেভাবে মনে করছে সেভাবেই নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের ভেতর থেকে মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এক নতুন ধারার সৃষ্টি হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও অপর প্রান্তে ইংল্যান্ডের বরিস জনসন এই যুদ্ধে জড়িয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। বরিস জনসনের বিরুদ্ধে মদের পার্টি করার অভিযোগটা এখন থিতু হয়ে গেছে।
মদের পার্টি করা নিয়ে বরিস জনসনের বিরুদ্ধে হইচই পড়ে গিয়েছিল। বরিস জনসনের সেই পার্টি করা নিয়ে যে ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়েছিল, তা এখন আর ব্রিটিশ গণমাধ্যমে ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। সে দিক থেকে এই যুদ্ধ থেকে বরিস জনসন লাভবান হয়েছে।
তবে জো বাইডেনের ভবিষ্যত নিশ্চিতভাবে দুর্গম পথের দিকে হাঁটছে। আগামী নির্বাচনে জো বাইডেন বিজয়ী হবে না ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার ফিরে আসবে সেটি সময়ের বিশ্লেষণ মাত্র। তবে মনে হচ্ছে বাইডেন তার সমর্থন হারিয়েছে। বিগত নির্বাচনে জো বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে যে ভোটের ব্যবধানে জিতেছে সেটা ধরে রাখতে পারবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
এই যুদ্ধের আরেকটি দিক হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে চীন ও ভারত যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল সেখানকার সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি খানিকটা স্তিমিত হয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আরও বেশি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের জাগরণ দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচন শেষে বিজেপি যখন তার জনপ্রিয়তা কিছুটা হলেও ভাটা দেখেছে তখন নতুন করে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উস্কানি দিচ্ছে বিজেপি।
সম্প্রতি ভারতের একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা কাশ্মীর ফাইলস নামের একটি চলচ্চিত্র তৈরি করে নতুনভাবে ভারতের অভ্যন্তরে ধর্মীয় বিভাজন ও বিভেদ বৃদ্ধি করছে। কাশ্মীরের উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের নিয়ে তৈরি এই সিনেমায় এই পণ্ডিতদের ওপর মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণ দেখানো হয়েছে।
১৯৯০ সালে যখন ভিপি সিং-এর সরকার ক্ষমতায় তখন ওই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত। সিনেমার নির্মাতা একে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ছবিটির অন্যতম অভিনেতা অনুপম খের একজন কাশ্মীরী পণ্ডিত বর্ণের মানুষ, যার পরিবার ওই ঘটনা পর ওই অঞ্চল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনিও বিষয়টিকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছেন।
গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে অনুপম খেরের স্ত্রী বিজেপির অনুসারী ছিলেন। বিজেপি অনুসারী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সিনেমাটি নিয়ে ব্যাপক ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের প্রচারণায় লিপ্ত হয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ বিজেপির সকল নেতা এই চলচ্চিত্রটির পিছনে একত্রিত হয়ে দেশকে এই চলচ্চিত্রের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনে শামিল হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
বিজেপি নেতা মোদি ছবিটি দেখার জন্য ভারতের জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছে। একই সঙ্গে বিজেপি যে সমস্ত রাজ্যগুলোর নিয়ন্ত্রণে সেখানেও এই রাজ্য কর্তৃপক্ষ স্থানীয় কর মওকুফ করে দিয়ে চলচ্চিত্রটিকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রতিফলনে ভারতে মুদ্রাস্ফীতি ঘটলেও মোদির নজর সেদিকে নাই। যদিও রাশিয়ার সঙ্গে তাদের দীর্ঘকালের সম্পর্কের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের পক্ষে দাঁড়ায়নি ভারত। তবুও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থে তাদের এই বিষয়ে যেখানে আরও সক্রিয় হওয়ার কথা, তা না করে বরঞ্চ দেশের মানুষকে একটি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বর্তমান বিজেপি সরকার।
চীনের রাজনৈতিক প্রশাসনের প্রধান শক্তিশালী কাঠামো চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বাৎসরিক সভা চলছিল। সেখানে দেখা গেছে চীনের প্রেসিডেন্ট তার অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের দুর্নীতি নিয়ে দারুণভাবে ব্যস্ত আছেন। চীনের প্রশাসনের বিভিন্ন অংশে ব্যাপক দুর্নীতি নিয়ে নানান প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে চীনে। এই দুর্নীতি দমনের জন্য বহু দশক যাবত নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে দুর্নীতির বিকাশ ঘটেছে এমনটাই আলোচিত হচ্ছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টিতে। সুতরাং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার বিষয়ে আলোচনা করছে পার্টি। একদিকে বিশ্ব অঙ্গনে প্রায় দেশ ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে উদ্বিগ্ন, অভ্যন্তরীণ মুদ্রাস্ফীতির দিকে তাদের চোখ নিবন্ধিত। অন্যদিকে বৃহৎ বেশ কয়েকটি ভূখণ্ড যুদ্ধের রাজনীতিকে এক দিকে সরিয়ে রেখে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত।