আমরা লাইভে English মঙ্গলবার, মার্চ ২১, ২০২৩

করোনায় ব্যাহত দার্জিলিংয়ের ফার্স্ট ফ্লাশ প্রিমিয়াম চা পাতা সংগ্রহ

SAM SUNDAY FEATURE-ENG-19-04-2020-2

প্যারিসের বিলাসী চা হাউজ ম্যারেজ ফ্রেরেসে দার্জিলিংয়ের প্রিমিয়াম ফার্স্ট ফ্লাশ টি বিক্রি হয়। মানুষ ভালোবেসে এই চা’কে ‘চায়ের শ্যাম্পেন’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। সেই চা হাউজের তাকগুলো এখন খালি পড়ে আছে। কোভিড-১৯ মহামারী ছড়িয়ে পড়ার আগেও দার্জিলিং চা প্রতি ১০০ গ্রাম ৭০ থেকে ৮০ ইউরোতে বা কেজিপ্রতি ৬৫,৮৭৬ রুপির অবিশ্বাস্য দামে বিক্রি হয়েছে। 

ইউরোপ থেকে ৭৫০০ কিলোমিটার দূরে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিম বঙ্গের দার্জিলিংয়ের বাগানে ছায়ঘেরা পাহাড়গুলোর জন্য একটা হতাশাজনক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। দার্জিলিংয়ের চাষীরা ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কাছ থেকে একটা প্রতিকারের অপেক্ষায় আছে। দেশজুড়ে এমন সময় লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে, ‘দুঃখজনকভাবে’ যে সময়টা মওসুমের ফার্স্ট ফ্লাশ চা পাতা সংগ্রহের সময়। এই সময়ের চা পাতা থেকে উচ্চমানের সুগন্ধ পাওয়া যায়, যেটার জন্য সারা বিশ্বের মানুষ অপেক্ষা করে থাকে। 

দার্জিলিংয়ের পাহাড়ের চা চাষীরা ১৮৪০ এর দশকে ব্রিটিশরা পাহাড়ের ঢালে চা লাগানের সময় থেকে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অসহায়ভাবে দেখছে যে তাদের আইকনিক ফার্স্ট ফ্লাশ চা পাতাগুলোতে হয় ঝোপের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে বা বন্ধ কারখানায় পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। দার্জিলিংয়ের পাহাড়ের সাতাশিটি চা বাগান এখন বন্ধ হয়ে আছে।

আরও পড়ুনঃ করোনা মোকাবেলায় ম্যালেরিয়ার দাওয়াই, দার্জিলিংয়ে চাঙ্গা হচ্ছে সিনকোনার চাষ

চা বাগানের মালিক ও শিল্প সংগঠনগুলো বলেছে যে, এপ্রিলের শেষ দিকে চা বাগানগুলো যদি খুলেও যায়, এরপরও ঝোপগুলো আকারে আসতে কয়েক সপ্তাহের বেশি এমনকি এক মাসও লেগে যেতে পারে। 

দার্জিলিংয়ের চা চাষী এবং এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন যে, তারা এখন রাজ্য সরকারের কাছ থেকে নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছেন। কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে যাতে চা উৎপাদনকারী রাজ্যগুলোর চা বাগান এলাকাগুলোকে দেশব্যাপী লকডাউনের আওতার বাইরে রাখা হয়। ২৫ মার্চ মধ্য রাত থেকে সারা দেশে এই লকডাউন জারি করা হয়েছে। 

তারা আরও অনুমান করছেন যে, ফার্স্ট ফ্লাশ চায়ের বিপর্যয়ের প্রভাব সেকেন্ড ফ্লাশ চা পাতা সংগ্রহের উপরও পড়বে। দ্বিতীয় ধাপে যে বিপুল চা পাতা (৭০ শতাংশের বেশি) সংগ্রহ করা হয়, তার বেশির ভাগই রফতানি করা হয়। 

চামোং গ্রুপ অব কোম্পানিজের দার্জিলিংয়ে ১৩টি চা বাগান রয়েছে। গ্রুপের চেয়ারম্যান অশোক কুমার লোহিয়া বলেন, ২০১৭ সালের পর থেকে চা উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার পর এ বছর ফার্স্ট ফ্লাশ চা পাতা সংগ্রহের জন্য চমৎকার আবহাওয়া ছিল এবং ফলনও ভালো হয়েছিল। কিন্তু এই ভালো সময়টা এখন স্মৃতির অংশ হয়ে গেছে। 

লোহিয়া বলেন, অধিকাংশ ইউরোপিয় ক্রেতা এবং নামি দামি চা হাউজ ও মলগুলো ইস্টারের আগেই দার্জিলিংয়ের দামি ফার্স্ট ফ্লাশ চা সংগ্রহ করে। লোহিয়ার পরিবারের মালিকানাধীন বাগানগুলো একচেটিয়াভাবে অর্গানিক মাস্কাটেল চা তৈরি করে এবং এই চায়ের পুরোটাই সরাসরি জার্মানি, ব্রিটেন, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয়। 

প্রতি বছর ১৫ মার্চ ও ১০ এপ্রিল সময়কালে যখন নতুন চা পাতা উজ্জ্বল ও রৌদ্রকোজ্জ্বল শীতে গজাতে থাকে, তখনই ফার্স্ট ফ্লাশ চা বা স্প্রিং ফ্লাশ চা পাতা সংগ্রহ করা হয়। 

লোহিয়া বলেন, “এমনকি একই দিনে তোলা চা পাতার গুণগত মানও এক রকম হবে না, কারণ সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতায় জন্মেছে – যত উঁচুতে বাগান, তত গুনগত মান বেশি”। চা বাগানের লবি গ্রুপ দার্জিলিং টি অ্যাসোসিয়েশানের (ডিটিএ) সাবেক চেয়ারপার্সন তিনি। 

লোহিয়া আরও বলেন, “একই বাগানের চা সারা বছর একই রকম দাম পায় না। চায়ের মান মওসুম বদলের সাথে বদলে যায় এবং চা গাছের চারপাশে ঝোপ গজিয়ে গেলে উচ্চমূল্যের চা পাতাগুলো নষ্ট হযে যায়। যে সব চা পাইকারিতে ৬০ থেকে ৭০ ইউরোতে বিক্রি হয়, সেগুলো এখন কারখানাতে পড়ে আছে, কারণ ইউরোপ আর ভারতে লকডাউনের কারণে আমরা এখন এগুলো বিক্রি করতে পারছি না”।

ডিটিএ চেয়ারপার্সন রফতানিকারক বিনোদ মোহনের মতে, মওসুমের ফার্স্ট ফ্লাশ চা রফতানি করে এই শিল্পের রাজস্বের ৫০ শতাংশ অর্জিত হয়। সেটা এবার পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। মোহান নিজেও চা চাষ ও রফতানি করেন। তিনি সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, “লকডাউন কতটা সময় দীর্ঘ হবে, তার উপর নির্ভর করে পরিস্থিতি আরও কত খারাপ হবে”।

তিনি আরও বলেন, “এ জন্য এর অর্থনৈতিক প্রভাব পড়বে বিশাল। ফার্স্ট ফ্লাশ চা রফতানি করতে না পারার কারণেই শুধু ১.৫ বিলিয়ন রুপির বেশি ক্ষতি হয়েছে”।

মোহান ও লোহিয়া উভয়েই বলেন যে, রাজ্য সরকারকে একটা পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সাথে তাদেরকে শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং এই শিল্পের স্বার্থটা দেখতে হবে। মোহান বলেন, “রাজ্য সরকার যেই সিদ্ধান্ত নেবে, সে অনুযায়ী আমরা পদক্ষেপ নেবো”।

এই স্টোরি লেখা পর্যন্ত, পশ্চিম বঙ্গ সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনায় এখনও সাড়া দেয়নি। 

আরও পড়ুনঃ করোনাভাইরাসকে সাম্প্রাদায়িক রূপ দেয়া হচ্ছে আসামে!

কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার পাশাপাশি জঙ্গি ইউনিয়ন সংস্কৃতি এবং পাহাড়ে অব্যাহত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিগত কয়েক দশক ধরে চা শিল্পের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পাহাড়ি এলাকায় পর্যটনের পাশাপাশি এই চা শিল্পই অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত। 

আমবুতিয়া গ্রুপের ১৪টি বাগান রয়েছে দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে। গ্রুপের কর্তাব্যক্তি অনিল আমবুটিয়া বললেন, বহু বাগান মালিক এই সঙ্কটে টিকে থাকতে পারবে না। বানসাল সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, “কেউই জানেনা কখন চা সংগ্রহ আবার শুরু হবে বা লকডাউন আরও বাড়ানো হবে কি না”। শিল্পের ভেতরের লোকেরা জানিয়েছেন, বহু চা কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে এবং চা বাগানের মালিকানা বদলে যাবে। 

দার্জিলিংয়ের এক চা চাষী তার নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, “২০১৭ সালের অচলাবস্থার সময় যে প্রভাব পড়েছিল, সেটা এত বেশি ছিল যে, সেটার আঘাত পাওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ সেটা বুঝতে পারেনি। তাই কোভিড-১৯ মহামাহারির কারণে কতটা ক্ষতি হবে, সেটা এই মহামারী শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ অনুমান করতে পারবে না”।

দার্জিলিং বছরে চারবার চা উৎপাদন করে। ফার্স্ট ফ্লাশ চা, যেটা দার্জিলিংয়ের মোট উৎপাদনের ২০ শতাংশ, সেকেন্ড ফ্লাশ চা – এটাও মোটা উৎপাদনের ২০ শতাংশ, মওসুমী ফ্লাশ চা, যেটা মোট উৎপাদনের ৩০ শতাংশ এবং শরৎকালীন ফ্লাশ চা, যেটা উৎপাদনের বাকি ৩০ শতাংশ।